মালদা, 14 নভেম্বর: ওদের আর আকাশ ডাকে না ৷ বাতাস কিংবা মাঠের সবুজ ঘাসও হাতছানি দেয় না ৷ শুধু পড়া নয়, কখনও খিদের জ্বালা, কখনও বা মোবাইলে আশক্তি ওদের জীবন থেকে নীল আকাশ কিংবা সবুজ ঘাসের উন্মাদনাটাই কেড়ে নিয়েছে ৷ প্রতি বছর শিশু দিবস আসে, চলেও যায় ৷ একটা দিন ওদের নিয়েই সব চিন্তাভাবনা, অনুষ্ঠানের বন্যা বয় ৷ কিন্তু বছরের বাকি দিনগুলো...ওরা কীভাবে থাকে, কেউ দেখে না ৷ দেখলেও শিশুদের মন কারও মস্তিষ্কে ধাক্কা দেয় না ৷
অত্যধিক পড়াশোনার চাপ শিশুদের কাছ থেকে তাদের শৈশব যে কেড়ে নিচ্ছে, তা বহু আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীরা ৷ সরকারি স্কুলগুলিতে সেই চাপ অনেকটাই কম। কিন্তু বেসরকারি স্কুলগুলোয় বাচ্চাদের ভিড় বেশি ৷ এমনকী প্রান্তিক পরিবারও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখতে একবেলা খেয়ে হলেও ছেলেমেয়েদের এখন বেসরকারি স্কুলে ভরতি করছে ৷ হবিবপুরের চাঁদপুর গ্রামের তেমনই এক অভিভাবক সাঁওতাল মার্ডি ৷ একমাত্র ছেলেকে ভরতি করেছেন দক্ষিণ দিনাজপুরের একটি নামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ৷ ছেলে হস্টেলে থাকে ৷ মাসে খরচও নেহাত কম নয় ৷
- সাঁওতালবাবুর সাফ কথা, "আমার সারাটা জীবন জমির ঘাস-কাদা মেখেই চলে গেল ৷ ছেলেটাকে যেন আমার মতো পরিশ্রম না-করতে হয় ৷ ও যেন নিজের জীবন স্বাচ্ছন্দে কাটায় ৷ তাই কষ্ট করেও ছেলেকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছি ৷ খেলাধুলো পরে হবে ৷ তার আগে ছেলেটার ভালো চাকরি দরকার ৷"
- মালদা শহরের গৃহবধূ সীমা সাহা ৷ একমাত্র ছেলে ক্লাস টুতে পড়ে ৷ স্বামী পেশায় ব্যবসায়ী ৷ সংসারের ঝক্কি তাঁকেই সামলাতে হয় ৷ বিকেলে ছেলেকে স্কুল থেকে আনার পর তাকে ফের মাঠে নিয়ে যাওয়ার সময় বের করতে পারেন না ৷ ছেলে সৌহার্দ্য মোবাইলের স্ক্রিনেই ব্যস্ত থাকে ৷ সন্ধে হলে তাকে পড়াতে বসাতে হবে তো সেই তাঁকেই ৷ তিনি জানান, ছেলেকে বিকেলে মাঠে নিয়ে যাওয়া, খোলা বাতাসে খেলাধুলো করানো খুব প্রয়োজন তা মানি ৷ কিন্তু কে নিয়ে যাবে? গোটা সংসার তাঁকেই চালাতে হয় ৷ আমার সেই সময় কোথায়! তার থেকে ভালো, ছেলে মোবাইলে কার্টুন দেখতে ব্যস্ত থাকে ৷"
- এই পেটের জ্বালাতেই আজ নরম হাতে ট্র্যাক্টরের স্টিয়ারিং ধরেছে আনমোল ৷ ইটভাটায় কাজ করে ৷ এখন থেকেই ট্র্যাক্টর চালানোর তালিম নিচ্ছে ৷ সে জানায়, বাবা শ্রমিক ৷ দিন গেলে শ'তিনেকের বেশি রোজগার হয় না ৷ ছ'জনের সংসারে ওই টাকায় দু'বেলা পেট ভরে না ৷ তাই কাজে নেমে পড়েছি ৷ লেখাপড়া করার ইচ্ছে ছিল ৷ কিন্তু সব ইচ্ছে তো পূরণ হয় না..."
- পুরাতন মালদার সন্তোষীদেবীর দুই মেয়ে ৷ একজন ক্লাস সিক্সে, আরেকজন ওয়ানে পড়ে ৷ স্বামী রাজমিস্ত্রি ৷ তাঁর আয়ে সংসার চলে না ৷ তাই মেয়েদের ধূপকাঠি তৈরির কাজে নামিয়ে দিয়েছেন ৷ তাঁর বক্তব্য, "কী করব! পেটের জ্বালা বড় জ্বালা ৷ এই কাজের জন্য ওদের যে পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, তা জানি ৷ কিন্তু সবার আগে তো বেঁচে থাকা, তাই না! বাধ্য হয়েই মেয়েদের এই কাজে নামাতে হয়েছে ৷"
মনোবিদ পর্ণাশা গুপ্ত রায় বলছেন, "বাচ্চারা খেলাধুলো করতে ভালোবাসে ৷ কিন্তু তারা এখন মাঠমুখি হচ্ছে না ৷ এর পিছনে নানা কারণ রয়েছে ৷ এখন ছোট থেকেই একাধিক গৃহশিক্ষক ৷ মাঠে যাওয়ার সময়টা তারা বের করতে পারে না ৷ সঙ্গে রয়েছে মোবাইল ফোন ৷ কান্না বা জেদ থামাতে এখন অনেক অভিভাবকই বাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেন ৷ এভাবেই তারা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে ৷ সারাদিনে বাচ্চাদের 30 মিনিটের বেশি স্ক্রিন সাইট হওয়া উচিত নয় ৷ অভিভাবকদেরই এটা ভাবতে হবে ৷ তবে কিছুক্ষেত্রে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটও বাচ্চাদের শৈশবের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে ৷ এক্ষেত্রে অবশ্য সরকারকেই ভাবতে হবে ৷ শিশুদের শৈশব নিশ্চিত করাটাও সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে ৷"
আরও পড়ুন: