মালদা, 13 জুলাই : ‘‘বেলা দশটায় জল নিতে এসেছি, এখন দুপুর একটা । এখনও আমার লাইন আসেনি । ভাবছি বাড়ি থেকে কাউকে দুপুরের খাবার আনতে বলব । এখানেই খাওয়া দাওয়া করে রাতে জল নিয়ে বাড়ি ফিরব ৷” এই বক্তব্য কোনও প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দার নয় । এই বক্তব্য এক পৌরনাগরিকের । ইংরেজবাজার পৌরসভা এলাকায় পানীয় জলের কী পরিমাণ সংকট, তা এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট । অভিযোগ, গত 10 বছর ধরে আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল প্রকল্পের কাজ শেষ করে উঠতে পারেনি পৌরসভা কর্তৃপক্ষ । ভোট আসছে আর যাচ্ছে । কিন্তু, পানীয় জল প্রকল্পের কাজ এখনও শেষ হয়নি ইংরেজবাজার পৌরসভা এলাকায় ৷
তবে, এই দুর্দশার মধ্যেও আশার একটা আলো দেখতে শুরু করেছেন ইংরেজবাজার পৌরসভা এলাকার বাসিন্দারা ৷ সম্প্রতি ইংরেজবাজার পৌরসভার দায়িত্ব পেয়েছেন মহকুমা শাসক (সদর) সুরেশচন্দ্র রানো । পৌরসভার দায়িত্ব পেয়েই যেভাবে তিনি পৌরসভার উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তাতে নতুন করে পানীয় জলের সমস্যার সমাধানের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে পৌরসভা এলাকার বাসিন্দারা । প্রশাসকের দাবি, দুর্গা পুজোর আগেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন তাঁরা ।
রাজ্যের প্রাচীন পৌরসভা এলাকার মধ্যে অন্যতম ইংরেজবাজার । দেড়শো বছরের বেশি সময়ের এই ইংরেজবাজার পৌরসভায় মোট 29টি ওয়ার্ড রয়েছে । 2011 সালের জনগণনা অনুযায়ী শহরের জনসংখ্যা 2 লক্ষ 16 হাজার 83 । সেই সংখ্যা এখন তিন লক্ষের বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে । তবে এখনও পর্যন্ত পৌরসভা আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেনি । 2003 সালে পৌরসভা পানীয় জলের প্রকল্প নেয় । কিন্তু সেই উদ্যোগ ফাইলের গেরোয় আটকে যায় ।
আরও পড়ুন : সোনারপুরে পরিশ্রুত পানীয় জল প্রকল্পের উদ্ধোধন লাভলির
তৃণমূল পরিচালিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী ফের সেই প্রকল্প চালু করার উদ্যোগ নেন । অবশেষে 2011 সালে শুরু হয় পরিশ্রুত পানীয় জল প্রকল্পের কাজ । ইংরেজবাজারের নিমাসরাইয়ে তৈরি করা হয় ইনটেক পয়েন্ট । মহানন্দা নদী থেকে জল তুলে, তা পরিশ্রুত করতে পাঠানো হবে পাঁচ কিলোমিটার দূরে দৈবকিপুরে । সেখানে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কাজও প্রায় শেষ । গত দু-তিন বছর ধরে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পাইপলাইন বসানোর কাজ চলছে । কিন্তু সেই কাজ এখনও শেষ হয়ে ওঠেনি । বারবার প্রকল্প দ্রুত চালু করার কথা বলা হলেও, এখনও পরিশ্রুত পানীয় জল থেকে বঞ্চিত পৌরনাগরিকরা । সম্প্রতি ইংরেজবাজার পৌরসভার প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন মহকুমা শাসক (সদর) সুরেশচন্দ্র রানো । বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে পানীয় জল প্রকল্পের কাজ চলছে ।
পৌরসভার পশ্চিম প্রান্তে 25 নম্বর ওয়ার্ড । ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বরাবরই পৌরসভার অন্যান্য এলাকা থেকে পিছিয়ে থাকতে হয় অরবিন্দপার্ক, ঘোড়াপীড়, রায়পাড়া, কুলিপাড়া সহ বেশ কয়েকটি এলাকাকে । পিএইচই (পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট) থেকে আর্সেনিক মুক্ত জলের কয়েকটি কল বসানো হয়েছিল সেখানে । তবে পাইপলাইন কেটে যাওয়ায় গত তিন বছর ধরে বন্ধ সেই জল সরবরাহও । এই পরিস্থিতিতে পানীয় জলের খোঁজে পৌর এলাকার বাইরে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ছুটে যেতে হচ্ছে ওই এলাকার বাসিন্দাদের ৷
