মালদা, 6 সেপ্টেম্বর: গোটা গ্রামে কান্নার রোল ৷ তবে এই কান্না স্বজন হারানোর নয়, এই কান্না ঘর হারানোর ৷ চারদিকে হাতুড়ির শব্দ ৷ সময় বড্ড কম ৷ তাই গ্রামের সবাই নিজেদের ঘর ভাঙতে নেমে পড়েছেন ৷ আশংকাকে সত্যি করে গঙ্গার ছোবলে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে রতুয়া-1 নম্বর ব্লকের মহানন্দটোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের কান্তটোলা গ্রাম ৷ খবর পেয়ে বুধবার শাসকদলের জনপ্রতিনিধিরা গ্রামে যেতেই ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীরা তাঁদের ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখান ৷ যদিও কোনওরকমে তাঁরা গ্রামবাসীদের নিরস্ত্র করেন ৷ এদিকে রাজ্যের সেচ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, সেচ দফতর গোটা ঘটনার উপর নজর রেখেছে ৷ ইতিমধ্যে ভাঙন রোধের অস্থায়ী কাজ শুরু করা হয়েছে ৷
গ্রামের প্রৌঢ় হরিশচন্দ্র মণ্ডল নিজেদের দুর্ভাগ্যের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন ৷
তিনি বলেন, "100 বছর ধরে এই গ্রামের বাসিন্দা আমরা ৷ গতকাল সাড়ে 12টা থেকে চার প্রহরের মধ্যে গ্রামের 30-35টি বাড়ি একসঙ্গে নদীতে বসে গিয়েছে ৷ আমাদের আর কোনও অস্তিত্ব নেই ৷ ঘরের জিনিসপত্র রাস্তার ধারে ছ'জায়গায় রেখে এসেছি ৷ দিনরাত খেটে খাই ৷ কোথায় জমি জায়গা কিনব? গতবার বিডিওর কাছে গিয়েছিলাম ৷ পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছি ৷ এবারও তাঁর কাছে এই দাবিতে গিয়েছি ৷ কিন্তু তিনি কোনও ব্যবস্থা করেননি ৷ আমরা কি ভারত সরকারের অধীনে নই? আমরা কেন মাথা গোঁজার জায়গা পাব না? জল এখন কমের দিকে ৷ কিন্তু স্রোতের বেগ তীব্র ৷ এখন কোথায় যাব জানি না ৷ আমাদের একটু শুধু জায়গা দিক সরকার ৷ খেটে কোনওরকমে মাথা গোঁজার জায়গা করে নেব ৷”
গতকালই নদীতে বাড়ি তলিয়ে গিয়েছে অর্চনা মণ্ডলের ৷ কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলটুকুও যেন শুকিয়ে গিয়েছে তাঁর ৷ কিন্তু কান্না থামেনি ৷ জানালেন, জমি-জায়গা কিছু নেই ৷ ওসব তো গঙ্গা আগেই গিলে নিয়েছে ৷ ঘরটা ছিল ৷ গতকাল সেটাও চলে গিয়েছে ৷ খেটে খান ৷ ক'দিন ধরে রাস্তার পাশে পড়ে রয়েছেন ৷ কেউ খোঁজ নিতে আসেনি ৷ তাঁদের কোনও ব্যবস্থা না করে দিলে গঙ্গায় ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই বলে জানালেন তিনি ৷
আরও পড়ুন: গঙ্গার ভাঙনে ঘর হারিয়ে সরকারি খাস জমির দাবি দুর্গতদের
জলস্তর কমলে গঙ্গার ভাঙন যে তীব্র আকার ধারণ করবে, তা আগেই আশংকা করেছিলেন গ্রামবাসীরা ৷ সোমবার রাত থেকে তাদের আশংকা সত্যি হয়েছে ৷ কাউকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়ে গতকাল দুপুর থেকে আজ সকাল পর্যন্ত কান্তটোলা গ্রামের 30-35টি বাড়ি গিলে নিয়েছে গঙ্গা ৷ কয়েকটি ঘরের নীচ দিয়ে এখন নদী বয়ে যাচ্ছে ৷ স্বাভাবিকভাবেই চূড়ান্ত আতঙ্কে গ্রামবাসীরা ৷ যে যতটা পারছেন, নিজেদের ঘরবাড়ি ভেঙে অন্যত্র সরে যাচ্ছেন ৷
বুধবার কান্তটোলা গ্রাম পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এলাকার বিধায়ক তথা তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান সমর মুখোপাধ্যায়, দলের জেলা সভাপতি তথা মালতিপুরের বিধায়ক আবদুর রহিম বকসি, জেলা পরিষদের সভাধিপতি লিপিকা বর্মন ঘোষ প্রমুখ ৷ তাঁরা গ্রামে যেতেই বিপন্ন গ্রামবাসীরা তাঁদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখান ৷ অনেক চেষ্টার পর গ্রামবাসীদের শান্ত করেন তাঁরা ৷
গ্রামবাসীদের উদ্দেশে আবদুর রহিম বকসি বলেন, "আমরা চেষ্টা করছি যাদের বাড়ি নদীতে চলে গিয়েছে, তাদের অন্য কোথাও বসানো যায় কি না ৷ তার জন্য আজই জেলাশাসকের সঙ্গে কথা বলব ৷ তবে গঙ্গার ভাঙন স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে গেলে কেন্দ্রের কাছ থেকে টাকা আনতেই হবে ৷ নইলে পাঁচ বছর পর আমার বাড়িও নদীতে চলে যাবে ৷ কোনওভাবে গঙ্গা আর ফুলহর মিশে গেলে এই জেলার রক্ষা থাকবে না ৷ আজ আপনারা আমাদের ধাক্কাধাক্কি করলেও আমরা কিছু মনে করতাম না ৷ আমরা জানি, আপনাদের দুঃখ একমাত্র আপনারাই বোঝেন ৷"
আরও পড়ুন: ঘরের নীচে গঙ্গা, আতঙ্কে অন্তত একশো বাড়ি ভেঙে দিলেন গ্রামবাসীরাই
স্থানীয় বিধায়ক সমর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, 1962 সালে ফরাক্কা ব্যারেজ হয়েছিল ৷ তখন চুক্তি হয়েছিল, নদীর আপ স্ট্রিমে 60 কিলোমিটার এবং ডাউন স্ট্রিমে 20 কিলোমিটার এলাকা দেখবে ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ ৷ এখন সামশেরগঞ্জ থেকে বিহারের মনিহারী ঘাট পর্যন্ত গঙ্গার ভাঙন হচ্ছে ৷ কিন্তু ফরাক্কা ব্যারেজ চুক্তি অনুযায়ী কাজ করছে না ৷ এ নিয়ে ফরাক্কা ব্যারেজ ও দিল্লিতে ঘেরাও করার হুঁশিয়ারি দেন তিনি ৷ অন্যদিকে রাজ্যের সেচ প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন জানিয়েছেন, কান্তটোলায় ইতিমধ্যে ভাঙন রোধের অস্থায়ী কাজ শুরু করেছে সেচ দফতর ৷ গোটা পরিস্থিতির উপর নজর রাখা হচ্ছে ৷ গৃহহীন ও বিপন্ন মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য প্রয়োজনীয় জমির খোঁজ করতে জেলাশাসককে বলা হয়েছে ৷