ETV Bharat / state

18 অগাস্ট মালদায় প্রথম উড়েছিল স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা - independence day

পাকিস্তানি পতাকার নীচে দাঙ্গার আবহেই 15 অগাস্ট রাত কাটিয়েছিল মালদাবাসী । 18 অগাস্ট তিরঙ্গা উড়েছিল মালদার আকাশে ।

মালদায় প্রথম উড়েছিল স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা
author img

By

Published : Aug 15, 2019, 6:01 AM IST

মালদা, 15 অগাস্ট : "মালদার ইতিহাসে 15 অগাস্টের স্বাধীনতা দিবসকে একটি ট্র্যাজিক ডে বলা যেতে পারে।" বলছিলেন প্রবীণ তুষারকান্তি ঘোষ । প্রাক্তন শিক্ষক তুষারবাবু মালদা জেলার ইতিহাসের গবেষক হিসাবে পরিচিত । তিনি জানান, মালদা সহ তৎকালীন দিনাজপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলার কিছু অংশ 1947 সালের 15 আগস্ট স্বাধীন হয়নি । গোটা দেশ সেদিন স্বাধীনতার আনন্দে মেতে উঠলেও গৌড়বঙ্গের এই জায়গাগুলিতে সেদিন আকাশে পতপত করছিল চাঁদ-তারা পতাকা । কারণ, তার আগের দিনই স্বাধীনতা পেয়ে গেছিল পাকিস্তান । কয়েকজন ভারতপ্রেমীর চেষ্টা ও সাধারণ মানুষের আবেগ এই এলাকায় প্রকৃত স্বাধীনতা এনেছিল তিন দিন পরে । 18 অগাস্ট মালদা, দিনাজপুর ও মুর্শিদাবাদের একাংশে উড়েছিল তিরঙ্গা । কিন্তু যখন গোটা দেশে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পালিত হচ্ছিল স্বাধীনতা দিবস, তখন গৌড়বঙ্গের এই জায়গাগুলিতে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়েছিল দাঙ্গার পরিবেশে । মালদা জেলায় ঘোষিত হয়েছিল কারফিউ ।

malda
মালদা


ETV ভারতকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তুষারবাবু বলেন, "15 অগাস্ট মালদার ইতিহাসে একটি ট্র্যাজিক ডে বলা যেতে পারে । কারণ, সেদিন মালদা জেলা স্বাধীনতা পায়নি । যখন এখানে লর্ড মাউন্টব্যাটেন এলেন, তখন তিনি ভারত ভাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন । সেই সময় ভারতের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ ভারত ভাগের সেই প্রস্তাব মেনে নেয় । এরপর 1947 সালের 2 জুন কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিতে দেশভাগের প্রস্তাব ঘোষিত হয় । সেই প্রস্তাব গৃহীতও হয়ে যায় । 1946 সালের জনগণনা রিপোর্টের ভিত্তিতে ঠিক হয়, যে এলাকাগুলি মুসলিম অধ্যুষিত, সেই এলাকাগুলি পাকিস্তানে যাবে, বাকি এলাকা ভারতে আসবে । সেই হিসাবে ধরা হয়েছিল, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ পাকিস্তানে চলে যাবে । কিন্তু সেই জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যের সব জেলায় মুসলিম আধিক্য ছিল না । 1941 সালের জনগণনা অনুযায়ী তখন মালদা জেলায় 52.4 শতাংশ মুসলিম ছিল । স্বাভাবিকভাবেই মালদা জেলা যে পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে, সেটা সেখানকার মুসলিমরা অনুমান করেছিল । 1947 সালের 12 অগাস্ট তৎকালীন পাবনার জেলাশাসক মালদায় আসেন । রাজশাহি ডিভিশনাল কমিশনের নির্দেশে তিনি মালদার শাসনভার নিজের হাতে নিয়ে নেন । সেদিনই কার্যত মালদা জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে । সেদিন প্রায় সব গ্রামেই পাকিস্তানের পতাকা ওঠে । কিন্তু, সেই সময় মালদা, দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ জেলার কয়েকটি ব্লকে হিন্দুদের সংখ্যাধিক্য ছিল । সেই এলাকাগুলিকে আলাদা করে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা চলছিল । মালদাতেও সেই চেষ্টা হয় । দেশভাগের মাত্র 15 দিন আগে সিরিল ব়াডক্লিফ ভারতে এসেছিলেন । তিনি নেহরু ও জিন্নাকে ডেকে জানিয়েছিলেন, এত অল্প সময়ে এত বড় দেশ ভাগ করা তাঁর পক্ষে কার্যত অসম্ভব । কেন তাঁরা এত অল্প সময়ের মধ্যে দেশ ভাগ করতে চাইছেন? নেহেরু ও জিন্না, দু'জনেই তাঁকে জানান, এই সময়ের মধ্যেই তাঁকে দেশ ভাগ করতে হবে । তখন রাডক্লিফ 1941 সালের জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী একটি কাঁচি আর একটি লাল পেন্সিল নিয়ে ভারত ভাগ শুরু করেন । এভাবেই মালদা পাকিস্তানে চলে যায় ।"

