মালদা, 22 অগাস্ট : বর্ষায় ভরা নদীতেই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার করতে হত ৷ নতুন ব্রিজ আংশিকভাবে খুলে দেওয়ায় আশার আলো দেখেছিলেন ভূতনিচরের বাসিন্দারা ৷ তাঁদের কথায়, "আমাদের ওজন 2 কুইন্টাল থেকে কমে 10 কিলো হয়ে গেছিল ।" কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন সহ্য হয়নি ৷ কথা ছিল, নতুন ব্রিজ উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ এর মাঝে শাসকদলের একপক্ষের ব্রিজ খুলে দেওয়াকে ভালোভাবে নিতে পারেনি অন্য পক্ষ ৷ তাই আংশিকভাবে ব্রিজ খুলে দেওয়ার পরও আবার বন্ধ করে দিতে হয় ৷ দুই গোষ্ঠীর দড়ি টানাটানির মধ্যে সমস্যায় পড়েছেন ভূতনিচরের সাধারণ মানুষ ৷ এখন তাঁদের আবেদন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুখ্যমন্ত্রী এলাকায় এসে যেন ব্রিজ উদ্বোধন করে দেন ৷ তাহলে একটু সুবিধে হয় তাঁদের৷
শুরু থেকেই মানিকচকের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ভূতনিচর । মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ফুলহর নদী । সেই চরে রয়েছে তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত । উত্তর ও দক্ষিণ চণ্ডীপুর এবং হিরানন্দপুর । রয়েছে থানা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র । বসবাস করেন লাখ খানেক মানুষ । 2011 সালে মানিকচক বিধানসভা কেন্দ্র থেকে শাসকদলের বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন সাবিত্রী মিত্র । মূলত তাঁর উদ্যোগেই উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তর মানিকচক ঘাট থেকে চর পর্যন্ত 1700 মিটার দীর্ঘ একটি ব্রিজ অনুমোদন হয় । সেই ব্রিজের 98 শতাংশ কাজ শেষ । বর্ষায় সমস্যার কথা ভেবে 15 অগাস্ট ব্রিজটি আংশিকভাবে চরবাসীদের জন্য খুলে দিয়েছিলেন মালদা জেলাপরিষদের সভাধিপতি গৌরচন্দ্র মণ্ডল । জানিয়েছিলেন, শুধুমাত্র সাইকেল, মোটরবাইক,অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের গাড়ি চলাচলের জন্য ব্রিজের একাংশ খুলে দেওয়া হচ্ছে । মাসখানেকের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন । গৌরবাবুর পৈতৃক বাড়ি ভূতনিচরে । ফলে তিনি জানেন, চরবাসীদের জন্য এই ব্রিজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ । তাঁর এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন চরের বাসিন্দারা ।

কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন সাবিত্রী । তিনি গৌরবাবুর বিরুদ্ধে দলের রাজ্য নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ জানান । সাবিত্রী সংবাদমাধ্যমকে জানান, তাঁর আমলে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তর এই ব্রিজের জন্য 196 কোটি টাকা বরাদ্দ করে । মুখ্যমন্ত্রী এলাকায় এসে এই ব্রিজ নির্মাণের কথা দিয়েছিলেন । হঠাৎ তিনি শুনতে পান, সভাধিপতি ফিতা কেটে ব্রিজের উদ্বোধন করে দিয়েছেন । এনিয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষের সঙ্গে কথাও বলেন তিনি । মন্ত্রীও ব্রিজ উদ্বোধনের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান । জেলা পরিষদের টাকায় এই ব্রিজ হয়নি । আর এটা কোনও কালভার্ট নয় । তাই এই ব্রিজ সভাধিপতি উদ্বোধন করতে পারেন না । আর ব্রিজের কাজ এখনও শেষ হয়নি । এই কাজ করে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন । তাঁর এখন ক্ষমতার গরম হয়েছে । মুখ্যমন্ত্রীই এই ব্রিজ উদ্বোধন করবেন । গৌরবাবু ও সাবিত্রীর কোন্দলে জেলা প্রশাসন ওই ব্রিজের উপর দিয়ে যে কোনও যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে । ফলে কয়েকদিনের স্বস্তি আবার সমস্যায় পরিণত হয়েছে । আজ সেই ব্রিজে গিয়ে দেখা যায়, ব্রিজে ওঠার মুখে বড় গেট বসানো হয়েছে । একটি সাইকেলও ব্রিজে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না । তবে পায়ে হেঁটে অনেকেই ব্রিজ পারাপার করছেন । পাশের ঘাটে চলছে ফেরি নৌকা । যানবাহন নিয়ে সেই নৌকাই এখন আগের মতোই ভরসা চরবাসীদের ।

