ETV Bharat / state

কীটনাশক প্রয়োগ করে চাষ, মলিন করছে মালদার আমের ভাগ্যলক্ষ্মীকে

কীটনাশকের যথেচ্ছ প্রয়োগ। কৌলীন্য হারাচ্ছে জেলার আমচাষ।

mango
কীটনাশক প্রয়োগ করে আমচাষ,মলিন করছে মালদার আমের ভাগ্যলক্ষ্মীকে
author img

By

Published : Jun 6, 2020, 10:31 AM IST

মালদা, 6 জুন : আমের জেলা মালদা ৷ আম এই জেলার অর্থনীতির ভিত্তি ৷ জেলার প্রায় ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়৷ প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর লকডাউন জেলার আমচাষকে প্রবল ধাক্কা দিয়েছে ৷ কিন্তু যদি এই দুটি বিষয় না থাকত, তবেও কি জেলার আমের সঠিক দাম মিলত? প্রশ্নটা চাষি, ব্যবসায়ী, এমনকি সরকারি মহলেও৷ কারণ, গত কয়েক বছর ধরেই চাহিদা কমছে জেলার উৎপাদিত আমের সংখ্যা ৷ ধাক্কা খাচ্ছে অর্থনীতি৷ আগে এই জেলার আম বিদেশযাত্রা করলেও গত কয়েক বছর ধরে আমের বিদেশ যাত্রাতে পড়েছে ছেদ৷ শুধু বিদেশে নয়, ভিনরাজ্যেও এই জেলার উৎপাদিত আমের চাহিদা ক্রমশ নিম্নমুখী৷ এখন শুধুমাত্র অসম, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের চাহিদাই বাঁচিয়ে রেখেছে মালদার আমকে৷ তবে আশঙ্কা রয়েই য়াচ্ছে যে এই তিন রাজ্যেও আর কতদিন মালদার আমের চাহিদা থাকবে৷ এর মূল কারণ, এই জেলার আমচাষে অপর্যাপ্ত কীটনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার৷ মুকুল থেকে আম পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত ১০-১২ বার গাছে কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে৷ মুকুল আসার আগে অধিক ফলনের আশায় গাছের গোড়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক৷ অপরিপক্ক আম পাকানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড৷ এসবের প্রভাব থেকে যাচ্ছে পাকা আমেও৷ মানুষের শরীরের পক্ষে তা হানিকারক বলে জানাচ্ছে খোদ চাষিরাই৷ কিন্তু তাদের বক্তব্য, ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখতে হলে এসব ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নেই৷ গোটা ঘটনার প্রভাব যে জেলার অর্থনীতির ভিত নড়িয়ে দিচ্ছে তা মেনে নিচ্ছে জেলা উদ্যানপালন দপ্তরও৷ দপ্তরের পক্ষ থেকে চাষিদের এই নিয়ে বারবার সচেতন করা হচ্ছে৷ কিন্তু তা বিশেষ কাজে আসছে না বলে জানাচ্ছেন দপ্তরের কর্তারা৷

মালদা জেলার আম ইতিহাস অতি প্রাচীন৷ ৫০০ বছর আগেও এখানে আমচাষের প্রচলন ছিল৷ জানা যায়, এই জেলার আম পাড়ি দিত মুঘল দরবারে৷ পাড়ি দিত মধ্যপ্রাচ্য সহ ইউরোপিয়ান দেশগুলিতেও৷ জেলায় ৩৫০টিরও বেশি প্রজাতির আমের নাম রয়েছে৷ বর্তমানে প্রতি মরশুমে গড়ে অন্তত আড়াই লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়৷ কিন্তু সময়ের সঙ্গে আমচাষেও এসেছে অনেক পরিবর্তন৷ কয়েক দশক আগেও যেখানে গোটা জেলায় জৈবিক পদ্ধতিতে আম চাষ করা হত, এখন সেই জায়গার দখল নিয়েছে রাসায়নিক সামগ্রী৷ এতে বেশ বড় প্রভাব পড়েছে জেলার আম ব্যবসায়৷