malda
মালদা জেলা শাসকের কার্যালয়

তুষারবাবু আরও বলেন, "এভাবে মালদা পাকিস্তানে চলে গেলেও জেলা থেকে একটি ডেপুটেশন সিরিল রাডক্লিফের কাছে যায় । সেই ডেপুটেশনে স্বাক্ষর করেছিলেন শিবেন্দুশেখর রায়, বিধুশেখর শাস্ত্রী, স্যার যদুনাথ সরকার, রামহরি রায়ের মতো দিকপাল ব্যক্তিত্বরা । এই ডেপুটেশন কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । তাঁরা রাডক্লিফ কমিশনকে দেখালেন, গোটা মালদা জেলাকে যদি একটি ব্লক হিসাবে দেখা হয়, তবে মালদা জেলা পাকিস্তানে যেতে পারে না । সেটা তারা প্রমাণ করেও দেখালেন । এনিয়ে প্রচুর লড়াই হয় । কিন্তু এব্যাপারে রাডক্লিফ কমিশন কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি । 12 অগাস্ট মালদা জেলা কার্যত পাকিস্তানে চলে গেলেও 14 অগাস্ট পর্যন্ত রাডক্লিফ কমিশনের কোনও সিদ্ধান্ত পাওয়া গেল না । 15 অগাস্ট দেশজুড়ে স্বাধীনতার পতাকা উঠল । কিন্তু মালদায় সেদিনও ছিল পাকিস্তানের পতাকা । স্বাধীনতার আগে মালদার জেলাশাসক ছিলেন জ্ঞান সিং কলহান । যখন পাবনার জেলাশাসক এই জেলার দায়িত্ব নিলেন, তখন জ্ঞান সিং কলহান বিশেষ সুবিধায় ভারতে চলে গেলেন । কারণ, মালদা পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় তিনিও দ্বিধায় ছিলেন । 12 অগাস্ট থেকে মালদায় পাকিস্তানের শাসন চলছিল । মালদাকে ভারতে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য হিন্দুদের পক্ষ থেকে যখন ডেপুটেশন প্রক্রিয়া চলছিল, তখন মুসলিমদের পক্ষ থেকেও এই জেলাকে পাকিস্তানের মধ্যে রাখার প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছিল । তার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আনসার আলি, জিন্নাত হোসেন, আসাদুল্লাহ চৌধুরি, সৈয়দ মিঞারা । তাঁরা চেষ্টা করছিলেন, মুসলিম লিগের দাবি অনুযায়ী মালদা যেন পাকিস্তানেই থাকে । তখন এই জেলায় কয়েকজনের বাড়িতে রেডিও ছিল । মালদার ভাগ্য জানতে সবাই তাঁদের বাড়িতে ভিড় করত । সবাই ভেবেছিল 16 অগাস্ট এনিয়ে কিছু জানা যাবে । কিন্তু সেদিনও কিছু জানানো হল না । চারদিকে দাঙ্গার পরিবেশ । অবশেষে 17 অগাস্ট সন্ধেয় বেশ কয়েকটি জেলা নিয়ে রাডক্লিফ কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করল । তাতে বলা হল, মালদার 5 টি থানা, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট, চাঁপাই নবাবগঞ্জ ও শিবগঞ্জ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় তা পূর্ব পাকিস্তানের যুক্ত হল । বাকি 10টি ব্লক হিন্দু বেঙ্গল অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হল । দিনাজপুরও একইভাবে ভাগ হল । নদীর ধারা অনুযায়ী সীমানা চিহ্নিত হল । একইভাবে মুর্শিদাবাদ সহ আরো কিছু জায়গা হিন্দু বেঙ্গলে চলে এল । সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হতেই একদিকে যেমন হিন্দুদের মধ্যে উন্মাদনা দেখা দিল, অন্যদিকে মুসলিমদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হল । চারদিকে তখন চরম উত্তেজনা । ঠিক হয়েছিল 18 অগাস্ট এই জায়গাগুলিতে স্বাধীনতা দিবস পালিত হবে । সেদিন সকালে জেলাবাসী মালদার জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে ভিড় জমায় । এদিকে রাডক্লিফ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হতেই পাবনার জেলাশাসক মালদা ছেড়ে চলে গেছিলেন । জেলায় তখন কোনও জেলাশাসক নেই । শুধুমাত্র ছিলেন মহকুমাশাসক অবনী কুশারি । তাঁর নেতৃত্বে ঠিক হয়, জেলা প্রশাসনিক ভবন থেকে পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে ভারতীয় তিরঙ্গা তোলা হবে । সেই সময় জেলা প্রশাসনিক ভবনে কিছু মুসলিম রক্ষী ছিল । তার মধ্যে একজনের নাম ছিল হামিদ হোসেন । তার হাতে ছিল রাইফেল । সে হঠাৎ চিৎকার করে বলতে শুরু করে, যে পাকিস্তানের পতাকা নামাবে, তাকে সে গুলি করে খুন করবে । এনিয়ে সেখানে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে । তখন অবনী কুশারি দক্ষ হাতে পরিস্থিতি সামাল দেন । গোর্খা সৈন্যরা জেলা প্রশাসনিক ভবনে চলে আসে । তারা প্রশাসনিক ভবনের সব রক্ষীকে গাড়িতে তুলে পুলিশ লাইন নিয়ে যায় । সেই সময় মালদা জেলায় ছিলেন পাটনার অতিরিক্ত জেলাশাসক মঙ্গল আচার্য । সবার আবেদনে সাড়া দিয়ে তিনিই প্রশাসনিক ভবনের মাস্তুল থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেন । এরপর জেলা প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে একটি বিশাল মিছিল বের হয় । সেই মিছিল শহর পরিক্রমা শুরু করে । কিন্তু মুসলিম ইনস্টিটিউটের সামনে মিছিলের পথ আটকায় আসাদুল্লাহ চৌধুরি, জিন্নাত হোসেন প্রমুখদের নেতৃত্বে কিছু লোক । তারা সাফ জানিয়ে দেয়, এই স্বাধীনতা দিবস তারা পালন করতে দেবে না । মিছিলও যেতে দেবে না । সেখানে ইট-বোমা ছোড়া শুরু হয় । জখম হন খোদ মহকুমাশাসক । সেই অবস্থাতেই তিনি গোটা জেলায় কারফিউ জারি করে দেন । মহকুমাশাসক নিজে একটি ট্রাকে উঠে সেকথা ঘোষণা করতে থাকেন । মুহূর্তের মধ্যে গোটা জেলা স্তব্ধ হয়ে যায় । স্বাধীনতার মিছিল অসম্পূর্ণ থেকে যায় । জেলাবাসী দাঙ্গার আবহে রাত কাটান । পরবর্তীতে অশোক মিত্র এখানে জেলাশাসক হয়ে আসেন । ততদিন প্রশাসনিক ভবনে ভারতের জাতীয় পতাকা উড়লেও গ্রামেগঞ্জে তখনও পাকিস্তানের পতাকাই উড়ছিল । অশোকবাবুই বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পাকিস্তানের পতাকা নামান ।"

