মালদা, 23 সেপ্টেম্বর : পুজো চলে এলেও বাগানে এবার ফুল ফোটেনি । আসরে ছড়ায়নি সুগন্ধ । উৎসবের মুখেও পুরোপুরি ছন্দ হারিয়েছে মজলিশের ।
মালদা জেলার গাজোল ব্লকের ছোট্ট একটি গ্রাম মজলিশবাগ । গ্রামের 100 শতাংশ বাসিন্দা আদিবাসী । 30-35 বছর ধরে এই গ্রামের সুনাম বাঁশের বিভিন্ন শিল্পকর্মের জন্য । বছরভর সংসারের নানা ধরনের জিনিসপত্র তৈরি করলেও পুজোর গন্ধ এলে শিল্পীরা মেতে ওঠেন নিজেদের হস্তশিল্পের নমুনা সবার সামনে তুলে ধরতে । প্রতি বছর জেলা ছাড়িয়ে রাজ্য, রাজ্য ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন পুজোমণ্ডপ সেজে ওঠে এই গ্রামের পাশের শিল্পকর্ম দিয়ে । মাস তিনেক কাজ করে গরিব মানুষগুলোর ঘরে ঢোকে কয়েক মাসের খোরাকি । ফলে, পুজোর অন্তত 90 দিন আগে থেকেই ব্যস্ততা তুঙ্গে ওঠে শিল্পীদের । কিন্তু এবার কোরোনা যেন কেড়ে নিয়েছে গ্রামের প্রাণ । শিল্পীদের মুখে এবার আর হাসি নেই । কয়েকদিন আগে পাওয়া একটি মাত্র মণ্ডপের বরাতেই এবার তাঁদের পেট ও সত্তা বাঁচানোর লড়াই ।
মালদা শহর থেকে 34 নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে শিলিগুড়ির দিকে যেতে প্রায় 19 কিলোমিটার দূরে আদিনা মোড় । সেখান থেকে ডানদিকের রাস্তা দিয়ে মৃগদাবের পথ পেরিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার গেলে মজলিশবাগ গ্রাম । এই গ্রামের সবাই কৃষি ও শ্রমজীবী । মূল পেশার সঙ্গে প্রায় 300 হস্তশিল্পী বাঁশের কাজ করেন । এবার কোরোনা পরিস্থিতিতে আর্থিক ক্ষতির মুখে প্রায় সবাই । অনেকে প্রাণের মায়া ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন ভিনরাজ্যে । বাকিরা আশ্বিনে ব্যস্ত আমন ধানের চাষে । এই মুহূর্তে গ্রামের মাঠের ধারে চলছে দুর্গাপুজোর মণ্ডপসজ্জার কাজ । সবুজ বাঁশের ছিলায় দৌড়চ্ছে শিল্পীদের নিপুণ হাতের আঙুল । ধীরে ধীরে আকার পাচ্ছে বিভিন্ন অবয়ব । জানা যাচ্ছে, অন্য বছরগুলিতে মণ্ডপের কাজ করে একেকজন শিল্পী 25 থেকে 35 হাজার টাকা উপার্জন করে থাকেন । কিন্তু কোরোনার স্রোতে এবার ভেসে গিয়েছে সব । মাঠের ধারে কমিউনিটি হলের বারান্দায় বসে বাঁশের বাতার উপর বাটালি দিয়ে নকশা তৈরি করছিলেন যতীন টুডু । তিনি বলেন, "83-84 সাল থেকে এই কাজ করছি । বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করি । তার মধ্যে রয়েছে মণ্ডপসজ্জার জিনিসপত্রও । এই গ্রামে 250 থেকে 300 জন বাঁশের হস্তশিল্পী রয়েছেন । প্রতি বছর আমরা সবাই অনেকটাই কাজ পাই। অন্য বছরগুলিতে পুজোয় মালদা, কলকাতা কিংবা ভিনরাজ্য থেকেও প্রচুর কাজের বরাত পেতাম । পুজোর অনেক আগে থেকে একাধিক উদ্যোক্তা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করত । গত বছর আমরা তিনটি কাজ পেয়েছিলাম । কিন্তু করোনার জন্য এবার আমাদের কাজ নেই । মাসখানেক বাদে পুজো । মাত্র কয়েকদিন আগে ছোটো একটা কাজ পেয়েছি । এবার আমরা মাত্র 40-45 জন কাজ করছি ।"
