মালদা, 11 এপ্রিল : লকডাউন কোমর ভেঙে দিয়েছে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির ৷ ঘরবন্দী হয়ে জীবন বাঁচানোর রসদ হয়ত মিলছে, কিন্তু পেট চালানোর রসদ নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে এই পরিবারগুলির ৷ পরিবারের সবার অন্ন সংস্থান করতে ঘুম উড়েছে অটো ও টোটোচালকদের ৷ গোটা জেলায় অটোর সংখ্যা প্রায় 1400 ৷ জেলায় টোটো চলে প্রায় 13 হাজার ৷ দু’সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্ধ তাদের সবার রোজগার ৷ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেকে আবার পেশাটাকেই বদলে ফেলেছে ৷ টোটোচালক থেকে পরিণত হয়েছে সবজিওয়ালায় ৷ কতদিন এই পরিস্থিতি থাকবে কেউ জানে না ৷ লকডাউনে অটো ও টোটোচালকদের যে নাভিশ্বাস উঠেছে তা মেনে নিচ্ছে পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনগুলিও ৷
কোরোনা যে গোটা পৃথিবীর অর্থ ব্যবস্থায় ভয়ঙ্কর ও সুদূরপ্রসারী আঘাত হানতে চলেছে তা নিয়ে নিশ্চিত অর্থনীতিবিদরা ৷ তাঁদের আশঙ্কা, কোরোনার আগ্রাসী ভূমিকা তিলে তিলে খাদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে গোটা পৃথিবীর অর্থনীতিকে ৷ আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এর প্রভাব হবে মারাত্মক ৷ দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ ৷ এখন থেকেই তার ছায়া যেন দেখতে পাচ্ছে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি ৷ সরকার কিংবা বিভিন্ন সংগঠন হয়ত এই মুহূর্তে তাদের কাছে কিছু ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে ৷ কিন্তু সেটা কতদিন? তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে এই মানুষগুলির মনে ৷ সেই তালিকায় রয়েছে অটো ও টোটোওয়ালারাও ৷ 25 মার্চ থেকে লকডাউনে বন্ধ যাত্রী পরিবহণ ব্যবস্থা ৷ সরকারি নির্দেশিকা উপেক্ষা করে কেউ কেউ অটো কিংবা টোটো রাস্তায় নামানোর চেষ্টা করেছিল বটে, তবে পুলিশের রক্তচক্ষু আর লাঠি তাদের ফের ঘরে সিঁধিয়ে দিয়েছে ৷ রোজগারের অভাবে এখন অনেকের ঘরেই দু’বেলা হাঁড়ি চড়ছে না ৷ অনেকে আবার পরিস্থিতি মোকাবিলায় পেশাটাকেই পালটে ফেলেছে ৷
মালদা শহরের অলিগলিতে নিজের টোটোয় সবজির ডালা নিয়ে ঘুরছিলেন শহরের হায়দারপুর ঘোষপাড়ার বাসিন্দা বকুল দাস ৷ তিনি বলেন, “সবজি বিক্রি করা আমার পেশা নয় ৷ আমি টোটো চালাতাম ৷ কিন্তু লকডাউন ঘোষণার পর থেকে আমরা দুই ভাই মিলে নিজেদের টোটোতে পাড়ায় পাড়ায় সবজি বিক্রি করছি ৷ সংসারটা তো চালাতে হবে ! রোজগার না থাকলে খাব কী? তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ৷ সবজি বিক্রির আয়েই এখন সংসার চলছে ৷ দিনে শ’পাঁচেক টাকা রোজগার হয়ে যায় ৷ আগে টোটো চালিয়ে সারা দিনে 600-700 টাকা উপার্জন হত ৷ এখন রোজগার কিছুটা কম হলেও খাবার তো জুটছে ৷ পেট চালানোর জন্য আমাদের পেশাটাই বদলে ফেলতে হয়েছে ৷ আগে বেঁচে থাকা, তারপর পুরানো পেশাকে টেনে নিয়ে যাওয়া ৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আর