malda
মালদা জেলা শাসকের কার্যালয়


তুষারবাবুর মতে, "মালদার স্বাধীনতার ইতিহাসের মধ্যে যেমন একটি বিষন্নতা রয়েছে ও উদ্বেগ রয়েছে, তেমনি স্বাধীনতা লাভের জন্য জেলাবাসীর আগ্রহ ও আনন্দও রয়েছে । তবে এখন আর 18 অগাস্ট নয়, গোটা দেশের সঙ্গে 15 অগাস্টই জেলার স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয় । যদিও কিছু কিছু সংগঠন জেলার স্বাধীনতার ইতিহাস মনে রাখার জন্য 18 অগাস্ট ছোটো মাপে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান পালন করে থাকে ।"

মালদা, 15 অগাস্ট : "মালদার ইতিহাসে 15 অগাস্টের স্বাধীনতা দিবসকে একটি ট্র্যাজিক ডে বলা যেতে পারে।" বলছিলেন প্রবীণ তুষারকান্তি ঘোষ । প্রাক্তন শিক্ষক তুষারবাবু মালদা জেলার ইতিহাসের গবেষক হিসাবে পরিচিত । তিনি জানান, মালদা সহ তৎকালীন দিনাজপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলার কিছু অংশ 1947 সালের 15 আগস্ট স্বাধীন হয়নি । গোটা দেশ সেদিন স্বাধীনতার আনন্দে মেতে উঠলেও গৌড়বঙ্গের এই জায়গাগুলিতে সেদিন আকাশে পতপত করছিল চাঁদ-তারা পতাকা । কারণ, তার আগের দিনই স্বাধীনতা পেয়ে গেছিল পাকিস্তান । কয়েকজন ভারতপ্রেমীর চেষ্টা ও সাধারণ মানুষের আবেগ এই এলাকায় প্রকৃত স্বাধীনতা এনেছিল তিন দিন পরে । 18 অগাস্ট মালদা, দিনাজপুর ও মুর্শিদাবাদের একাংশে উড়েছিল তিরঙ্গা । কিন্তু যখন গোটা দেশে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পালিত হচ্ছিল স্বাধীনতা দিবস, তখন গৌড়বঙ্গের এই জায়গাগুলিতে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়েছিল দাঙ্গার পরিবেশে । মালদা জেলায় ঘোষিত হয়েছিল কারফিউ ।