বিষয়টি নিয়ে জেলা উদ্যানপালন দপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর কৃষ্ণেন্দু প্রধান বলেন, “আমের জেলা হিসাবেই মালদার নাম গোটা বিশ্বে সমাদৃত৷ এই জেলায় ৩০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে আম চাষ হয়৷ আমরা সারা বছর আমচাষিদের ট্রেনিং দিই৷ মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের কুফল নিয়ে সবসময় চাষিদের বোঝাই৷ তাদের পইপই করে বলে দেওয়া হয়, কোনও কোনও কীটনাশক কী মাত্রায় কখন ব্যবহার করতে হবে৷ কিন্তু সবকিছু জেনেও কিছু চাষি কীটনাশকের মাত্রায় হেরফের করে৷ বেশি মাত্রায় এবং অপরিমিতভাবে কীটনাশক প্রয়োগ করে৷ একটি বিষয় ঠিক, এই জেলায় কোথাও নিষিদ্ধ কীটনাশক আমচাষে ব্যবহার করা হয় না৷ কিন্তু বৈধ কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগে সমস্যা দেখা দিচ্ছে৷ দপ্তরের পক্ষ থেকে আমরা কৃষকদের বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি৷ তাদের বারবার বলছি, যতটা কম সম্ভব কীটনাশক ব্যবহার করতে৷ সুখের কথা, অনেক চাষি আমাদের পরামর্শ মেনে কাজ করছে৷ তাদের অনেকেই বুঝতে পেরেছে, কোন কীটনাশক কী মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে৷ তবে এখনও আমাদের এনিয়ে আরও কাজ করতে হবে৷” কৃষ্ণেন্দুবাবু আরও বলেন, “এই জেলায় আমচাষ নিয়ে আমাদের আরও একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, এখানে আম ব্যবসায়ীরা বাগান মালিকের কাছ থেকে বাগান লিজে নিয়ে নেয়৷ তারাই সেখানে আমগাছের দেখাশোনা করে৷ চাষও করে ব্যবসায়ীরাই৷ জেলার প্রায় ৭০ শতাংশ বাগানে এই পদ্ধতিতেই আমচাষ হয়৷ ব্যবসায়ীরা আমগাছ কিংবা ফলের গুণাগুণের কথা ভাবে না৷ তাদের মূল লক্ষ্য ফলন বৃদ্ধি৷ তার জন্য তারা গাছে প্যাক্লোবুটরাজল নামে একটি রাসায়নিক ব্যবহার করে৷ এটা নিষিদ্ধ না হলেও এই রাসায়নিক ব্যবহারের কিছু নিয়মবিধি রয়েছে৷ এক বছর ব্যবহার করার পর অন্তত ২-৩ বছর এই রাসায়নিক ব্যবহার করা যায় না৷ এতে গাছের ক্ষতি হয়৷ আমরা এই রাসায়নিকের ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি৷ তাছাড়া এই জেলার চাষিরা আমগাছে অপর্যাপ্তভাবে কীটনাশক ব্যবহার করে৷ এতে একদিকে যেমন পোকামাকড়ের প্রতিরোধ শক্তি বেড়ে যায়, তেমনই উৎপাদিত ফলে কীটনাশকের প্রভাবও থেকে যায়৷ ফলে সেই আম খেলে মানুষের শরীরেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে৷ অপরিপক্ক আম পাকানোর জন্য যথেচ্ছ হারে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করা হচ্ছে৷ এই রাসায়নিক ব্যবহার কিন্তু সম্পূর্ণ বেআইনি৷ আমরা কৃষকদের এসব নিয়ে সচেতন করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি৷ তাদের বলছি, সঠিক আমচাষের জন্য বছরভর কাজ করতে হবে৷ বাগানের মাটি চাষ করতে হবে৷ যাতে সূর্যালোকে মাটিতে থাকা ক্ষতিকর জীবাণু, এমনকি কিছু পোকামাকড়ও মরে যায়৷ শুধু মরশুমে রাসায়নিক কিংবা কীটনাশক ব্যবহার করলেই চলবে না৷”

