ETV Bharat / state

প্রাচীন রীতি মেনে মূলাষষ্ঠী তিথিতে জুয়ার মেলা মালদায়, উদাসীন প্রশাসন

Gambling fair: প্রাচীন রীতি মেনে মূলাষষ্ঠী তিথিতে জুয়ার মেলা বসল পুরাতন মালদায় ৷ সোমবার বোর্ডে উড়ল লাখ লাখ টাকা ৷ আর সেই খেলায় যোগ দিলেন পুরুষ, মহিলা এমনকি শিশুরাও ৷ পুলিশ ও প্রশাসন এ ব্যাপারে কী বলছে, দেখে নিন ৷

Gambling fair
জুয়ার মেলা মালদায়
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Dec 19, 2023, 2:05 PM IST

Updated : Dec 19, 2023, 5:28 PM IST

জুয়ার মেলা মালদায়

মালদা, 19 ডিসেম্বর: সোমবার মূলাষষ্ঠী তিথিতে প্রাচীন রীতি মেনে মালদায় বসল জুয়ার মেলা ৷ সর্বসমক্ষে দেদার জুয়ার খেলায় লাখ লাখ টাকার ব্যবসা হল ৷ আইনত নিষিদ্ধ জুয়ার আসরে মাতলেন স্থানীয়রা ৷ জুয়ার ঠেকে দেখা গেল শিশুদেরও ৷ যদিও পুলিশ ও প্রশাসন এ ব্যাপারে একপ্রকার নির্বিকার ৷

শীত পড়তেই মূলাষষ্ঠী তিথি কবে আসবে, তার দিন গোনা শুরু করেছিলেন পুরাতন মালদার বাসিন্দারা ৷ অবশ্য শুধু তাঁরাই নন, দিন গুনছিলেন আরও অনেকে ৷ অবশেষে সেই বিশেষ দিনটি আসে সোমবার ৷ আর রীতি মেনে এই উপলক্ষে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত চলল দেদার জুয়াখেলা ৷ বোর্ডে লাখ লাখ টাকা উড়ল ৷ কেউ আমীর, কেউ বা ফকির হয়ে বাড়ি ফিরলেন ৷ জুয়াড়িদের মধ্যে ছিলেন মহিলা ও শিশুরাও ৷ জুয়াড়িদের মতোই সেই হাসি ছড়িয়েছে বোর্ডের মালিকদের মুখেও ৷ এ ভাবেই এ বছরের মতো শেষ হল পুরাতন মালদার অতি প্রাচীন এক রীতি ৷ যদিও আইনের চোখে অবৈধ জুয়াকে ঘিরে এই মেলার আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে ৷

আজব এই মেলার উৎপত্তি তুর্কি শাসনকালে ৷ সেই সময় পুরাতন মালদায় ছিল ঘন জনবসতি ৷ মূলত ধনীদের বাস ৷ তখনও মালদা শহর সেভাবে গড়ে ওঠেনি ৷ মোকাতিপুর এলাকায় তখন ঘন জঙ্গল ৷ শ্বাপদ জন্তু জানোয়ারের বাস ৷ দিনদুপুরেও বাঘ ঘুরে বেড়াত ৷ বাঘের ভয়ে ওই এলাকায় যাওয়ার সাহস পেত না কেউ ৷ সেই জঙ্গলেই বেহুলা নদীর পাড়ে ছিল ষষ্ঠীদেবীর বেদি ৷ তাই ঘরের মেয়ে-বউরা যখন মূলাষষ্ঠী তিথিতে সেই বেদিতে পুজো দিতে যেতেন, তখন পুরুষরা দল বেঁধে তাঁদের পাহারা দিতেন ৷ সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত চলত পুজো ৷ সময় কাটাতে পুরুষরা নিজেদের মধ্যে জুয়া খেলতেন ৷ সেই শুরু ৷ এখন তা প্রাচীন ঐতিহ্য ৷