malda
মালদা


ETV ভারতকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তুষারবাবু বলেন, "15 অগাস্ট মালদার ইতিহাসে একটি ট্র্যাজিক ডে বলা যেতে পারে । কারণ, সেদিন মালদা জেলা স্বাধীনতা পায়নি । যখন এখানে লর্ড মাউন্টব্যাটেন এলেন, তখন তিনি ভারত ভাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন । সেই সময় ভারতের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ ভারত ভাগের সেই প্রস্তাব মেনে নেয় । এরপর 1947 সালের 2 জুন কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিতে দেশভাগের প্রস্তাব ঘোষিত হয় । সেই প্রস্তাব গৃহীতও হয়ে যায় । 1946 সালের জনগণনা রিপোর্টের ভিত্তিতে ঠিক হয়, যে এলাকাগুলি মুসলিম অধ্যুষিত, সেই এলাকাগুলি পাকিস্তানে যাবে, বাকি এলাকা ভারতে আসবে । সেই হিসাবে ধরা হয়েছিল, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ পাকিস্তানে চলে যাবে । কিন্তু সেই জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যের সব জেলায় মুসলিম আধিক্য ছিল না । 1941 সালের জনগণনা অনুযায়ী তখন মালদা জেলায় 52.4 শতাংশ মুসলিম ছিল । স্বাভাবিকভাবেই মালদা জেলা যে পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে, সেটা সেখানকার মুসলিমরা অনুমান করেছিল । 1947 সালের 12 অগাস্ট তৎকালীন পাবনার জেলাশাসক মালদায় আসেন । রাজশাহি ডিভিশনাল কমিশনের নির্দেশে তিনি মালদার শাসনভার নিজের হাতে নিয়ে নেন । সেদিনই কার্যত মালদা জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে । সেদিন প্রায় সব গ্রামেই পাকিস্তানের পতাকা ওঠে । কিন্তু, সেই সময় মালদা, দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ জেলার কয়েকটি ব্লকে হিন্দুদের সংখ্যাধিক্য ছিল । সেই এলাকাগুলিকে আলাদা করে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা চলছিল । মালদাতেও সেই চেষ্টা হয় । দেশভাগের মাত্র 15 দিন আগে সিরিল ব়াডক্লিফ ভারতে এসেছিলেন । তিনি নেহরু ও জিন্নাকে ডেকে জানিয়েছিলেন, এত অল্প সময়ে এত বড় দেশ ভাগ করা তাঁর পক্ষে কার্যত অসম্ভব । কেন তাঁরা এত অল্প সময়ের মধ্যে দেশ ভাগ করতে চাইছেন? নেহেরু ও জিন্না, দু'জনেই তাঁকে জানান, এই সময়ের মধ্যেই তাঁকে দেশ ভাগ করতে হবে । তখন রাডক্লিফ 1941 সালের জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী একটি কাঁচি আর একটি লাল পেন্সিল নিয়ে ভারত ভাগ শুরু করেন । এভাবেই মালদা পাকিস্তানে চলে যায় ।"

