মালদা, 23 ডিসেম্বর : গৌড়বঙ্গের মধ্যমণি মালদা জেলা ৷ এই জেলার লাগোয়া রাজ্য বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ ৷ রয়েছে দেশের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যাওয়া রেলওয়ে নেটওয়ার্ক ৷ এমনকি তিনটি জাতীয় সড়কও রয়েছে এই জেলায় ৷ কিন্তু, এখনও পর্যন্ত এই জেলায় বলার মতো কোনও শিল্প গড়ে ওঠেনি ৷ বাম জমানায় পুরাতন মালদার নারায়ণপুরে একটি শিল্পতালুক তৈরি হয়েছিল বটে ৷ কিন্তু, সেখানেও তেমন শিল্প গড়ে ওঠেনি ৷ ভারি শিল্প তো দূর অস্ত, মাঝারি কিংবা ছোট শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রেও বহু পিছিয়ে এই জেলা ৷ তৃণমূলের জমানায় মালদায় শিল্প স্থাপনের জন্য দু’বার শিল্প সম্মেলন করা হয়েছিল ৷ তাতেও এখনও পর্যন্ত কোনও লাভ হয়নি ৷ সম্প্রতি মালদায় এসে মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, মালদায় শিল্প গড়ে তুলতে খুব তাড়াতাড়ি আরও একটি শিল্প সম্মেলন করতে হবে ৷ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে, শিল্প ছাড়া যে গতি নেই, সেটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান ৷ সেই নির্দেশ মত আগামী 16 ফেব্রুয়ারি মালদা কলেজ অডিটোরিয়ামের দুর্গাকিংকর সদনে হতে চলেছে মালদা বাণিজ্য সম্মেলন 2022 (Malda Business Summit 2022) ৷ এ নিয়ে কী ভাবছে শিল্পদ্যোগী মহল ? তারই আভাস পাওয়ার চেষ্টা করেছে ইটিভি ভারত ৷
মালদা ইন্ডাস্ট্রিয়াল চেম্বার অফ কমার্সের সম্পাদক সুভাষ হালদার জানাচ্ছেন, “2014 সালের সম্মেলনে এই জেলায় 3200 কোটি টাকার শিল্প স্থাপনের প্রস্তাব এসেছিল ৷ এর মধ্যে বেশ কিছু কাজ হয়েছে ৷ গুজরাতের অম্বুজা এই জেলায় প্রায় 500 কোটি টাকার একটি বড় শিল্প স্থাপন করছে ৷ এছাড়াও ছোট আরও কিছু শিল্প স্থাপিত হয়েছে এবং হচ্ছে ৷ 2019 সালের সিনার্জিতে শিল্প স্থাপনের প্রস্তাব কিছু আসেনি ৷ জেলায় শিল্প স্থাপনের জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ৷ আগামী 18 ফেব্রুয়ারি জেলায় ফের সিনার্জি বসছে ৷ আমরা সেখানে অনেক শিল্প স্থাপনের প্রস্তাব পাব বলে আশা করছি (Industrialists of Malda are Hope Full About Business Summit) । ইতিমধ্যে, দুটি ইথানল প্ল্যান্টের প্রস্তাব আমাদের কাছে আছে। বর্তমানে রাজ্য সরকার লেয়ার ফার্মিংয়ের উপর অনেক কাজ করছে। তার উপরেও কিছু প্রস্তাব আমরা সিনার্জিতে পাব বলে আশা করছি। মালদায় শিল্প স্থাপনের অনেক সুবিধে রয়েছে। ভৌগোলিকভাবে মাত্র 20-25 কিলোমিটারের মধ্যে মহদিপুর স্থল বাণিজ্য বন্দর। এখানে রেল ও সড়ক যোগাযোগ খুবই ভাল। দু’তিনটি বহুজাতিক কোম্পানি এখানে আসতে চাইছে। কিছু অসুবিধেও রয়েছে। তার মধ্যে মূল সমস্যা জমির। কিছুদিন আগে 26 জন শিল্পপতি জমি পেতে আবেদন করেছিলেন ৷ কিন্তু, এখনও তাঁরা সেই আবেদনে সাড়া পাননি। জমি পাওয়া গেলে এখানে আরও অনেক শিল্প হবে। আর মুখ্যমন্ত্রী যে সিঙ্গল উইন্ডো অর্থাৎ এক জানালা পদ্ধতির কথা বলেছিলেন, এখানে তার সুবিধে এখনও আমরা পাইনি। এক জায়গা থেকে শিল্প স্থাপনের জন্য সব কিছু পাওয়া গেলে, আমাদের শিল্প স্থাপনে অনেক সুবিধে হয়। তবে ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে আমাদের তেমন অসুবিধে হয় না ৷ আসন্ন সিনার্জিতে আমরা সরকারের কাছে বহু প্রস্তাব রাখব ।”
এই মুহূর্তে চেন্নাইয়ে রয়েছেন মালদা মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সের সম্পাদক জয়ন্ত কুণ্ডু ৷ শিল্প সম্মেলন নিয়ে ফোনে তিনি জানান, “2014 সালের শিল্প সম্মেলনের পর সরকারি লাল ফিতের ফাঁস থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া গিয়েছে ৷ আগে কোনও শিল্প স্থাপনের জন্য বিদ্যুতের অনুমতি পেতে বার বার সংশ্লিষ্ট দফতরে দৌড়তে হত। একই দশা দেখা দিত অন্যান্য দফতরের ক্ষেত্রেও ৷ প্রথম সিনার্জি হওয়ার পর এই সমস্যা অনেকটাই কমেছে। জমি পাওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা কিছুটা কমেছে। ফলে অনেক নতুন শিল্পপতি এখানে শিল্প স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন (Industrialists