আরও পড়ুন : ডোমজুড়ে 38 হাজার পরিবারের জন্য উদ্বোধন হল পানীয় জল প্রকল্প
ঘোড়াপীড় থেকে টোটো ধরে জল আনতে এসেছিলেন হাসি মণ্ডল । তিনি বলেন, “ঘোড়াপীড় থেকে পানীয় জল নিয়ে যেতে এতদূরে এসেছি । গত দুই বছর ধরে এলাকায় পানীয় জলের সরবরাহ নেই । পিএইচই থেকে জলের কল বসানো হয়েছিল ৷ কিন্তু কোথাও পাইপ লাইনের সমস্যা হওয়ায় কয়েকবছর ধরে জল পাচ্ছি না । জলের চাহিদা মেটাতে টোটোতে করে একা একা এতদূর আসতে হচ্ছে । পৌরসভা থেকে আমাদের এলাকায় এখনও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়নি । ভোটের আগে নানান প্রতিশ্রুতি মেলে । ভোট পেরোতেই সব শেষ । এই গরমে প্রবল সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আমাদের । কড়া রোদ মাথায় নিয়ে পানীয় জলের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ।”
একই বক্তব্য ইংরেজবাজার পৌরসভা এলাকার আরেক বাসিন্দা চুমকি চৌধুরীর । তিনি বলেন, “কুলিপাড়া থেকে পানীয় জল নিতে এসেছি । আমাদের ওখানে পানীয় জল পাওয়া যাচ্ছে না । দু-তিন বছর আগে পিএইচই-র পানীয় জলের পাইপ ফেটে গিয়েছিল । সেই সময় থেকে আর আমরা পানীয় জল পাইনি । তখন থেকে জল নিয়ে যেতে সপ্তাহে দু-তিন দিন করে এখানে আসতে হয় । এখানেও প্রতিদিন জল পাওয়া যায় না । অনেকদিন জল না পেয়ে ঘুরে যেতে হয় । ভোটের আগে প্রতিবার নেতারা পানীয় জলের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলেন । কিন্তু ভোট মিটতেই সব ভুলে যান । আমরা চাইছি পৌরসভা থেকে যেন আমাদের এলাকায় জলের ব্যবস্থা করে ।”
আরও পড়ুন : পানীয় জলের দাবিতে পথ অবরোধ পুরুলিয়া শহরে
বুড়াবুড়ি তলার এক বাসিন্দা বিমান কুণ্ডু বলেন, “বেলা দশটায় জল নিতে এসেছি এখন দুপুর একটা বাজে । এখনও আমার লাইন আসেনি । ভাবছি বাড়ি থেকে কাউকে দুপুরের খাবার আনতে বলব । এখানেই খাওয়া দাওয়া করে রাতে জল নিয়ে বাড়ি ফিরব । ওদিকে পানীয় জলের সরবরাহ নেই । পাইপ লাইন কেটে দিয়েছে, না কি করেছে জানা নেই । গরমে জলের প্রচণ্ড কষ্ট । পৌর এলাকায় টাকা ছাড়া জল পাওয়া যায় না । 20 লিটারের জলের জন্য 40 টাকা দিতে হয় । রাজনৈতিক নেতারা আমাদের জন্য এত কিছু করেছে, যে আমাদের পানীয় জলের জন্য গাড়ি ভাড়া দিয়ে এতদূরে আসতে হচ্ছে ।”
আরও পড়ুন : কোচবিহার শহরে দু'টি ওয়ার্ডে পানীয় জল প্রকল্পের সূচনা
মহকুমাশাসক (সদর) তথা ইংরেজবাজার পৌরসভার প্রশাসক সুরেশচন্দ্র রানো বলেন, “পিএইচই থেকে আর্সেনিক মুক্ত জল সাপ্লাই করা হত । সেই জলের প্রেসার কমে গিয়েছে । অনেক জায়গায় পাইপলাইন ফাটিয়ে দিয়ে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে । আমরা সেগুলো চিহ্নিত করছি । জলের প্রেসার বাড়লে সেগুলো চালু হয়ে যাবে । আর পৌরসভার জল প্রকল্প নিয়ে আমার দায়িত্বে আসার সঙ্গে সম্পর্ক নেই । রাজ্য সরকার থেকে নির্দেশ দেওয়া আছে, অবিলম্বে আর্সেনিক মুক্ত জল নাগরিকদের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে । মহানন্দা থেকে জল তুলে পরিশোধন করে তা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে । আমরা পুজোর আগে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি । এখন পর্যন্ত প্রায় 90 শতাংশ কাজ হয়ে গিয়েছে । কিছু এলাকায় ক্রিটিক্যাল গ্যাপ আছে । সেগুলো জুড়ে দিতে পারলেই পরিশ্রুত পানীয়জল ওভারহেড ট্যাঙ্কে তুলে দেওয়া যাবে ৷’’