malda
মালদা জেলা শাসকের কার্যালয়

তুষারবাবু আরও বলেন, "এভাবে মালদা পাকিস্তানে চলে গেলেও জেলা থেকে একটি ডেপুটেশন সিরিল রাডক্লিফের কাছে যায় । সেই ডেপুটেশনে স্বাক্ষর করেছিলেন শিবেন্দুশেখর রায়, বিধুশেখর শাস্ত্রী, স্যার যদুনাথ সরকার, রামহরি রায়ের মতো দিকপাল ব্যক্তিত্বরা । এই ডেপুটেশন কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । তাঁরা রাডক্লিফ কমিশনকে দেখালেন, গোটা মালদা জেলাকে যদি একটি ব্লক হিসাবে দেখা হয়, তবে মালদা জেলা পাকিস্তানে যেতে পারে না । সেটা তারা প্রমাণ করেও দেখালেন । এনিয়ে প্রচুর লড়াই হয় । কিন্তু এব্যাপারে রাডক্লিফ কমিশন কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি । 12 অগাস্ট মালদা জেলা কার্যত পাকিস্তানে চলে গেলেও 14 অগাস্ট পর্যন্ত রাডক্লিফ কমিশনের কোনও সিদ্ধান্ত পাওয়া গেল না । 15 অগাস্ট দেশজুড়ে স্বাধীনতার পতাকা উঠল । কিন্তু মালদায় সেদিনও ছিল পাকিস্তানের পতাকা । স্বাধীনতার আগে মালদার জেলাশাসক ছিলেন জ্ঞান সিং কলহান । যখন পাবনার জেলাশাসক এই জেলার দায়িত্ব নিলেন, তখন জ্ঞান সিং কলহান বিশেষ সুবিধায় ভারতে চলে গেলেন । কারণ, মালদা পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় তিনিও দ্বিধায় ছিলেন । 12 অগাস্ট থেকে মালদায় পাকিস্তানের শাসন চলছিল । মালদাকে ভারতে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য হিন্দুদের পক্ষ থেকে যখন ডেপুটেশন প্রক্রিয়া চলছিল, তখন মুসলিমদের পক্ষ থেকেও এই জেলাকে পাকিস্তানের মধ্যে রাখার প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছিল । তার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আনসার আলি, জিন্নাত হোসেন, আসাদুল্লাহ চৌধুরি, সৈয়দ মিঞারা । তাঁরা চেষ্টা করছিলেন, মুসলিম লিগের দাবি অনুযায়ী মালদা যেন পাকিস্তানেই থাকে । তখন এই জেলায় কয়েকজনের বাড়িতে রেডিও ছিল । মালদার ভাগ্য জানতে সবাই তাঁদের বাড়িতে ভিড় করত । সবাই ভেবেছিল 16 অগাস্ট এনিয়ে কিছু জানা যাবে । কিন্তু সেদিনও কিছু জানানো হল না । চারদিকে দাঙ্গার পরিবেশ । অবশেষে 17 অগাস্ট সন্ধেয় বেশ কয়েকটি জেলা নিয়ে রাডক্লিফ কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করল । তাতে বলা হল, মালদার 5 টি থানা, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট, চাঁপাই নবাবগঞ্জ ও শিবগঞ্জ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় তা পূর্ব পাকিস্তানের যুক্ত হল । বাকি 10টি ব্লক হিন্দু বেঙ্গল অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হল । দিনাজপুরও একইভাবে ভাগ হল । নদীর ধারা অনুযায়ী সীমানা চিহ্নিত হল । একইভাবে মুর্শিদাবাদ সহ আরো কিছু জায়গা হিন্দু বেঙ্গলে চলে এল । সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হতেই একদিকে যেমন হিন্দুদের মধ্যে উন্মাদনা দেখা দিল, অন্যদিকে মুসলিমদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হল । চারদিকে তখন চরম উত্তেজনা । ঠিক হয়েছিল 18 অগাস্ট এই জায়গাগুলিতে স্বাধীনতা দিবস পালিত হবে । সেদিন সকালে জেলাবাসী মালদার জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে ভিড় জমায় । এদিকে রাডক্লিফ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হতেই পাবনার জেলাশাসক মালদা ছেড়ে চলে গেছিলেন । জেলায় তখন কোনও জেলাশাসক নেই । শুধুমাত্র ছিলেন মহকুমাশাসক অবনী কুশারি । তাঁর নেতৃত্বে ঠিক হয়, জেলা প্রশাসনিক ভবন থেকে পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে ভারতীয় তিরঙ্গা তোলা হবে । সেই সময় জেলা প্রশাসনিক ভবনে কিছু মুসলিম রক্ষী ছিল । তার মধ্যে একজনের নাম ছিল হামিদ হোসেন । তার হাতে ছিল রাইফেল । সে হঠাৎ চিৎকার করে বলতে শুরু করে, যে পাকিস্তানের পতাকা নামাবে, তাকে সে গুলি করে খুন করবে । এনিয়ে সেখানে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে । তখন অবনী কুশারি দক্ষ হাতে পরিস্থিতি সামাল দেন । গোর্খা সৈন্যরা জেলা প্রশাসনিক ভবনে চলে আসে । তারা প্রশাসনিক ভবনের সব রক্ষীকে গাড়িতে তুলে পুলিশ লাইন নিয়ে যায় । সেই সময় মালদা জেলায় ছিলেন পাটনার অতিরিক্ত জেলাশাসক মঙ্গল আচার্য । সবার আবেদনে সাড়া দিয়ে তিনিই প্রশাসনিক ভবনের মাস্তুল থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেন । এরপর জেলা প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে একটি বিশাল মিছিল বের হয় । সেই মিছিল শহর পরিক্রমা শুরু করে । কিন্তু মুসলিম ইনস্টিটিউটের সামনে মিছিলের পথ আটকায় আসাদুল্লাহ চৌধুরি, জিন্নাত হোসেন প্রমুখদের নেতৃত্বে কিছু লোক । তারা সাফ জানিয়ে দেয়, এই স্বাধীনতা দিবস তারা পালন করতে দেবে না । মিছিলও যেতে দেবে না । সেখানে ইট-বোমা ছোড়া শুরু হয় । জখম হন খোদ মহকুমাশাসক । সেই অবস্থাতেই তিনি গোটা জেলায় কারফিউ জারি করে দেন । মহকুমাশাসক নিজে একটি ট্রাকে উঠে সেকথা ঘোষণা করতে থাকেন । মুহূর্তের মধ্যে গোটা জেলা স্তব্ধ হয়ে যায় । স্বাধীনতার মিছিল অসম্পূর্ণ থেকে যায় । জেলাবাসী দাঙ্গার আবহে রাত কাটান । পরবর্তীতে অশোক মিত্র এখানে জেলাশাসক হয়ে আসেন । ততদিন প্রশাসনিক ভবনে ভারতের জাতীয় পতাকা উড়লেও গ্রামেগঞ্জে তখনও পাকিস্তানের পতাকাই উড়ছিল । অশোকবাবুই বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পাকিস্তানের পতাকা নামান ।"