অন্যদিকে আমচাষি কিংবা ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, কীটনাশক ব্যবহার না করলে জেলা থেকে আমচাষই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে৷ বর্তমানে জৈবিক পদ্ধতিতে কিংবা উদ্যানপালন দপ্তরের সমস্ত বিধিনিষেধ মেনে আমচাষ করা কিছুতেই সম্ভব নয়৷ ইংরেজবাজারের লিজে বাগান কেনা এক আমচাষি ফিরোজ আলি বলেন, “আমরা বাগান মালিকের কাছ থেকে লিজে বাগান কিনি৷ এরপর বাগান মালিক আর গাছের দিকে ঘুরেও তাকায় না৷ চাষের সমস্ত ঝোক্কি আমাদেরই সামাল দিতে হয়৷ খরচও আমাদের বহন করতে হয়৷ এক লাখ টাকা দিয়ে বাগান কিনলে তাতে আরও এক লাখ টাকা চাষে খরচ হয়৷ অন্তত ১০ বার কীটনাশক স্প্রে করতে হয়৷ ফলন বাড়ানোর রাসায়নিক দিয়ে চাষ শুরু হয়৷ এরপর বিভিন্ন কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়৷ মুকুল বেরোনোর সময় থেকে আম পাড়ার ১৫ দিন আগে পর্যন্ত এই কাজ চলে৷ আমরা বুঝতে পারি, এত কীটনাশক ব্যবহার করার জন্য ব্যবসায় প্রভাব পড়ছে৷ আমের দাম দিন দিন কমে যাচ্ছে৷ কিন্তু এভাবে কীটনাশক ব্যবহার করা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায়ও নেই৷ কীটনাশকের প্রভাব ফলের ভিতর থেকে যাওয়ায় এই আম খেয়ে মানুষের শরীরেও প্রভাব পড়ে৷ সেটা আমরা জানি৷ আজ যদি সরকার এসব কীটনাশক নিষিদ্ধ করে দেয়, তবে আমাদেরও সেভাবে চাষের ধরন বদলাতে হবে৷ অনেক দেশেই এসব কীটনাশক কিংবা রাসায়নিক আম চাষে ব্যবহার করা হয় না৷ কিন্তু এখানে এই সমস্ত কীটনাশক এখনও নিষিদ্ধ ঘোষিত না হওয়ায় আমরাও এসবের ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি৷ এসব ব্যবহার না করলে গাছ থেকে একটা আমও পাওয়া যাবে না৷”প্রায় একই বক্তব্য পুরাতন মালদার আমচাষি সাহেব দাসের৷ তিনি বলেন, “এই জেলার আম দেশ সহ বিদেশেও যায়৷ দিন দিন বাগানের দাম বেড়ে যাচ্ছে৷ অথচ আমের তেমন ফলন বাড়ছে না৷ ফলন বাড়ানোর জন্যই আমাদের আম চাষে বেশি মাত্রায় রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার করতে হচ্ছে৷ আমরা মরশুমে ১০ থেকে ১২ বার কীটনাশক স্প্রে করি৷ তা না হলে আমে পোকা ধরে যাবে৷ গাছেই আম পচে যাবে৷ ফলন বাড়ানোর রাসায়নিক ব্যবহার করায় গাছের ক্ষতি হয়৷ কীটনাশক ব্যবহারের জন্য মানুষের শরীরেও প্রভাব পড়ে৷ সবই জানি৷ কিন্তু নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে এসব ব্যবহার ছাড়া আমাদের কোনও উপায় নেই৷ বাজারের পরিস্থিতি দেখে এখন আমাদের পরিপক্ক হওয়ার আগেই গাছ থেকে আম পেড়ে নিতে হচ্ছে৷ অপরিপক্ক আম বাজারজাত করার জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি আমরা৷ এবার লকডাউনের জন্য আরও আগে আম পাড়ছি৷ সবারই ভয়, যদি ফের গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, তবে আমাদের পথে বসতে হবে৷ এখন সরকার যদি এসব রাসায়নিক কিংবা কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তাহলে আমাদের ব্যবসা শেষ হয়ে যাবে৷”

জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দপ্তর সূত্রে জানা যাচ্ছে, বর্তমানে এই জেলার আমচাষে মূলত ক্লোরপাইরিফস, লাম্বদা সইহালোথরিন, ওটাবেল সালফার, ইমিডাকলোপ্রিড প্রভৃতি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়৷ ছত্রাকনাশক হিসাবে ব্যবহৃত হয় ম্যানকোজেব, কারবেনডাজিম প্রভৃতি৷ এসবের ব্যবহার বৈধ ৷ তবে জেলার আমচাষিরা যথেচ্ছ হারে এসব প্রয়োগ করে জেলার আমচাষের সমস্যা বাড়াচ্ছে ৷ কৌলিন্য হারাচ্ছে মালদার আম৷