আগে শুধু পুরুষরা এই মেলায় অংশ নিলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে মহিলারাও জুয়া খেলায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ৷ তাঁদের হাত ধরে বোর্ডে হাজির হয় ছেলেমেয়েরাও ৷ এটাই এখন রীতি ৷ এই মেলায় কোনও পুলিশি অভিযান হয় না ৷ তবে রাত 10টার মধ্যে মেলা শেষ করার জন্য পুলিশের অলিখিত নির্দেশ থাকে ৷ শুধু কী তাই ! মেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশের কড়া নজরদারিও থাকে ৷ সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীরা হাজির থাকেন সেখানে ৷ তবে এ নিয়ে আইনের রক্ষকদের কেউ প্রতিক্রিয়া দেন না ৷ তাঁদের বক্তব্য, কখনও কখনও প্রাচীন ঐতিহ্যের কাছে বোধহয় আইনও থমকে যায় ৷

স্থানীয় বাসিন্দা পায়েল নন্দী বলছেন, “সন্তানদের মঙ্গল কামনায় এই পুজো ৷ রীতি অনুযায়ী সকাল থেকে উপোস করে ষষ্ঠীদেবীর পুজো দেওয়া হয় ৷ পুজোর পর বেহুলার জল পান করে উপোসভঙ্গ হয় ৷ তারপর সামান্য খাবার খেয়ে জুয়া খেলে বাড়ি ফেরা ৷ আমিও জুয়া খেলেছি ৷ হেরে গিয়েছি ৷ জেতার চেষ্টায় আবার খেলব ৷”

এক বৃদ্ধা আরতি শেঠ জানালেন, “এটা ষষ্ঠী পুজো ৷ পৌষ মাসে মূলাষষ্ঠী তিথিতে আমাদের এই বাৎসরিক পুজো হয় ৷ পাশে বেহুলা নদী ৷ সতী-সাবিত্রী থাকার জন্য সবাই সেই নদীর জল পান করে ৷ পুজো শেষে বাড়ি ফেরার পথে মেলায় ঘুরি ৷ ছেলেমেয়েরা জুয়া খেলে ৷ আমাদের বয়স হয়েছে ৷ তাই এখন শুধু খেলা দেখি ৷”

মেলা কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা তথা পুরাতন মালদা পৌরসভার 3 নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর স্বপ্না হালদারের প্রতিনিধি সুমিত হালদার বলেন, “মূলাষষ্ঠী তিথিতে পরিবারের মঙ্গল কামনায় মহিলারা এখানে পুজো করেন ৷ এই পুজোয় লেউড়ি নামে এক ধরনের মিষ্টি ভোগ দেওয়া হয় ৷ যা গোটা দেশে কোথাও পাওয়া যায় না ৷ পুজো দিয়ে ফেরার পথে তাঁরা জুয়ার বোর্ডে নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করেন ৷ শুধু মহিলারাই অবশ্য নন, পুরুষ এবং ছোট ছেলেমেয়েরাও বিশেষ এই দিনে মেলায় নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করে ৷”

তবে প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে জুয়াখেলা আইনের চোখে অবৈধ, প্রতিদিন কোথাও না কোথাও জুয়ার বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান চলে, গ্রেফতার হন জুয়াড়িরা, সেখানে পুলিশ প্রশাসনের ‘সম্মতিতে’ যুগের পর যুগ ধরে পুরাতন মালদায় এই মেলা চলছে কীভাবে ? এ নিয়ে পুলিশ কিছু বলতে না চাইলেও জেলা প্রশাসনের অন্যতম শীর্ষ এক আধিকারিক বলছেন, “এমন মেলার কথা আমাদের জানা ছিল না ৷ আইনের চোখে জুয়াখেলা নিশ্চয়ই অবৈধ ৷ কিন্তু কখনও কখনও প্রাচীন ঐতিহ্যের সামনে আইনকেও বোধহয় থমকে যেতে হয় ৷ তাছাড়া যা জানা গেল, ওই মেলায় নিজেদের ভাগ্যপরীক্ষা করেন মানুষজন ৷ অনেকটা লটারির মতো ৷ লটারিও এক ধরনের জুয়া ৷ কিন্তু আইন লটারিকে স্বীকৃতি দিয়েছে ৷ তাই এই ঐতিহ্যকে লটারির দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে কোনও সমস্যা হয় না ৷ তবু বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে ৷”

এই নিয়ে মালদার জেলাশাসক নীতিন সিংহানিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "আমি বিষয়টা জানতাম না । খোঁজখবর নিচ্ছি । যথাযথ পদক্ষেপ করা হবে ।"

আরও পড়ুন:

