মালদা, 1 ডিসেম্বর: পেশায় তিনি সাংবাদিক (Bird Lover Journalist)৷ নেশা পাখিদের ক্যামেরাবন্দি করা ৷ সুযোগ পেয়েই আকাশে উড়ে বেড়ানো কিংবা জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা পাখিদের নিজের লেন্সে বন্দি করেন তিনি ৷ ইতিমধ্যেই তিনি 1350 প্রজাতির মধ্যে 700-রও বেশি পাখিকে ক্যামেরাবন্দি করেছেন ৷ প্রায় 12 বছরের এই নেশা তাঁকে জানিয়েছে, পরিবেশ সুস্থ রাখতে পাখিদের ভূমিকা ঠিক কতটা ৷ পাখিদের উপর বাস্তুতন্ত্র কতটা নির্ভরশীল ৷ তাই শুধু ক্যামেরায় পাখিদের বন্দি করাই নয়, তাদের বিচরণ ক্ষেত্র যাতে উন্মুক্ত থাকে, যাতে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়, তারও চেষ্টা করে চলেছেন তিনি ৷ আর এই কাজে সাংবাদিকের সঙ্গী হয়েছেন মালদার আরও কিছু পাখিপ্রেমী ৷
কল্লোল মজুমদার ৷ বর্তমানে রাজ্যের ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফিতে পরিচিত নাম ৷ তবে পাখিদের তিনি পেশা হিসাবে কখনও দেখেননি ৷ নিছকই শখে ছবি তোলা ৷ সেটাই এখন নেশা ৷ ইতিমধ্যে কলকাতা, দুর্গাপুর, মালদা, রায়গঞ্জ, শিলিগুড়ির মতো শহরে তাঁর তোলা ছবির প্রদর্শনী হয়েছে ৷ একাধিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও পেয়েছেন ৷ 55 বছর বয়সে এখনও দৌড়ে বেড়ান পাহাড় থেকে সাগর, জঙ্গল থেকে মরুভূমি ৷ পাখির নেশায় ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রায় গোটা দেশ ৷ এমনকী ঘরের কাছেও ছুটে বেড়ান ৷ কাঁধে কয়েক কিলোর ক্যামেরা নিয়েই ৷ নেশার কি আর বয়স থাকে ! তাঁর সঙ্গেই আলাপচারিতায় ইটিভি ভারত ৷ নিজের তোলা কিছু ছবিও তিনি ইটিভি ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন ৷
এই দেশে প্রায় 1350 প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায় ৷ তার মধ্যে প্রায় 700 প্রজাতির পাখি এই সাংবাদিকের ক্যামেরায় বন্দি ৷ পাখির ছবি তুলতে তুলতেই আলাপচারিতায় কল্লোল মজুমদার জানালেন, “12-13 বছর ধরে পাখির ছবি তুলছি ৷ পাখি দেখতে, তার ছবি তুলতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি ৷ ইতিমধ্যে 700টির বেশি প্রজাতির পাখির ছবি তুলতে পেরেছি ৷ এখন আমার পাখির চোখে বাকি প্রজাতির পাখিগুলি ৷ আমি চাই, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষ পাখি চিনুক ৷ অনেকেই ফোন করে আমার কাছে পাখির বাংলা নাম জানতে চান ৷ এতেই প্রমাণিত, পাখি নিয়ে মানুষের উৎসাহ বাড়ছে ৷ সবচেয়ে বড় কথা, পাখি না বাঁচলে মানবজাতিও বিপন্ন হয়ে পড়বে ৷ এ নিয়ে মানুষকে সচেতন করাও আমার লক্ষ্য ৷”
আরও পড়ুন: দূষিত আসানসোলেও বাড়ছে বিরল পরিযায়ী পাখির সংখ্যা
সেলিম আলি প্রথম বাংলার মানুষকে পাখি চিনতে শিখিয়েছিলেন ৷ তাঁর দেখানো পথে এই মুহূর্তে রাজ্যে অনেক পাখিপ্রেমী পাখি দেখে, চিনে বেড়াচ্ছেন ৷ কিন্তু পরিবেশ দূষণ আর মানুষের লোভের সামনে দেশি কিংবা পরিযায়ী পাখিদের ভবিষ্যৎ কী ? পাখিপ্রেমী সাংবাদিক জানালেন, “সেলিম আলি যখন পাখি নিয়ে কাজ করেছেন, তখন বিজ্ঞান এত উন্নত ছিল না ৷ তিনি না থাকলে আজ আমরা এত পাখি চিনতাম না ৷ পাখির প্রকারভেদও জানতাম না ৷ নগরায়নের ধাক্কায় এখন শহরাঞ্চলে গাছপালা নেই বললেই চলে ৷ সবুজ জঙ্গলের জায়গায় তৈরি হচ্ছে কংক্রিটের জঙ্গল ৷ এতে শুধু