মালদা, 6 জুন : আমের জেলা মালদা ৷ আম এই জেলার অর্থনীতির ভিত্তি ৷ জেলার প্রায় ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়৷ প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর লকডাউন জেলার আমচাষকে প্রবল ধাক্কা দিয়েছে ৷ কিন্তু যদি এই দুটি বিষয় না থাকত, তবেও কি জেলার আমের সঠিক দাম মিলত? প্রশ্নটা চাষি, ব্যবসায়ী, এমনকি সরকারি মহলেও৷ কারণ, গত কয়েক বছর ধরেই চাহিদা কমছে জেলার উৎপাদিত আমের সংখ্যা ৷ ধাক্কা খাচ্ছে অর্থনীতি৷ আগে এই জেলার আম বিদেশযাত্রা করলেও গত কয়েক বছর ধরে আমের বিদেশ যাত্রাতে পড়েছে ছেদ৷ শুধু বিদেশে নয়, ভিনরাজ্যেও এই জেলার উৎপাদিত আমের চাহিদা ক্রমশ নিম্নমুখী৷ এখন শুধুমাত্র অসম, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের চাহিদাই বাঁচিয়ে রেখেছে মালদার আমকে৷ তবে আশঙ্কা রয়েই য়াচ্ছে যে এই তিন রাজ্যেও আর কতদিন মালদার আমের চাহিদা থাকবে৷ এর মূল কারণ, এই জেলার আমচাষে অপর্যাপ্ত কীটনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার৷ মুকুল থেকে আম পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত ১০-১২ বার গাছে কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে৷ মুকুল আসার আগে অধিক ফলনের আশায় গাছের গোড়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক৷ অপরিপক্ক আম পাকানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড৷ এসবের প্রভাব থেকে যাচ্ছে পাকা আমেও৷ মানুষের শরীরের পক্ষে তা হানিকারক বলে জানাচ্ছে খোদ চাষিরাই৷ কিন্তু তাদের বক্তব্য, ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখতে হলে এসব ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নেই৷ গোটা ঘটনার প্রভাব যে জেলার অর্থনীতির ভিত নড়িয়ে দিচ্ছে তা মেনে নিচ্ছে জেলা উদ্যানপালন দপ্তরও৷ দপ্তরের পক্ষ থেকে চাষিদের এই নিয়ে বারবার সচেতন করা হচ্ছে৷ কিন্তু তা বিশেষ কাজে আসছে না বলে জানাচ্ছেন দপ্তরের কর্তারা৷

মালদা জেলার আম ইতিহাস অতি প্রাচীন৷ ৫০০ বছর আগেও এখানে আমচাষের প্রচলন ছিল৷ জানা যায়, এই জেলার আম পাড়ি দিত মুঘল দরবারে৷ পাড়ি দিত মধ্যপ্রাচ্য সহ ইউরোপিয়ান দেশগুলিতেও৷ জেলায় ৩৫০টিরও বেশি প্রজাতির আমের নাম রয়েছে৷ বর্তমানে প্রতি মরশুমে গড়ে অন্তত আড়াই লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়৷ কিন্তু সময়ের সঙ্গে আমচাষেও এসেছে অনেক পরিবর্তন৷ কয়েক দশক আগেও যেখানে গোটা জেলায় জৈবিক পদ্ধতিতে আম চাষ করা হত, এখন সেই জায়গার দখল নিয়েছে রাসায়নিক সামগ্রী৷ এতে বেশ বড় প্রভাব পড়েছে জেলার আম ব্যবসায়৷

