মালদা, 27 মে : কোরোনা প্রতিহত করতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য৷ বন্ধ হয়ে রয়েছে মহদিপুর আন্তর্জাতিক স্থল বাণিজ্য বন্দরও ৷ ফলে প্রতিদিন সরকারের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ ডলারের রাজস্ব ৷ ব্যবসায় দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ আড়াই কোটি টাকা ৷ আর এই সবের ফলে বিপন্ন হয়ে পড়েছেন এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অন্তত দুই লাখ মানুষ৷ তাই পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক হয়ে বাণিজ্য পুনরায় চালু হয় সে আশাই করছেন সকলে ।
পশ্চিমবঙ্গের যে পাঁচটি স্থল বাণিজ্য বন্দর দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চলে তার মধ্যে মালদার মহদিপুর দ্বিতীয় স্থানে ৷ প্রতিদিন এই সীমান্ত বন্দর দিয়ে আড়াই কোটি টাকার ব্যবসা হয় ৷ এটি মূলত রপ্তানি বন্দর৷ এদেশ থেকে পাথর, ফ্লাই অ্যাশ, চাল, ডাল, পিঁয়াজ এবং বিভিন্ন ফল প্রতিবেশী দেশে রপ্তানি করা হয়৷ এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পরিবহন, পেট্রোল পাম্প, হোটেল, লোডিং-আনলোডিং-সহ আরও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রের অসংখ্য শ্রমিকের আয় ৷ সব মিলিয়ে এই ব্যবসার উপর নির্ভরশীল কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ ৷
কোরোনা প্রতিরোধে 24 মার্চ থেকে দেশজুড়ে চলছে লকডাউন ৷ তার আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দেশের সমস্ত সীমান্ত ৷ বন্ধ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও ৷ এই মুহূর্তে দেশে কোরোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ৷ ফলে এখনই এই ব্যবসা ফের চালু হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না ৷ এতে প্রবল সমস্যায় পড়েছেন আন্তর্জাতিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সবাই ৷
মহদিপুর ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ভূপতি মণ্ডল বলেন, "সরকার যেদিন থেকে লকডাউন ঘোষণা করেছিল তখন থেকে আমরাই কোরোনার ভয়ে মহদিপুর এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তরফে এলাকাকে সুস্থ রাখতে কিছুদিন বাণিজ্য বন্ধ রেখেছিলাম ৷ কিছুদিন পর বাণিজ্য ফের চালু করতে আমরা জেলাশাসকের কাছে আবেদন জানাই ৷ এখনও পর্যন্ত এই নিয়ে জেলাশাসককে আমরা পাঁচ থেকে ছয়টি চিঠি দিয়েছি ৷ কিন্তু তাঁর তরফে এখনও কোনও আশ্বাস পাইনি ৷ তবে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, তিনি নিজে এই বাণিজ্য শুরু করার পক্ষে ৷ কিন্তু নবান্ন থেকে সবুজ সংকেত না আসা পর্যন্ত আমরা বাণিজ্য শুরু করতে পারছি না ৷ বাণিজ্য বন্ধ থাকায় প্রতিদিন প্রায় আড়াই লাখ ডলার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে দেশের ৷ ব্যবসায় দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় আড়াই কোটি টাকা ৷ এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে একাধিক অনুসারী ব্যবসা ৷ কয়েক লাখ মানুষ এই ব্যবসার উপর নির্ভরশীল ৷ এভাবে যদি চলতে থাকে তবে চুরি-ডাকাতি-সহ অসামাজিক কাজকর্ম বেড়ে যাবে ৷ আমি আপনাদের মাধ্যমে জেলা প্রশাসন সহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সেই বার্তাই দিতে চাই ৷ আবেদন জানাই যেন দ্রুত এই বাণিজ্য চালু করা হয়৷"
মহদিপুরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মূলত সংগঠিত হয় গৌড় ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে ৷ এই অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সমীর ঘোষ বলেন, "এই স্থল বাণিজ্য বন্দর গোটা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম ৷ এই ব্যবসার উপর একাধিক অনুসারী শিল্প নির্ভর করে রয়েছে ৷ প্রত্যক্ষভাবে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় 50 হাজার পরিবহণ শ্রমিক৷ কিন্তু গত 24 মার্চ থেকে পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত কারও মুখে হাসি নেই৷ এই অবস্থায় আমরা প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছি, যেন পণ্য নিয়ে মহদিপুরে এসে আটকে পড়া লরিগুলিকে ওপারে যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হয় ৷ তা না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে ৷ দিনের পর দিন গাড়িগুলি বন্ধ থাকায় পরে সেখান থেকে কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাস বেশিমাত্রায় বের হতে পারে । গাড়ির ব্রেক বিকল হতে পারে । অন্য একাধিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে ৷ তাই এই বাণিজ্য দ্রুত চালু করা হলে শুধু পরিবহণ শ্রমিকদেরই নয়, সবার খাদ্য জুটবে ৷ আমরা ইতিমধ্যে সংগঠনের তরফে বেশ কিছু শ্রমিককে খাদ্যসামগ্রী দিয়েছি ৷ এখনও গাড়ির চালক-সহ অন্য স্থায়ী কর্মীদের বেতন দিয়ে যাচ্ছি ৷ তবে, কতদিন এভাবে শ্রমিকদের টানা সম্ভব হবে তা জানি না৷"
সংগঠনের সভাপতি আবদুল মালেক বলেন, "লকডাউনে শ্রমিকদের পরিস্থিতি সত্যিই খুব খারাপ ৷ মালিকরাও প্রবল সমস্যার মধ্যে রয়েছেন ৷ এই ব্যবসার সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ যুক্ত ৷ হাজার দুয়েক শ্রমিককে আমরা খাদ্যসামগ্রী দিয়েছি ৷ কিন্তু তার বেশি কিছু করতে পারিনি ৷ আমাদেরও আয় বন্ধ হয়ে রয়েছে ৷ এই মুহূর্তে মহদিপুরে প্রায় 5 হাজার লরি এসে আটকে রয়েছে ৷ প্রতিদিন প্রতিটি গাড়ির জন্য 150 টাকা করে পার্কিং ফি লাগে ৷ এখন গাঁটের কড়ি দিয়েই সেই ফি দিতে হচ্ছে ৷ মালিকরা মারা পড়ছেন ৷ এই পরিস্থিতিতে অনেক শ্রমিক ভিক্ষা করে বেঁচে আছেন ৷ আমাদের আর কিছু করার নেই ৷ সম্প্রতি সীমান্তে আটকে পড়া পিঁয়াজ দুটি মালগাড়িতে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে৷ এই পিঁয়াজ যদি মহদিপুর সীমান্ত দিয়ে ওপারে যেত, তবে শ্রমিকরা কিছু পয়সার মুখ দেখতেন৷ কী হবে, জানি না৷"
এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এক শ্রমিক কারিমুল্লা বলেন, "এই ব্যবসার উপর সব মিলিয়ে 3-4 লাখ মানুষ নির্ভর করে আছেন ৷ বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের পরিস্থিতি ভীষণ খারাপ ৷ এই এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ এই ব্যবসায় শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালান ৷ ঘরে খাবার নেই ৷ জমানো টাকাপয়সাও শেষ ৷ সরকারের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাচ্ছি না ৷ না খেয়ে বেঁচে আছি ৷ আমাদের সবকিছুই নির্ভর করে সীমান্তের উপর ৷ এক্সপোর্টাররা কত দেবেন? দু’মাস ধরে বেতন নেই কারও৷ এমনকী, যাঁরা লরির চালক-খালাসি তাঁরাও বেতন পাচ্ছেন না ৷ শুনেছি, 31 তারিখ থেকে নাকি বাণিজ্য চালু হবে৷ না চালু হলে আমাদের সমস্যা আরও বেড়ে যাবে৷"
কোরোনা মোকাবিলায় আপাতত 31 মে পর্যন্ত চতুর্থ দফার লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে ৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, তারপরেই এদেশে কোরোনার গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হতে পারে ৷ তার প্রেক্ষিতে পঞ্চম দফার লকডাউন ঘোষণা করা হবে কি না তা এখনও অজানা ৷ কিন্তু তেমন হলে মহদিপুর সীমান্তে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের ঘরেই যে লকডাউন শুরু হয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না ৷