আরেক শিল্পী বিশ্বনাথ মালপাহাড়ি বলেন, "এই কাজ অত্যন্ত পরিশ্রমের । অনেক সময় নিয়ে কাজ করতে হয় । কোনও মেশিন নয়, সবটাই হয় হাতে । একটা ছোটো মণ্ডপের কাজ করতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে । আর বড় হলে দুই থেকে আড়াই মাস লেগেই যায় । অন্য বছরগুলিতে আমরা একাধিক পুজোমণ্ডপের কাজ করি । বেশ ভালোই উপার্জন হয়। কিন্তু এবার কোরোনার জন্য সব মাটি । বাইরে কোথাও কাজ নেই । পুজোর কাজও প্রায় বন্ধ । একটামাত্র ছোটো কাজ পেয়েছি । ফলে অন্যান্য বছর পুজোয় যা যায় হয়, এবার তার ধারেকাছেও যাবে না । কিন্তু শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের কাজ করতেই হবে । এবার কালীপুজোতেও কাজ পাব কি না এখনই বলা যাচ্ছে না । তবে যতদূর ধারণা, এবার কালীপুজোও নিষ্ফলা যাবে ।"
শুধু পুরুষরা নয়, মজলিশবাগ গ্রামে বাঁশের হস্তশিল্পের কাজে নেমে পড়েছেন মহিলারাও । তাঁদেরই একজন ললিতা হাঁসদা বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করছি । কোরোনার জন্য এবার আমাদের হাতে কাজ নেই । সামান্য কাজ চলছে । অন্য বছর ভালোই কাজ থাকে । এবার তার ধারেকাছে নেই । অন্য বছরগুলোতে এই কাজ করে ঘরে যে টাকা ঢুকত, এবার তা ঢুকবে না । এমনিতেই এবার কোরোনার জন্য হাতে টাকাপয়সা নেই। প্রবল সমস্যায় দিন কাটছে । কোরোনায় এবার আমরা কাজই করতে পারছি না । মাত্র একটা কাজ পেয়েছি ।"
মজলিশবাগ গ্রামের বাঁশের শিল্পকর্ম মূলত আবর্তিত হয় শিল্পী সনাতন টুডুর হাত ধরে । তিনিই কার্যত গ্রামের শিল্পীদের নিয়ন্ত্রণ করেন । তিনি বলেন, "গাজোলের পাণ্ডুয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ছোট্ট এই গ্রামটি পুরোপুরি আদিবাসী অধ্যুষিত । এখানে 250 থেকে 300 শিল্পী বাঁশের কাজের সঙ্গে যুক্ত । বংশপরম্পরায় এখানে এই কাজে চলে আসছে । এই কাজের সঙ্গে আমরা কৃষিশ্রমিকের কাজও করি । অনেকে ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে যায় । মূল পেশা সঙ্গেই আমরা বাঁশের কাজ করি । আগে আমরা মূলত প্রাত্যহিক ব্যবহারের জিনিস তৈরি করতাম । সময় গড়ানোর সঙ্গে আমরা অন্যান্য কাজেও হাত দিয়েছি । তার মধ্যে অন্যতম হলো পুজোমণ্ডপের কাজ । প্রায় 30 বছর আগে থেকেই আমরা পুজোমণ্ডপের কাজ করে আসছি । তবে এবার পরিস্থিতি একটু অন্যরকম । কোরোনার হানা পড়েছে গোটা দেশে । ফলে আমাদের হস্তশিল্প বিক্রির বাজার প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে । এবার পুজোমণ্ডপের কাজের বরাতও জোটেনি । শুধু গত 15 অগাস্ট কলকাতার মাস্টারদা সূর্য সেন ক্লাবের একটা ছোটো মণ্ডপের বরাত পেয়েছি । এখন সেই কাজে নেমে পড়েছি । আগামী 30 সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেই কাজ উদ্যোক্তাদের দিতে হবে । অন্যান্য বছর আমাদের শিল্পকর্ম জেলা, রাজ্য, এমনকী দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারতাম । এবার সেটা পারছি না । আমাদের সত্যিই খুব খারাপ লাগছে । আমাদের আয়ও এবার পুরোপুরি নষ্ট হতে চলেছে । আমরা আপনাদের মাধ্যমে সবাইকে বার্তা দিতে চাই, প্রত্যেকে যেন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সদর্থক ভূমিকা নেয় ।"
মজলিশবাগ চাইছে, কোরোনার রাত কেটে ভোর হোক। ফের চেনা ছন্দে ফিরুক পৃথিবী । ফের মানুষগুলোর নিপুণ হাতের চালনায় বাঁশের ছিলা রূপ পাক বিভিন্ন অবয়বের । গরিব মানুষগুলোর ঘরে ঢুকুক কিছু অর্থ । যাতে কয়েকমাস পেটের চিন্তা ভুলে তারা নিজেদের শিল্প নিয়েই বুঁদ হয়ে থাকতে পারে ।