মালদা, 14 অগস্ট: ভাঙন প্রবণ এলাকার মানুষকে আরও বিপন্ন করে বিপদসীমা পেরিয়ে গেল গঙ্গা ৷ ফুঁসছে মালদা জেলার বাকি দুই প্রধান নদীও ৷ গঙ্গার ভাঙন এখনও অব্যাহত জেলায় ৷ তাতেই অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে মানিকচকের গোপালপুর ও হীরানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তিনটি গ্রাম ৷ ইতিমধ্যে শতাধিক বাড়ি চলে গিয়েছে নদীগর্ভে ৷ যাঁরা এখনও বেঁচেবর্তে রয়েছেন, তাঁরাও গঙ্গার পাড় থেকে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন ৷ নদীর ধারে থাকা গাছপালা কেটে নিচ্ছেন তাঁরা ৷ মানুষ বিপন্ন হলেও রয়েছে নদী ভাঙনের রাজনীতি ৷ একে অন্যের দিকে আঙুল তুলেছে তৃণমূল ও বিজেপি ৷
উত্তর হুকুমতটোলার মমতাজ বিবি বলছেন, "ভাঙনে ভিটেমাটি নদীতে চলে যাচ্ছে ৷ কোনও সরকারি সহায়তা পাচ্ছি না ৷ নদীর ধার থেকে বাড়িঘর কীভাবে অন্য জায়গায় সরাব? সরকার আমাদের বসার কোনও জায়গাও দেয়নি ৷ একটা ত্রিপল দিয়েছে শুধু ৷ ওই ত্রিপল দিয়ে দানাপানি ঢাকব, নাকি মাথা বাঁচাব ! বৃষ্টি হলে বাচ্চাদের নিয়ে চৌকির নীচে লুকোচ্ছি ৷ এখনও পর্যন্ত কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলতে আসেনি ৷ নদী চার কিলোমিটার দূরে ছিল ৷ এখন ঘরের কলের গোড়ায় চলে এসেছে ৷ অন্যের জায়গায় কোনওমতে আছি ৷"
দক্ষিণ হুকুমতটোলার মহম্মদ রফিকুল আলমের কথায়, ভাঙনের পরিস্থিতি খুব খারাপ ৷ পুরোনো বাঁধ ভেঙে গিয়েছে ৷ এখন শেষ বাঁধই ভরসা ৷ তার অবস্থাও ভালো নয় ৷ আর একহাত জল বাড়লেই গোপালপুরে জল ঢুকতে শুরু করবে ৷ তখন মালদা শহরও বাঁচবে না ৷ মানুষ এখন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে ৷ হাতের কাছে যা পাচ্ছে, গঙ্গার ধারে ফেলছে ৷ তাঁরা দুই সরকারের কাছেই আবেদন করছেন, জরুরি ভিত্তিতে তারা মানুষের পাশে দাঁড়াক ৷
তিনি জানান, ভাঙন থেকে এলাকা বাঁচাতে এখনও সরকারিভাবে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ৷ গোপালপুর অঞ্চলে প্রায় 50 হাজার মানুষের বাস ৷ এখানে অন্তত 300 বাড়ি ডুবতে চলেছে ৷ ভাঙন থেকে বাঁচাতে ছোট ছোট গাছ কেটে নিচ্ছে মানুষ ৷ 1980 সালের আগে থেকে গঙ্গার ভাঙন চলছে ৷ নদী আগে 16 কিলোমিটার দূরে ছিল ৷ এখন গোপালপুরের দুয়ারে ৷ কিন্তু এতদিনেও কোনও সরকার কিছু করেনি ৷
আরও পড়ুন: মরশুমের প্রথম নদী ভাঙন শুরু ফুলহরের, বিপন্ন একাধিক গ্রাম
রতুয়া-1 নম্বর ব্লক সংলগ্ন পশ্চিম রতনপুরের সুগ্রীব চৌধুরীর অভিযোগ, তাঁরা গঙ্গার মূল স্রোতের ধারে রয়েছেন ৷ বাঁধের 75 শতাংশই শেষ ৷ বাকিটুকু কোনও মুহূর্তে ভেঙে যাবে ৷ তাই বাড়িঘর ভাঙতে শুরু করেছেন ৷ পুরো বাঁধ ভেঙে গেলে ভূতনি চরের অস্তিত্ব থাকবে না ৷ এখনও পর্যন্ত প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধিরা আসেনি ৷ ভোটের সময় মমতাদিদি আর মোদি অনেক কথা বলেন ৷ কিন্তু তাঁদের জন্য মমতা কিংবা মোদির সরকার কিছুই করেনি ৷ এভাবেই দু'মাস চলবে ৷