পাখি নয়, সমস্ত ধরনের প্রাণীর ক্ষেত্রেই বিপদ নেমে আসছে ৷ নিজেদের বাঁচাতে সবুজ বাঁচাতেই হবে ৷ আগের তুলনায় এখন মালদায় বেশি প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ৷ কিন্তু তাদের সংখ্যা আগের থেকে অনেক কমে গিয়েছে ৷ মালদায় গঙ্গার চরগুলিতে প্রতি শীতে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে ৷ একাধিক প্রজাতির হাঁস দেখা যায় ৷ একটা সময় এই পাখিগুলি মেরে মাংস খাওয়া হত ৷ সেটা বন্ধ করতে আমরা লাগাতার আন্দোলন চালিয়েছি ৷ মানুষকে বুঝিয়েছি ৷ কিছুটা হলেও তার ফল মিলেছে ৷ কিন্তু পাখিদের বিচরণক্ষেত্র শুধুমাত্র আমরা নিরাপদ করতে পারব না ৷ তার জন্য বন দফতরকেও এগিয়ে আসতে হবে ৷ পাখি শিকারিদের কড়া শাস্তি না দেওয়া হলে পাখি শিকার কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না ৷ দুঃখের কথা, বন দফতর কিংবা প্রশাসনকে এ নিয়ে তেমন কোনও উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি ৷ একইসঙ্গে মালদায় পাখির সংখ্যা বাড়াতে দূষণও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ৷ কৃষিজমিতে খড় পোড়ানোর জন্য পরিযায়ী পাখিরা সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয়ে পড়ছে ৷”
কল্লোল মজুমদারের অনুপ্রেরণায় পাখিকে ভালোবাসতে শিখেছেন প্রাথমিক শিক্ষক সুদীপ্ত মানি ৷ তিনি জানালেন, “পাখি শিকার বন্ধ করতে কল্লোলদা দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন ৷ শুধু গঙ্গার চর নয়, এখানে নয়াবাঁধ নামে একটি জায়গা রয়েছে, যেখানে শীতকালে প্রচুর পাখি আসে ৷ সেখান থেকেও শিকারির দল পাখি মেরে কিংবা ধরে বিক্রি করে ৷ এমনকী শহরের বাজারেও প্রকাশ্যে সেই পাখি বিক্রি হচ্ছে ৷ অথচ এ সব রুখতে প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয় না ৷”
পাখি সংরক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছেন কাঁচড়াপাড়া কলেজের প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক বিপ্লবকুমার মুখোপাধ্যায় ৷ তিনি জানাচ্ছেন, “জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া সম্প্রতি বার্ডস অফ ইন্ডিয়া নামে একটি বই প্রকাশ করেছে ৷ সেই বইয়ে ভারতে 1332 প্রজাতির পাখি পাওয়া যায় বলে উল্লেখ রয়েছে ৷ যদিও বেসরকারিভাবে আমরা এই সংখ্যাটি 164 দেখতে পাই, তবে তা কতটা তথ্যনির্ভর সেটা বলা মুশকিল ৷ 1332টি প্রজাতির পাখির মধ্যে 1227 প্রজাতির পাখি এ দেশে সাধারণভাবেই দেখতে পাওয়া যায় ৷ জেডএসআইয়ের বইয়ে থাকা 104টি এমন প্রজাতির পাখি রয়েছে যাদের এ দেশে এক কিংবা দু’বার দেখতে পাওয়া গিয়েছে ৷ তালিকায় থাকা পাখিগুলির মধ্যে প্রায় 400 প্রজাতির পাখি পরিযায়ী ৷ এই পাখিগুলি প্রায় 30টি দেশ থেকে ভারতে আসে ৷ কিছুদিন থাকার পর ফের চলে যায় ৷ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচারের (আইইউসিএন) তথ্য অনুযায়ী, 1332টির মধ্যে 102টি এমন প্রজাতির পাখি রয়েছে, যারা অতি বিপন্ন ৷ যেভাবে বনাঞ্চল ও জলাভূমি নষ্ট হচ্ছে তাতে জানি না, আর কতদিন এত প্রজাতির পাখি আমরা ভারতে দেখতে পাব ৷ একমাত্র মানুষ সচেতন হলেই সব প্রজাতির পাখি বাঁচতে পারে ৷ বন ও জলাভূমি বাঁচাতে মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে ৷”