malda
মালদা জেলা শাসকের কার্যালয়


তুষারবাবুর মতে, "মালদার স্বাধীনতার ইতিহাসের মধ্যে যেমন একটি বিষন্নতা রয়েছে ও উদ্বেগ রয়েছে, তেমনি স্বাধীনতা লাভের জন্য জেলাবাসীর আগ্রহ ও আনন্দও রয়েছে । তবে এখন আর 18 অগাস্ট নয়, গোটা দেশের সঙ্গে 15 অগাস্টই জেলার স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয় । যদিও কিছু কিছু সংগঠন জেলার স্বাধীনতার ইতিহাস মনে রাখার জন্য 18 অগাস্ট ছোটো মাপে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান পালন করে থাকে ।"

Intro:মালদা, 14 অগাস্ট : "মালদার ইতিহাসে 15 অগাস্টের স্বাধীনতা দিবস একটি ট্র্যাজিক ডে বলা যেতে পারে।" বলছিলেন প্রবীণ তুষারকান্তি ঘোষ। প্রাক্তন শিক্ষক তুষারবাবু মালদা জেলার ইতিহাস গবেষক হিসাবে পরিচিত। তিনি জানান, মালদা সহ তৎকালীন দিনাজপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলার কিছু অংশ 1947 সালের 15 আগস্ট স্বাধীন হয়নি। গোটা দেশ সেদিন স্বাধীনতার আনন্দে মেতে উঠলেও গৌড়বঙ্গের এই জায়গাগুলিতে সেদিন আকাশে পতপত করছিল চাঁদ-তারা পতাকা। কারণ, তার আগের দিনই স্বাধীনতা পেয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান। কয়েকজন ভারতপ্রেমীর চেষ্টা ও সাধারণ মানুষের আবেগ এই এলাকায় প্রকৃত স্বাধীনতা এনেছিল তিন দিন পরে। 18 অগাস্ট মালদা, দিনাজপুর ও মুর্শিদাবাদের একাংশে উড়েছিল তিরঙ্গা। কিন্তু যখন গোটা দেশে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পালিত হচ্ছিল স্বাধীনতা দিবস, তখন গৌড়বঙ্গের এই জায়গাগুলিতে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়েছিল দাঙ্গার পরিবেশে। মালদা জেলায় ঘোষিত হয়েছিল কার্ফিউ।