নৌকায় মোটরবাইক নিয়ে এপারে এসেছিলেন হীরানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাকডুকরা গ্রামের সতীশবাবু । ব্রিজ নিয়ে প্রশ্ন করতেই স্পষ্ট হল হতাশা ৷ তিনি বলেন, "সপ্তাহে 5-6 দিন আমাকে এপারে আসতে হয় । ব্রিজটা আংশিক খুলে দেওয়ায় আমাদের শরীরের ওজন 2 কুইন্টাল থেকে এক ঝটকায় কমে 10 কিলো হয়ে গেছিল । খুব সুবিধে হচ্ছিল । কিন্তু হঠাৎ সেই ব্রিজ দিয়ে চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হল । আবার আগের জায়গায় ফিরে গেলাম আমরা । এখন আবার নদীতে জলও অনেক বেড়ে গেছে । শুনছি, তৃণমূলের একটি গোষ্ঠী ব্রিজ চালু করেছিল । কিন্তু অন্য গোষ্ঠী সেটা বন্ধ করে দিয়েছে । আসলে গৌরবাবু এখন মানিকচকে থাকলেও আদতে তিনি ভূতনিচরের বাসিন্দা । তাই তিনি ভূতনিচরের মানুষজনের দুঃখ বোঝেন । চরবাসীদের স্বার্থে ব্রিজটি আংশিক খুলে দিয়েছিলেন । এখন অন্য গোষ্ঠী থেকে বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী না কি এই ব্রিজ উদ্বোধন করবেন । যাই হোক না কেন, যে ব্রিজ দিয়ে চলাচল বন্ধ করেছেন, তিনি অন্যায় করেছেন । এখন উন্নয়ন নিয়েও তৃণমূলের গ্রুপবাজি চলছে । মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমার বার্তা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি যেন এই ব্রিজ উদ্বোধন করেন ।"
ভূতনি থেকে নৌকায় মানিকচকে আসা দক্ষিণ চণ্ডীপুরের বাসিন্দা সচিন মণ্ডল বলেন, "ব্রিজ চালু হওয়ার পর ফের বন্ধ হয়ে গেছে । সভাধিপতির বিরোধী গোষ্ঠীই ব্রিজ দিয়ে চলাচল বন্ধ করেছে । নৌকায় সাইকেল নিয়ে আমাদের প্রতিদিন 30 টাকা খরচ করে এপার-ওপার করতে হচ্ছে । মোটরবাইক হলে সেই খরচ 50 টাকা । আমিও শুনেছি, মুখ্যমন্ত্রী না কি এই ব্রিজ উদ্বোধন করবেন । তাই ব্রিজ চালু করার পরেও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক সাবিত্রী মিত্রই এই ব্রিজ দিয়ে চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানতে পেরেছি ।" আজ চড়া রোদে প্রায় 2 কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রিজ পেরিয়ে ভূতনি থেকে শংকরটোলা আসছিল নবম শ্রেণির ছাত্রী মৌসুমি রবিদাস । দক্ষিণ চণ্ডীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের 1 নম্বর কলোনির বাসিন্দা সে । তার বক্তব্য, "কয়েকদিন ব্রিজ চালু থাকায় চরের মানুষদের বেশ সুবিধা হচ্ছিল । মানুষের টাকা-পয়সা বাঁচছিল । চড়া রোদ মাথায় নিয়ে হেঁটে ব্রিজ পারাপার করা কষ্টকর । যেভাবে ব্রিজ চালু আর বন্ধ করে দেওয়া হল, সেটা ভালো হল না । এই ব্রিজ নিয়ে আমার আর কোনও আর্জি নেই ।" অন্যদিকে, উত্তর চণ্ডীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের গোবর্ধনটোলার গৃহবধূ অলকা রায় বলেন, "আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এই ব্রিজ । কয়েকদিন আগে ব্রিজটি খুলে দেওয়ায় আমাদের খুব সুবিধা হয়েছিল । তবে এখন আবার ব্রিজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ।"
দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়িত হওয়ায় 15 অগাস্ট যেন নিজেদের স্বাধীনতা পেয়েছিলেন ভূতনিচরের বাসিন্দা । কিন্তু সেই স্বাধীনতা ছিল সাময়িক । তাঁরা চাইছেন, ব্রিজ নিয়ে শাসকদলের গোষ্ঠী রাজনীতি বন্ধ হোক । এতদিন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ভারী বৃষ্টিতে ভরা ফুলহর পারাপার করেছেন । এবার নিশ্চিন্তে নতুন ব্রিজ দিয়ে ফুলহর পেরোতে চান তাঁরা । যদিও ব্রিজ বিতর্ক থেকে আজ নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন গৌরবাবু ও সাবিত্রী । দু'জনের কেউই আজ এনিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি ।