মালদা, 1 অগস্ট: একসময় মালদার রেশমের কাপড় পৌঁছত মুঘল দরবারে । সুলতান এবং তাঁর বেগমদের গায়ে উঠত এই জেলার রেশমের কাপড় । জেলার রেশম শিল্পের সেই সুদিন এখন অতীত । গুটি ও সুতো তৈরি হলেও, মালদায় সেই সুতো থেকে কাপড় তৈরির কোনও পরিকাঠামো নেই । অথচ এখানকার সুতো থেকেই কাপড় তৈরি হচ্ছে বারাণসী, নেপাল এবং দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে । মালদা জেলায় উৎপাদিত এই সুতো দিয়েই তৈরি হচ্ছে বেনারসি, কাঞ্জিভরম-সহ নানা নামের দামি শাড়ি । এই পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন ধরেই দাবি উঠছিল, এই জেলাতেই রেশমের পাওয়ার লুম তৈরি করা হোক । জেলায় তৈরি হোক স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রেশমের শাড়ি-সহ বিভিন্ন জামাকাপড় ।
মালদার রেশম শিল্পকে তার পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে তৎপর হয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার । সম্প্রতি কেন্দ্রের তরফে একাধিক দল জেলার রেশম শিল্পের হাল হকিকত খতিয়ে দেখে গিয়েছে । এসেছে নীতি আয়োগের প্রতিনিধি দলও । রাজ্য সরকারের তরফেও বেশ কয়েকটি দল এখানকার রেশম শিল্পের পরিস্থিতি দেখে গিয়েছে । রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইংরেজবাজারের মধুঘাটে তৈরি সিল্ক পার্কে রেশমি শাড়ি, জামাকাপড়-সহ নানাবিধ সামগ্রী তৈরি করা হবে । সেসবের প্যাকেজিং এবং মার্কেটিংও হবে এই জেলা থেকে । সরকারের এই সিদ্ধান্তে খুশি ব্যবসায়ী ও শিল্পদ্যোগীরা । কিন্তু কৃষকরা বলছেন, সরকারি এই ভাবনার গোড়াতেই গলদ রয়েছে । রেশমচাষিদের কথা না ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে । ফলে সরকারি এই উদ্যোগ কখনই সফল হবে না (question arise on future of Malda Silk Hub) ।
আরও পড়ুন: আর কোনও দিন জল্পেশ মন্দিরে পুজো দিতে আসব না: পুণ্যার্থী
কেন চাষিরা এমন ভাবছেন ? তাঁরা জানিয়েছেন, মালদা জেলায় রেশম চাষের পাঁচটি মরশুম। প্রতিটি চাষে বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে । এক থেকে দশ দিন পর্যন্ত পলুপোকাকে চৌকি রিয়ারিং সেন্টারগুলিতে (সিআরসি) রাখা হয়। প্রতিটি সেন্টারের মালিককে সরকারের তরফে পলুর ডিম, তুঁতপাতার খরচ, ওষুধ, জীবাণুনাশক-সহ আনুষঙ্গিক খরচ দেওয়া হতো । কিন্তু 2019 সালে করোনা হামলার পর থেকে সেই সরকারি সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ । এবছর এপ্রিল থেকে সেই সহায়তা ফের চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি । রেশম চাষে আরেকটি বড় বিষয় গণ পরিশোধন প্রকল্প । কারণ, সিআরসি থেকে চাষিরা পলুপোকা বাড়িতে এনে চাষ করার সময় কোনও কারণে জীবাণুর হামলা হলে রেশম চাষ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় । সেই হামলা ঠেকাতে সরকারি সহায়তা পেতেন চাষিরা । 25টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী জেলার 60 হাজার রেশমচাষির বাড়ি গিয়ে দু’বার পলুপোকার ডালা চন্দ্রকী (বাঁশের যে ডালায় পলুপোকার চাষ করা হয় তাকে ডালা চন্দ্রকী বলে) জীবাণুমুক্ত করতেন । 2019 সাল থেকে তা এখনও বন্ধ রয়েছে । চাষিদের 10-12 দিন ধরে প্রতিদিন পোকার গায়ে ফাঙ্গাসনাশক ওষুধ ডাস্টিং করতে হয় । এর জন্য চাষিরা 150 টাকা দিতেন, বাকি 450 টাকা সরকারি ভর্তুকি মিলত । সেটাও এখন বন্ধ । বন্ধ খাটাল প্রোজেক্ট । 2019 সালের আগে এই চাষে সব মিলিয়ে বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার সরকারি সহায়তা পেতেন চাষিরা । এখন তাঁরা কিছুই পাচ্ছেন না । তার প্রভাব পড়েছে চাষেও । তাই তাঁরা নিশ্চিত, চাষিদের সহায়তা না করা হলে জেলায় রেশম কাপড় তৈরির সরকারি উদ্যোগ কিছুতেই বাস্তবায়িত হবে না ।
আরও পড়ুন: মালদায় উৎপাদিত রেশম দিয়ে জেলাতেই তৈরি হবে জামাকাপড়-শাড়ি
মালদায় সবচেয়ে বেশি রেশম উৎপাদিত হয় কালিয়াচক 1 নম্বর ব্লকে । সেখানকার নবীনগর গ্রামের রেশমচাষি মহম্মদ মতিউর রহমান বলেন,“রেশম শিল্পকে গতি দিতে হলে প্রথমে চাষিদের দিকেই তাকাতে হবে । আমরা পলু ঘরে নিয়ে আসার পর থেকে কোকুন তৈরি পর্যন্ত সরকারি সহায়তা পেতাম । সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । আমাদের পাকা খাটাল দেওয়া হত । এতে পলুপোকার চাষ আরও ভালো করা যেত । কম সময়ে, কম শ্রমিকে ভালো মানের রেশম পাওয়া যেত । এসব কারণে এখন রেশমের উৎপাদনও কমে গিয়েছে । আমরা যদি কোকুন না তৈরি করতে পারি, তবে রেশম শিল্প হবে কীভাবে?”
এনিয়ে জেলার বণিকসভা, মালদা মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি জয়ন্ত কুণ্ডুর বক্তব্য,“রেশম মালদা জেলার অন্যতম অর্থকরি ফসল । আমাদের দাবি মেনে রাজ্য সরকার সিল্ক পার্ক তৈরি করেছে । কিন্তু রেশমচাষিদের জন্য সরকারিভাবে সেভাবে কিছু করা হচ্ছে না । সরকারের উচিত, এই চাষিদের কথা আগে ভাবা । করোনার পর থেকে রেশম চাষিদের সুযোগ সুবিধে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । সেসব দ্রুত চালু করতে হবে । তবেই মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্ন সফল হবে ।”