পুরানো পেশায় ফিরছি না৷” বকুলবাবু পেশা বদলে সংসারের চাকাটাকে তবু গড়িয়ে নিয়ে যেতে পারছেন৷ কিন্তু আরও বড় সমস্যায় পড়েছে অটোওয়ালারা৷ টোটোতে সবজি বিক্রি করা সম্ভব৷ কিন্তু অটোতে তা সম্ভব নয়৷ তাই অটোওয়ালারা এখন উপরওয়ালার কাছে আর্জি জানানো ছাড়া আর কিছু করতে পারছে না৷ এমনই এক অটোওয়ালা, মঙ্গলবাড়ি খয়রাতিপাড়ার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, “পরিস্থিতি খুব শোচনীয়৷ আমাদের অবস্থা একেবারেই ভালো নয়৷ এতদিন ধরে লকডাউন চলছে৷ গাড়িঘোড়া সব বন্ধ ৷ এর উপর ভিত্তি করেই আমাদের সংসার চলে৷ এই অবস্থায় সরকারও আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখে না৷ ঘরে চাল-ডালও নেই ৷ প্রশাসন আমাদের জন্য কোনও ব্যবস্থা নেয়নি৷ লকডাউনে অটো রাস্তায় বের করলে পুলিশের লাঠি খেতে হয়৷ দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না ৷ এতদিন ধরে গাড়ি বসে রয়েছে৷ অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ লকডাউন উঠে গেলে আগে গ্যারেজে গাড়ির কাজ করাতে হবে৷ ফের টাকার ধাক্কা৷ কোথা থেকে সেসব আসবে জানি না৷ আমাদের মতো পরিবারে অর্থনীতির কোমরটাই ভেঙে দিয়েছে কোরোনা ৷ এমন অবস্থা আর 10 দিন চললে কোরোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগেই আমরা না খেয়ে মরে যাব৷ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমাদের দিনে 500 টাকা রোজগার হয়েই যায়৷ কিন্তু এখন সব বন্ধ৷ আমাদের পরিস্থিতি কেউ জানে না৷”
অটো ও টোটোওয়ালাদের পরিস্থিতি যে মারাত্মক আকার নিয়েছে তা মেনে নিচ্ছেন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন, INTTUC-এর জেলা সভাপতি মানব বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি বলেন, “এই লকডাউনে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পরিবহণে যুক্ত শ্রমিকরা৷ টোটো, অটো থেকে বাস পর্যন্ত পরিবহণ শ্রমিকরা দিন আনে, দিন খায়৷ এদের অন্য কোনও রোজগার নেই৷ এরা মূলত শহরের বস্তি এলাকায় থাকে৷ অনেকে গ্রাম থেকে শহরে অটো কিংবা টোটো চালাতে আসে ৷ এদের কারও কোনও জমি কিংবা জায়গা নেই ৷ এদের রোজগার পুরোপুরি বন্ধ ৷ এরা এখন কী খাবে বুঝতে পাচ্ছে না ৷ এদের জিজ্ঞেস করলে হয়ত বলবে, দিনে 500 টাকা রোজগার হয়৷ কিন্তু তার মধ্যে যে খরচও রয়েছে, তা এরা মনে রাখে না৷ সেসব ধরলে এরা দিনে 250-300 টাকা রোজগার করে ৷ এই টাকা পরিবার চালাতেই শেষ হয়ে যায়৷ কারও কোনও সঞ্চয় নেই৷ এরা কী করে খাবে? এরা কোনওরকমে 2-3 দিন চালিয়েছে ৷ কোনও কোনও টোটোওয়ালা এখন সবজি বিক্রি করছে৷ আমাদের কাছে অনেকে সাহায্য চাইতে আসছে৷ আমরা সংগঠনগতভাবে তাদের সাহায্যের চেষ্টা করছি৷ কারণ, ব্যক্তিগতভাবে এই হাজার হাজার মানুষকে সাহায্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ এই মুহূর্তে মালদা জেলায় প্রায় 1400 অটো রয়েছে ৷ টোটোর সংখ্যা প্রায় 13 হাজার৷ কোরোনার লকডাউনে এরা সবাই বিপর্যস্ত ৷”