from Malda on Business Possibility) । এটাই জেলার বড় প্রাপ্তি। গাজোলে একটি শিল্প স্থাপিত হচ্ছে। আশা করছি, আরও অনেক শিল্প এখানে গড়ে উঠবে। আগে আমরা আম আর রেশম ছাড়া মালদার শিল্প কিছু বুঝতাম না। কিন্তু আম আর রেশম ছাড়াও যে এখানে শিল্প গড়ে তোলা যায়, তা সবাই বুঝেছে। জেলায় যদি প্রতি বছর একটি করে সিনার্জি হয় ৷ তবে, নতুন শিল্পপতিরা এগিয়ে আসবেন। জেলায় আরও অনেক শিল্প স্থাপন হবে। ইতিমধ্যে অনেক শিল্পপতি এখানে শিল্প স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তবে, রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত কো-অপারেটিভ ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা রয়েছে ৷ সেই জটিলতা কাটানোর জন্য আমি মুখ্যমন্ত্রীকেও জানিয়েছি ৷ আশা করি তিনি বিষয়টি নিয়ে কোনও ব্যবস্থা নেবেন ৷ তবে, জেলায় শিল্প স্থাপন করতে গেলে বিমান পরিষেবা চালু করা খুব জরুরি ৷ উড়ান চালু হলে আরও অনেক শিল্পপতি দ্রুত এই জেলায় যাতায়াত করতে পারবেন। আসন্ন সিনার্জিতে আমরা বিষয়টি তুলে ধরব। আমরা আশা করছি, এই সিনার্জিতে আমরা 200 জনেরও বেশি শিল্পপতিকে নিয়ে আসতে পারব ।”
আসন্ন শিল্প সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন আম ব্যবসায়ীরাও। মালদা ম্যাঙ্গো মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উজ্জ্বল সাহার বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই জেলায় প্রথমবার সিনার্জির আয়োজন করেছিলেন। গৌড়বঙ্গের তিনটি জেলাকে নিয়ে সেই সিনার্জি হয়েছিল। সেখানে আমরা দেখেছিলাম, অনেক শিল্পপতি এখানে শিল্প গড়ে তুলতে উৎসাহিত হয়েছিলেন। তিন হাজার কোটি টাকার বেশি শিল্প স্থাপনের প্রস্তাব এসেছিল। মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গল উইন্ডো ঘোষণায় শিল্পপতিদের উৎসাহ আরও বেড়েছে। গৌড়বঙ্গের অর্থনীতি মূলত আমের উপর নির্ভর করে। প্রচুর মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। ফলে আমের উপর ভিত্তি করে এখানে অনেক শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথম সিনার্জির পর এই জেলায় কিছু পাটকল, কিছু ময়দার কল, কিছু রাইস মিল হয়েছে। গুজরাত অম্বুজা এখানে প্রায় সাড়ে ছ’শো কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। আগামী মার্চ থেকে তাদের উৎপাদন শুরু হবে। এছাড়াও এখানে সুখজিৎ স্টার্চ রয়েছে। এসব মোটামুটি বড় শিল্প। প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি টাকায় এখানে একটি ইথানল প্ল্যান্ট স্থাপনের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও আরও কিছু শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের তরফে এই এলাকায় সেভাবে কখনই নজর দেওয়া হয়নি। আমাদের দাবি মেনে মালদা ও মুর্শিদাবাদকে আম ও লিচু এক্সপোর্ট জোন হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল ৷ কিন্তু, তার কোনও বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। এখানে এখনও বিমান পরিষেবা চালু হয়নি। শিল্প স্থাপনের জন্য বিমান পরিষেবা থাকা খুব জরুরি। এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি দল দু’দিন আগেই এখানকার বিমানবন্দরের পরিকাঠামো খতিয়ে দেখেছে। তারা জানিয়েছে, মাত্র 19 আসনের বিমান এখানে চালানো যেতে পারে ৷ কিন্তু, এখানে অন্তত 42 আসনের বিমান চলাচল প্রয়োজন ৷ মুখ্যমন্ত্রী এখানে রানওয়ে বাড়ানোরও নির্দেশ দিয়েছেন ৷ তবে বিমান কবে চলবে, আমরা জানি না ৷ অথচ এখানে ভারী শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে ৷ এর সঙ্গে দুই দিনাজপুরের চাল নিয়েও এখানে শিল্প গড়ে উঠতে পারে ৷ রেশম শিল্পের জন্য এখানে ক্লাস্টার তৈরি হচ্ছে ৷ কার্পেট ও হ্যান্ডলুম ক্লাস্টারও তৈরি হচ্ছে ৷ শুধু প্রয়োজন উড়ান চালু হওয়া ৷ আসন্ন সিনার্জিতে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মতো আমরা 100 শতাংশ সিঙ্গল উইন্ডো চালুর দাবি রাখব ৷ এখনও আমরা শিল্প স্থাপন করার ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন দফতরের সহযোগিতা পাই না ।”