  1. জুয়া খেলার টাকা না-দেওয়ায় মারধর, স্বামীর বিরুদ্ধে পুলিশে গেলেন মহিলা
  2. অপহরণের নাটক করে পরিবারের থেকে টাকা নিয়ে জুয়ার আসর ! শিলিগুড়িতে গ্রেফতার 17
  3. বিশ্বকাপকে ঘিরে শহরে বসছে জুয়ার আসর, নজরদারির নির্দেশ নগরপালের

জুয়ার মেলা মালদায়

মালদা, 19 ডিসেম্বর: সোমবার মূলাষষ্ঠী তিথিতে প্রাচীন রীতি মেনে মালদায় বসল জুয়ার মেলা ৷ সর্বসমক্ষে দেদার জুয়ার খেলায় লাখ লাখ টাকার ব্যবসা হল ৷ আইনত নিষিদ্ধ জুয়ার আসরে মাতলেন স্থানীয়রা ৷ জুয়ার ঠেকে দেখা গেল শিশুদেরও ৷ যদিও পুলিশ ও প্রশাসন এ ব্যাপারে একপ্রকার নির্বিকার ৷

শীত পড়তেই মূলাষষ্ঠী তিথি কবে আসবে, তার দিন গোনা শুরু করেছিলেন পুরাতন মালদার বাসিন্দারা ৷ অবশ্য শুধু তাঁরাই নন, দিন গুনছিলেন আরও অনেকে ৷ অবশেষে সেই বিশেষ দিনটি আসে সোমবার ৷ আর রীতি মেনে এই উপলক্ষে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত চলল দেদার জুয়াখেলা ৷ বোর্ডে লাখ লাখ টাকা উড়ল ৷ কেউ আমীর, কেউ বা ফকির হয়ে বাড়ি ফিরলেন ৷ জুয়াড়িদের মধ্যে ছিলেন মহিলা ও শিশুরাও ৷ জুয়াড়িদের মতোই সেই হাসি ছড়িয়েছে বোর্ডের মালিকদের মুখেও ৷ এ ভাবেই এ বছরের মতো শেষ হল পুরাতন মালদার অতি প্রাচীন এক রীতি ৷ যদিও আইনের চোখে অবৈধ জুয়াকে ঘিরে এই মেলার আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে ৷

আজব এই মেলার উৎপত্তি তুর্কি শাসনকালে ৷ সেই সময় পুরাতন মালদায় ছিল ঘন জনবসতি ৷ মূলত ধনীদের বাস ৷ তখনও মালদা শহর সেভাবে গড়ে ওঠেনি ৷ মোকাতিপুর এলাকায় তখন ঘন জঙ্গল ৷ শ্বাপদ জন্তু জানোয়ারের বাস ৷ দিনদুপুরেও বাঘ ঘুরে বেড়াত ৷ বাঘের ভয়ে ওই এলাকায় যাওয়ার সাহস পেত না কেউ ৷ সেই জঙ্গলেই বেহুলা নদীর পাড়ে ছিল ষষ্ঠীদেবীর বেদি ৷ তাই ঘরের মেয়ে-বউরা যখন মূলাষষ্ঠী তিথিতে সেই বেদিতে পুজো দিতে যেতেন, তখন পুরুষরা দল বেঁধে তাঁদের পাহারা দিতেন ৷ সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত চলত পুজো ৷ সময় কাটাতে পুরুষরা নিজেদের মধ্যে জুয়া খেলতেন ৷ সেই শুরু ৷ এখন তা প্রাচীন ঐতিহ্য ৷

আগে শুধু পুরুষরা এই মেলায় অংশ নিলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে মহিলারাও জুয়া খেলায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ৷ তাঁদের হাত ধরে বোর্ডে হাজির হয় ছেলেমেয়েরাও ৷ এটাই এখন রীতি ৷ এই মেলায় কোনও পুলিশি অভিযান হয় না ৷ তবে রাত 10টার মধ্যে মেলা শেষ করার জন্য পুলিশের অলিখিত নির্দেশ থাকে ৷ শুধু কী তাই ! মেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশের কড়া নজরদারিও থাকে ৷ সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীরা হাজির থাকেন সেখানে ৷ তবে এ নিয়ে আইনের রক্ষকদের কেউ প্রতিক্রিয়া দেন না ৷ তাঁদের বক্তব্য, কখনও কখনও প্রাচীন ঐতিহ্যের কাছে বোধহয় আইনও থমকে যায় ৷