Body:ইটিভি ভারতকে একান্ত সাক্ষাৎকারে তুষারবাবু বলেন, "15 অগাস্ট মালদার ইতিহাসে একটি ট্র্যাজিক ডে বলা যেতে পারে। কারণ, সেদিন মালদা জেলা স্বাধীনতা পায়নি। যখন এখানে লর্ড মাউন্টব্যাটেন এলেন, তখন তিনি ভারত ভাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই সময় ভারতের তদানীন্তন নেতৃবৃন্দ ভারত ভাগের সেই প্রস্তাব মেনে নেয়। এরপর 1947 সালের 2 জুন কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিতে দেশভাগের প্রস্তাব ঘোষিত হয়। সেই প্রস্তাব গৃহীতও হয়ে যায়। ঠিক তার একদিন পর, সে'বছরের 3 জুন, 1946 সালের জনসুমারি রিপোর্টের ভিত্তিতে ঠিক হল, যে এলাকাগুলি মুসলিম অধ্যুষিত, সেই এলাকাগুলি পাকিস্তানে যাবে, বাকি এলাকা ভারতে আসবে। সেই হিসাবে ধরা হয়েছিল, গোটা পশ্চিমবঙ্গই পাকিস্তানে চলে যাবে। কিন্তু সেই জনসুমারি অনুযায়ী, সব জেলায় মুসলিম আধিক্য ছিল না। তবে 1941 সালের জনসুমারি অনুযায়ী তখন মালদা জেলায় 52.4 শতাংশ মুসলিম মানুষ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই মালদা জেলা যে পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে, সেটা এখানকার মুসলিম সমাজও বুঝতে পেরেছিল। এই প্রেক্ষিতে তখনও দেশভাগের প্রস্তাবের বিস্তারিত কিছু আলোচনা না হলেও 1947 সালের 12 অগাস্ট তৎকালীন পাবনার জেলাশাসক এখানে আসেন। রাজশাহি ডিভিশনাল কমিশনের নির্দেশে তিনি মালদা শাসনভার নিজের হাতে নিয়ে নেন। সেদিনই কার্যত মালদা জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে। সেদিন প্রায় সব গ্রামেই পাকিস্তানের পতাকা উঠে যায়। কিন্তু সেই সময় মালদা, দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদের মতো জায়গায় কিছু ব্লকে হিন্দুদের সংখ্যাধিক্য ছিল। সেই এলাকাগুলিকে ভাগ করে সেগুলিকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার একটা প্রচেষ্টা চলছিল। মালদাতেও সেই প্রচেষ্টা চলছিল। কমিশনার হিসাবে দেশকে ভাগ করার জন্য এখানে যখন সিরিল রাডক্লিফ এলেন, তখন দেশভাগের জন্য তাঁর হাতে সময় ছিল মাত্র 15 দিন। তিনি নেহরু ও জিন্নাকে ডেকে জানিয়েছিলেন, এই অল্প সময়ে এত বড় দেশ ভাগ করার কাজ তাঁর পক্ষে কার্যত অসম্ভব। কেন তাঁরা এত অল্প সময়ের মধ্যে দেশ ভাগ করতে চাইছেন? যদিও নেহেরু ও জিন্না, দুজনেই তাঁকে জানান, এই সময়ের মধ্যেই তাঁকে দেশ ভাগ করতে হবে। তখন রাডক্লিফ 1941 সালের জনসুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী একটি কাঁচি, আর একটি লাল পেন্সিল নিয়ে ভারত ভাগ শুরু করেন। এভাবেই মালদা পাকিস্তানে চলে যায়।"
তুষারবাবু বলেন, "এভাবে মালদা পাকিস্তানে চলে গেলেও জেলা থেকে একটি ডেপুটেশন সিরিল রাডক্লিফের কাছে যায়। সেই ডেপুটেশনে স্বাক্ষর করেছিলেন শিবেন্দুশেখর রায়, বিধুশেখর শাস্ত্রী, স্যার যদুনাথ সরকার, রামহরি রায়ের মতো দিকপাল ব্যক্তিত্বরা। এই ডেপুটেশন কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁরা রাডক্লিফ কমিশনকে দেখালেন, গোটা মালদা জেলাকে যদি একটি ব্লক হিসাবে দেখা হয়, তবে মালদা জেলা পাকিস্তানে যেতে পারে না। সেটা তারা প্রমাণ করেও দেখালেন। এনিয়ে প্রচুর লড়াই হয়। এব্যাপারে রাডক্লিফ কমশন কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। 12 অগাস্ট মালদা জেলা কার্যত পাকিস্তানে চলে গেলেও 14 অগাস্ট পর্যন্ত রাডক্লিফ কমিশনের কোনও সিদ্ধান্ত পাওয়া গেল না। 15 অগাস্ট দেশজুড়ে স্বাধীনতার পতাকা উঠল। কিন্তু মালদায় সেদিনও ছিল পাকিস্তানের পতাকা। সেই সময় মালদার জেলাশাসক ছিলেন জ্ঞান সিং কলহান। যখন পাবনার জেলাশাসক এই জেলার দায়িত্ব নিলেন, তখন জ্ঞান সিং কলহান বিশেষ সুবিধায় ভারতে চলে গেলেন। কারণ, মালদা পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় তিনিও দ্বিধায় ছিলেন। 