তিনি বলেন, "আমরা ভেসে গেলেও কেউ যে আসবে না, বিলক্ষণ জানি ৷"
মানুষের যাই হোক, গঙ্গা ভাঙন নিয়ে রাজনীতি অব্যাহত ৷
মানিকচকের তৃণমূল বিধায়ক সাবিত্রী মিত্র বলেন, "গঙ্গা ভাঙন রুখতে রাজ্য সরকার কেন্দ্রকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে ৷ কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কেন্দ্র কোনও টাকা দিচ্ছে না ৷ ওরা পশ্চিমবঙ্গকে জব্দ করতে গিয়ে এখানকার মানুষকেই জব্দ করে দিচ্ছে ৷ জনগণের ক্ষতি করতেও ওরা ছাড়ছে না ৷ গঙ্গা ভাঙন জাতীয় বিপর্যয় ৷ কেন্দ্রীয় সরকার বহু জায়গায় চুরি করছে ৷ একের পর এক সংস্থা বিক্রি করে দিচ্ছে ৷ কিন্তু গঙ্গার রোষ থেকে মানুষকে বাঁচাতে মোদির লক্ষ্য নেই ৷"
এ নিয়ে বিজেপির জেলা নেতা অম্লান ভাদুড়ি বলেন, "বিজেপির তরফে আমরা বহু বছর ধরে বলে আসছি, রাজ্য যদি গঙ্গার ভাঙন রোধের কাজ করতে না পারে তবে এই প্রকল্পকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দিয়ে দিক ৷ কেন্দ্র নিজের পরিকল্পনায় কাজ করবে ৷ কিন্তু রাজ্য সরকার এই দফতর হাতছাড়া করতে চাইছে না ৷ তারা চাইছে, কেন্দ্র টাকা দেবে, তারা টেন্ডার করে ঠিকাদারদের দিয়ে নিম্নমানের কাজ করাবে, আর ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা নেবে ৷ এই জিনিস চলতে পারে না ৷ কেন্দ্রীয় সরকার এই দুর্নীতি বারবার করতে দেবে না ৷"
জেলা সেচ দফতরের তরফে জানানো হয়েছে, সোমবার সকালে গঙ্গার জলস্তর ছিল 24.77 মিটার ৷ যা বিপদসীমা 24.69 মিটারের থেকে আট সেন্টিমিটার বেশি ৷ ফলে নদীর অসংরক্ষিত এলাকায় লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে ৷ এ দিন সকালে ফুলহর তার বিপদসীমা 27.43 মিটারের 47 সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে বয়েছে ৷ নদীর উচ্চতা ছিল 26.96 মিটার ৷ জল বাড়ছে মহানন্দারও ৷ এ দিন সকাল আটটায় মহানন্দার জলস্তরের উচ্চতা ছিল 19.14 মিটার ৷ আর 86 সেন্টিমিটার জলস্তর বাড়লেই 21 মিটারের বিপদসীমা ছুঁয়ে ফেলবে এই নদীও ৷
আরও পড়ুন: গঙ্গার ভাঙন রোধ নিয়ে তৃণমূল-বিজেপি তরজা
জল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গা ভাঙনের প্রকোপও বেড়েছে জেলায় ৷ বিশেষ করে গোপালপুর পঞ্চায়েতের উত্তর ও দক্ষিণ হুকুমতটোলার অবস্থা বিপন্ন ৷ একই অবস্থা হীরানন্দপুর পঞ্চায়েতের পশ্চিম রতনপুরের ৷ স্থানীয় গ্রামবাসীদের অভিযোগ, বিপদের দিনেও তাঁরা প্রশাসনের দেখা পাচ্ছেন না ৷ ভোট মিটলে জনপ্রতিনিধিরাও আর এমুখো হচ্ছেন না ৷ বিপর্যয়ে তাঁরা দিশেহারা ৷