বিষয়টি নিয়ে জেলা উদ্যানপালন দপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর কৃষ্ণেন্দু প্রধান বলেন, “আমের জেলা হিসাবেই মালদার নাম গোটা বিশ্বে সমাদৃত৷ এই জেলায় ৩০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে আম চাষ হয়৷ আমরা সারা বছর আমচাষিদের ট্রেনিং দিই৷ মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের কুফল নিয়ে সবসময় চাষিদের বোঝাই৷ তাদের পইপই করে বলে দেওয়া হয়, কোনও কোনও কীটনাশক কী মাত্রায় কখন ব্যবহার করতে হবে৷ কিন্তু সবকিছু জেনেও কিছু চাষি কীটনাশকের মাত্রায় হেরফের করে৷ বেশি মাত্রায় এবং অপরিমিতভাবে কীটনাশক প্রয়োগ করে৷ একটি বিষয় ঠিক, এই জেলায় কোথাও নিষিদ্ধ কীটনাশক আমচাষে ব্যবহার করা হয় না৷ কিন্তু বৈধ কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগে সমস্যা দেখা দিচ্ছে৷ দপ্তরের পক্ষ থেকে আমরা কৃষকদের বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি৷ তাদের বারবার বলছি, যতটা কম সম্ভব কীটনাশক ব্যবহার করতে৷ সুখের কথা, অনেক চাষি আমাদের পরামর্শ মেনে কাজ করছে৷ তাদের অনেকেই বুঝতে পেরেছে, কোন কীটনাশক কী মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে৷ তবে এখনও আমাদের এনিয়ে আরও কাজ করতে হবে৷” কৃষ্ণেন্দুবাবু আরও বলেন, “এই জেলায় আমচাষ নিয়ে আমাদের আরও একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, এখানে আম ব্যবসায়ীরা বাগান মালিকের কাছ থেকে বাগান লিজে নিয়ে নেয়৷ তারাই সেখানে আমগাছের দেখাশোনা করে৷ চাষও করে ব্যবসায়ীরাই৷ জেলার প্রায় ৭০ শতাংশ বাগানে এই পদ্ধতিতেই আমচাষ হয়৷ ব্যবসায়ীরা আমগাছ কিংবা ফলের গুণাগুণের কথা ভাবে না৷ তাদের মূল লক্ষ্য ফলন বৃদ্ধি৷ তার জন্য তারা গাছে প্যাক্লোবুটরাজল নামে একটি রাসায়নিক ব্যবহার করে৷ এটা নিষিদ্ধ না হলেও এই রাসায়নিক ব্যবহারের কিছু নিয়মবিধি রয়েছে৷ এক বছর ব্যবহার করার পর অন্তত ২-৩ বছর এই রাসায়নিক ব্যবহার করা যায় না৷ এতে গাছের ক্ষতি হয়৷ আমরা এই রাসায়নিকের ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি৷ তাছাড়া এই জেলার চাষিরা আমগাছে অপর্যাপ্তভাবে কীটনাশক ব্যবহার করে৷ এতে একদিকে যেমন পোকামাকড়ের প্রতিরোধ শক্তি বেড়ে যায়, তেমনই উৎপাদিত ফলে কীটনাশকের প্রভাবও থেকে যায়৷ ফলে সেই আম খেলে মানুষের শরীরেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে৷ অপরিপক্ক আম পাকানোর জন্য যথেচ্ছ হারে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করা হচ্ছে৷ এই রাসায়নিক ব্যবহার কিন্তু সম্পূর্ণ বেআইনি৷ আমরা কৃষকদের এসব নিয়ে সচেতন করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি৷ তাদের বলছি, সঠিক আমচাষের জন্য বছরভর কাজ করতে হবে৷ বাগানের মাটি চাষ করতে হবে৷ যাতে সূর্যালোকে মাটিতে থাকা ক্ষতিকর জীবাণু, এমনকি কিছু পোকামাকড়ও মরে যায়৷ শুধু মরশুমে রাসায়নিক কিংবা কীটনাশক ব্যবহার করলেই চলবে না৷”

অন্যদিকে আমচাষি কিংবা ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, কীটনাশক ব্যবহার না করলে জেলা থেকে আমচাষই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে৷ বর্তমানে জৈবিক পদ্ধতিতে কিংবা উদ্যানপালন দপ্তরের সমস্ত বিধিনিষেধ মেনে আমচাষ করা কিছুতেই সম্ভব নয়৷ ইংরেজবাজারের লিজে বাগান কেনা এক আমচাষি ফিরোজ আলি বলেন, “আমরা বাগান মালিকের কাছ থেকে লিজে বাগান কিনি৷ এরপর বাগান মালিক আর গাছের দিকে ঘুরেও তাকায় না৷ চাষের সমস্ত ঝোক্কি আমাদেরই সামাল দিতে হয়৷ খরচও আমাদের বহন করতে হয়৷ এক লাখ টাকা দিয়ে বাগান কিনলে তাতে আরও এক লাখ টাকা চাষে খরচ হয়৷ অন্তত ১০ বার কীটনাশক স্প্রে করতে হয়৷ ফলন বাড়ানোর রাসায়নিক দিয়ে চাষ শুরু হয়৷ এরপর বিভিন্ন কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়৷ মুকুল বেরোনোর সময় থেকে আম পাড়ার ১৫ দিন আগে পর্যন্ত এই কাজ চলে৷ আমরা বুঝতে পারি, এত কীটনাশক ব্যবহার করার জন্য ব্যবসায় প্রভাব পড়ছে৷ আমের দাম দিন দিন কমে যাচ্ছে৷ কিন্তু এভাবে কীটনাশক ব্যবহার করা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায়ও নেই৷ কীটনাশকের প্রভাব ফলের ভিতর থেকে যাওয়ায় এই আম খেয়ে মানুষের শরীরেও প্রভাব পড়ে৷ সেটা আমরা জানি৷ আজ যদি সরকার এসব কীটনাশক নিষিদ্ধ করে দেয়, তবে আমাদেরও সেভাবে চাষের ধরন বদলাতে হবে৷ অনেক দেশেই এসব কীটনাশক কিংবা রাসায়নিক আম চাষে ব্যবহার করা হয় না৷ কিন্তু এখানে এই সমস্ত কীটনাশক এখনও নিষিদ্ধ ঘোষিত না হওয়ায় আমরাও এসবের ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি৷ এসব ব্যবহার না করলে গাছ থেকে একটা আমও পাওয়া যাবে না৷”প্রায় একই বক্তব্য পুরাতন মালদার আমচাষি সাহেব দাসের৷ তিনি বলেন, “এই জেলার আম দেশ সহ বিদেশেও যায়৷ দিন দিন বাগানের দাম বেড়ে যাচ্ছে৷ অথচ আমের তেমন ফলন বাড়ছে না৷ ফলন বাড়ানোর জন্যই আমাদের আম চাষে বেশি মাত্রায় রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার করতে হচ্ছে৷ আমরা মরশুমে ১০ থেকে ১২ বার কীটনাশক স্প্রে করি৷ তা না হলে আমে পোকা ধরে যাবে৷ গাছেই আম পচে যাবে৷ ফলন বাড়ানোর রাসায়নিক ব্যবহার করায় গাছের ক্ষতি হয়৷ কীটনাশক ব্যবহারের জন্য মানুষের শরীরেও প্রভাব পড়ে৷ সবই জানি৷ কিন্তু নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে এসব ব্যবহার ছাড়া আমাদের কোনও উপায় নেই৷ বাজারের পরিস্থিতি দেখে এখন আমাদের পরিপক্ক হওয়ার আগেই গাছ থেকে আম পেড়ে নিতে হচ্ছে৷ অপরিপক্ক আম বাজারজাত করার জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি আমরা৷ এবার লকডাউনের জন্য আরও আগে আম পাড়ছি৷ সবারই ভয়, যদি ফের গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, তবে আমাদের পথে বসতে হবে৷ এখন সরকার যদি এসব রাসায়নিক কিংবা কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তাহলে আমাদের ব্যবসা শেষ হয়ে যাবে৷”

জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দপ্তর সূত্রে জানা যাচ্ছে, বর্তমানে এই জেলার আমচাষে মূলত ক্লোরপাইরিফস, লাম্বদা সইহালোথরিন, ওটাবেল সালফার, ইমিডাকলোপ্রিড প্রভৃতি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়৷ ছত্রাকনাশক হিসাবে ব্যবহৃত হয় ম্যানকোজেব, কারবেনডাজিম প্রভৃতি৷ এসবের ব্যবহার বৈধ ৷ তবে জেলার আমচাষিরা যথেচ্ছ হারে এসব প্রয়োগ করে জেলার আমচাষের সমস্যা বাড়াচ্ছে ৷ কৌলিন্য হারাচ্ছে মালদার আম৷

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.