12 অগাস্ট থেকে মালদায় পাকিস্তানের শাসন চলছিল। মালদাকে ভারতে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য হিন্দুদের পক্ষ থেকে যখন ডেপুটেশন প্রক্রিয়া চলছিল, তখন মুসলিমদের পক্ষ থেকেও এই জেলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করতে একই প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছিল। তার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আনসার আলি, জিন্নাত হোসেন, আসাদুল্লাহ চৌধুরি, সৈয়দ মিযারা। তাঁরা চেষ্টা করছিলেন, মুসলিম লিগের দাবি অনুযায়ী মালদা যেন পাকিস্তানেই থাকে। তখন এই জেলায় কয়েকজনের বাড়িতে রেডিও ছিল। মালদার ভাগ্য জানতে সবাই তাঁদের বাড়িতে হামলে পড়ত। সবাই ভেবেছিল 16 আগস্ট এনিয়ে কিছু জানা যাবে। কিন্তু সেদিনও কিছু জানানো হল না। চারদিকে দাঙ্গার পরিবেশ। অবশেষে 17 অগাস্ট সন্ধেয় বেশ কয়েকটি জেলা নিয়ে রাডক্লিফ কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করল। তাতে বলা হল, মালদার 5 টি থানা, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট, চাঁপাই নবাবগঞ্জ ও শিবগঞ্জ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় তা পূর্ব পাকিস্তানের যুক্ত হল। বাকি 10টি ব্লক হিন্দু বেঙ্গল অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হল। দিনাজপুরও একইভাবে ভাগ হল। নদীর ধারা অনুযায়ী সীমানা চিহ্নিত হল। একইভাবে মুর্শিদাবাদ সহ আরো কিছু জায়গা হিন্দু বেঙ্গলে চলে এল। সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হতেই একদিকে যেমন হিন্দুদের মধ্যে উন্মাদনা দেখা দিল, অন্যদিকে মুসলিমদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হল। চারদিকে তখন চরম উত্তেজনা। ঠিক হয়েছিল 18 অগাস্ট এই জায়গাগুলিতে স্বাধীনতা দিবস পালিত হবে। সেদিন সকালে জেলাবাসী মালদার জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে ভিড় জমায়। এদিকে রাডক্লিফ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হতেই পাবনার জেলাশাসক মালদা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। জেলায় তখন কোনও জেলাশাসক নেই। শুধুমাত্র ছিলেন মহকুমাশাসক অবনী কুশারি। তাঁর নেতৃত্বে ঠিক হয়, জেলা প্রশাসনিক ভবন থেকে পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে ভারতীয় তিরঙ্গা তোলা হবে। সেই সময় জেলা প্রশাসনিক ভবনে কিছু মুসলিম রক্ষী ছিল। তার মধ্যে একজনের নাম ছিল হামিদ হোসেন। তার হাতে ছিল রাইফেল। সে হঠাৎ চিৎকার করে বলতে শুরু করে, যে পাকিস্তানের পতাকা নামাবে, তাকে সে গুলি করে খুন করবে। এনিয়ে সেখানে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তখন অবনী কুশারি দক্ষ হাতে পরিস্থিতি সামাল দেন। গোর্খা সৈন্যরা জেলা প্রশাসনিক ভবনে চলে আসে। তারা প্রশাসনিক ভবনের সব রক্ষীকে গাড়িতে তুলে পুলিশ লাইন নিয়ে যায়। সেই সময় মালদা জেলায় ছিলেন পাটনার অতিরিক্ত জেলাশাসক মঙ্গল আচার্য। সবার আবেদনে সাড়া দিয়ে তিনিই প্রশাসনিক ভবনের মাস্তুল থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ভারতীয় তিরঙ্গা উত্তোলন করেন। চারিদিকে উচ্ছাস ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে একটি বিশাল মিছিল বের হয়। সেই মিছিল শহর পরিক্রমা শুরু করে। কিন্তু মুসলিম ইনস্টিটিউটের সামনে মিছিলের পথ আটকায় আসাদুল্লাহ চৌধুরি, জিন্নাত হোসেন প্রমুখদের নেতৃত্বে মুসলিম সমাজ। তারা সাফ জানিয়ে দেয়, এই স্বাধীনতা দিবস তারা পালন করতে দেবে না। মিছিলও যেতে দেবে না। সেখানে ইট-বোমা ছোড়া শুরু হয়ে যায়। আহত হন খোদ মহকুমাশাসক। সেই অবস্থাতেই তিনি গোটা জেলায় কারফিউ জারি করে দেন। তিনি নিজে একটি ট্রাকে উঠে সেকথা ঘোষণা করতে থাকেন। মুহূর্তের মধ্যে গোটা জেলা স্তব্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার মিছিল অসম্পূর্ণ থেকে যায়। জেলাবাসী দাঙ্গার আবহে রাত কাটান। পরবর্তীতে অশোক মিত্র এখানে জেলাশাসক হয়ে আসেন। ততদিন প্রশাসনিক ভবনে ভারতের জাতীয় পতাকা উড়লেও গ্রামেগঞ্জে তখনও পাকিস্তানের পতাকাই উড়ছিল। অশোকবাবুই বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন উপায়ে পাকিস্তানের পতাকা নামান।"


Conclusion:তুষারবাবুর মতে, মালদার স্বাধীনতার ইতিহাসের মধ্যে যেমন একটি বিষন্নতা রয়েছে, উদ্বেগ রয়েছে, তেমনই স্বাধীনতা লাভের জন্য জেলাবাসীর আগ্রহ ও আনন্দও লুকিয়ে রয়েছে। তবে এখন আর 18 অগাস্ট নয়, গোটা দেশের সঙ্গে 15 অগাস্টই জেলার স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়। যদিও কিছু কিছু সংগঠন জেলার স্বাধীনতার ইতিহাস মনে রাখার জন্য 18 অগাস্ট ছোটো করে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।

For All Latest Updates

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.