স্থানীয় বাসিন্দা পায়েল নন্দী বলছেন, “সন্তানদের মঙ্গল কামনায় এই পুজো ৷ রীতি অনুযায়ী সকাল থেকে উপোস করে ষষ্ঠীদেবীর পুজো দেওয়া হয় ৷ পুজোর পর বেহুলার জল পান করে উপোসভঙ্গ হয় ৷ তারপর সামান্য খাবার খেয়ে জুয়া খেলে বাড়ি ফেরা ৷ আমিও জুয়া খেলেছি ৷ হেরে গিয়েছি ৷ জেতার চেষ্টায় আবার খেলব ৷”

এক বৃদ্ধা আরতি শেঠ জানালেন, “এটা ষষ্ঠী পুজো ৷ পৌষ মাসে মূলাষষ্ঠী তিথিতে আমাদের এই বাৎসরিক পুজো হয় ৷ পাশে বেহুলা নদী ৷ সতী-সাবিত্রী থাকার জন্য সবাই সেই নদীর জল পান করে ৷ পুজো শেষে বাড়ি ফেরার পথে মেলায় ঘুরি ৷ ছেলেমেয়েরা জুয়া খেলে ৷ আমাদের বয়স হয়েছে ৷ তাই এখন শুধু খেলা দেখি ৷”

মেলা কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা তথা পুরাতন মালদা পৌরসভার 3 নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর স্বপ্না হালদারের প্রতিনিধি সুমিত হালদার বলেন, “মূলাষষ্ঠী তিথিতে পরিবারের মঙ্গল কামনায় মহিলারা এখানে পুজো করেন ৷ এই পুজোয় লেউড়ি নামে এক ধরনের মিষ্টি ভোগ দেওয়া হয় ৷ যা গোটা দেশে কোথাও পাওয়া যায় না ৷ পুজো দিয়ে ফেরার পথে তাঁরা জুয়ার বোর্ডে নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করেন ৷ শুধু মহিলারাই অবশ্য নন, পুরুষ এবং ছোট ছেলেমেয়েরাও বিশেষ এই দিনে মেলায় নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করে ৷”

তবে প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে জুয়াখেলা আইনের চোখে অবৈধ, প্রতিদিন কোথাও না কোথাও জুয়ার বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান চলে, গ্রেফতার হন জুয়াড়িরা, সেখানে পুলিশ প্রশাসনের ‘সম্মতিতে’ যুগের পর যুগ ধরে পুরাতন মালদায় এই মেলা চলছে কীভাবে ? এ নিয়ে পুলিশ কিছু বলতে না চাইলেও জেলা প্রশাসনের অন্যতম শীর্ষ এক আধিকারিক বলছেন, “এমন মেলার কথা আমাদের জানা ছিল না ৷ আইনের চোখে জুয়াখেলা নিশ্চয়ই অবৈধ ৷ কিন্তু কখনও কখনও প্রাচীন ঐতিহ্যের সামনে আইনকেও বোধহয় থমকে যেতে হয় ৷ তাছাড়া যা জানা গেল, ওই মেলায় নিজেদের ভাগ্যপরীক্ষা করেন মানুষজন ৷ অনেকটা লটারির মতো ৷ লটারিও এক ধরনের জুয়া ৷ কিন্তু আইন লটারিকে স্বীকৃতি দিয়েছে ৷ তাই এই ঐতিহ্যকে লটারির দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে কোনও সমস্যা হয় না ৷ তবু বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে ৷”

এই নিয়ে মালদার জেলাশাসক নীতিন সিংহানিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "আমি বিষয়টা জানতাম না । খোঁজখবর নিচ্ছি । যথাযথ পদক্ষেপ করা হবে ।"

আরও পড়ুন:

  1. জুয়া খেলার টাকা না-দেওয়ায় মারধর, স্বামীর বিরুদ্ধে পুলিশে গেলেন মহিলা
  2. অপহরণের নাটক করে পরিবারের থেকে টাকা নিয়ে জুয়ার আসর ! শিলিগুড়িতে গ্রেফতার 17
  3. বিশ্বকাপকে ঘিরে শহরে বসছে জুয়ার আসর, নজরদারির নির্দেশ নগরপালের
Last Updated : Dec 19, 2023, 5:28 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.