মালদা, 15 জুন: একুশে সাফ হয়ে যাবে ৷ গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাম-কংগ্রেসের ভবিষ্যৎবলে দিয়েছিলেন তাবড় তৃণমূল নেতা-নেত্রীরা ৷ বাস্তবেও হয়েছিল তাই ৷ একসময় বাংলা শাসন করা বাম-কংগ্রেস গোটা রাজ্যে শূন্য ৷ দুই দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক কথা বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ৷ কীভাবে বাম-কংগ্রেস ফের নিজেদের অস্তিত্ব ফিরে পেতে পারে, তা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে একাধিক মত ৷ কিন্তু একসময় মালদা জেলা হাত-কাস্তে শিবিরকে যে পথ দেখিয়েছিল, সেই জোট রাজনীতিতেই ভরসা রেখেছে দুই দল ৷ ফলও মিলেছে হাতে-নাতে৷ সাগরদিঘি উপনির্বাচনে জিতেছেন বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস ৷ পরে তিনি অবশ্য তৃণমূলে ভিড়েছেন ৷ তবে বিধায়ক বাইরন ঘর বদল করলেও সাগরদিঘি কেন্দ্রের নির্বাচনি মডেল বাম-কংগ্রেসকে শিক্ষা দিয়েছে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় দুই দলকেই হাত ধরে চলতে হবে ৷
শিয়রে গ্রাম বাংলার ভোট ৷ চব্বিশের লোকসভার আগে এই ভোট বাম-কংগ্রেসের অগ্নিপরীক্ষা বলেই মনে করছে সবাই ৷ তৃণমূলের নবজোয়ার, তাদের শাসিত সরকারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী-সহ আরও অনেক জনহিতকর প্রকল্পের মতো বাঘা খেলোয়ারদের সঙ্গে সব হারানো বাম-কংগ্রেস কীভাবে লড়বে, তা নিয়ে উৎসুক রাজ্যবাসী ৷ বিশেষ করে মধ্যবঙ্গের তিনটি জেলায় ৷ মুর্শিদাবাদ, মালদা আর উত্তর দিনাজপুর একসময় ছিল কংগ্রেসের অলিখিত গড়৷ মুর্শিদাবাদে অধীররঞ্জন চৌধুরী, মালদায় এবিএ গণি খান চৌধুরী আর উত্তর দিনাজপুরে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, এই ত্রয়ীই দলের হাল ধরে রেখেছিলেন দীর্ঘ সময় ৷ গনি-প্রিয় এখন অতীত ৷ তিন জেলার গড় রক্ষার দায়িত্ব একা কুম্ভ অধীরের ৷
ঘাসফুলের রমরমায় পঞ্চায়েত ভোটের আগে তিন জেলাতেই এক অদ্ভুত ট্রেন্ড নজরে এসেছে ৷ এগারোর পর থেকে বাম-কংগ্রেসের যেসব কর্মীরা শাসকদলে ভিড়েছিলেন, তাঁদের একাংশ ফের পুরোনো দলে ফিরতে শুরু করেছেন ৷ সময় যত গড়াচ্ছে, ঘর ওয়াপসির হারও বাড়ছে বলেই মত রাজনীতিকদের ৷ এই মুহূর্তে তো যেন দৌড় প্রতিযোগিতা চলছে ৷ বাম দলগুলির থেকে সেই ছবিটা হাত শিবিরে অনেক বেশি ৷ মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের ভাঙন সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে ডোমকল মহকুমায়৷ এছাড়াও বড়ঞা, খড়গ্রাম, সামশেরগঞ্জ, রঘুনাথগঞ্জ, বেলডাঙা সহ একাধিক ব্লকে গ্রামীণ ভোটের আগে ঘাসফুলে ঘুন ধরার ছবি স্পষ্ট ৷ প্রায় প্রতিদিনই তৃণমূল থেকে আসা কর্মীদের স্রোত মিশে যাচ্ছে কংগ্রেস ৷ ব্যতিক্রম নয় মালদাও ৷ কালিয়াচক এক ও দুই নম্বর ব্লক থেকে শুরু করে মানিকচক, রতুয়া, চাঁচল, হরিশ্চন্দ্রপুর জুড়ে একই ছবি৷ উত্তর দিনাজপুরেও ইসলামপুর থেকে শুরু করে কালিয়াগঞ্জ, এমনকি ইটাহারেও তৃণমূলে দেখা দিয়েছে ভাঙন৷ এই ভাঙনের গতি হার মানাচ্ছে মালদার গঙ্গাকেও৷
কেন এমন হল? প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে শাসকদলের থিংক ট্যাংকও ৷ কিন্তু উত্তর খুঁজে পাওয়ার আগেই দুয়ারে চলে এসেছে ভোট ৷ ঘাসফুলের অন্দরমহল থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এই ঘটনার পিছনে একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছে তারা ৷ দলের দুর্নীতি এখন সীমাহীন ৷ নীচুতলার কর্মীদের এখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেউ ৷ কারণ, যে নেতৃত্ব নীচুতলার কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করবে, তারাই দুর্নীতির পাঁকে আকণ্ঠ ডুবে৷ গ্রামে গ্রামে তৃণমূল কর্মীদের দাপটও আর মানতে পারছে না কেউ৷ যারা একসময় পেট ভরে খেতে পেত না, ঘাসফুলের জামা পরে তারা এখন প্রাসাদপম বাড়িতে থাকে, তাদের চারচাকার গাড়ির চাকার ধুলোয় ঢাকা পড়ে গ্রামবাসীরা৷ এর সঙ্গে রয়েছে সীমাহীন স্বজনপোষণ৷ যে কোনও কাজে কাটমানি, নিয়োগ দুর্নীতি, সবই শাসকদলকে একটু একটু করে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে একাশ মানুষের পাশ থেকে৷ কর্মীরাও নেতৃত্বের প্রতি বীতশ্রদ্ধ৷ নীচুতলার কর্মীদের সিংহভাগ কোনও সুযোগই পান না৷ না সরকারি, না দলীয়৷ সবটাই চেটেপুটে নেয় উপরতলা৷
যে কারণে মুর্শিদাবাদ-মালদা-উত্তর দিনাজপুরের অনেক জনপ্রতিনিধিও পঞ্চায়েত ভোটের মুখে কংগ্রেসে ফিরে আসছেন৷ দলে দলে৷ এমনকি জেলা পরিষদের তৃণমূলের সদস্য এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন৷ তার প্রমাণও রয়েছে৷ তিন জেলার রাজনৈতিক মহল একমত, দিন যত গড়াবে, এই ট্রেন্ড আরও বাড়বে৷ যদি সেটাই হয়, তবে চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে ঘাসফুল নুইয়ে পড়তে পারে৷ অন্তত এই তিন জেলায়৷ তবে মধ্যবঙ্গের সংক্রমণ যে অন্য কোথাও ছড়াবে না, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না৷ বিষয়টি বুঝে রাজ্য পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন দলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড৷ প্রতিটি জেলায় দলের হাল হকিকত বোঝার চেষ্টা করেছেন তিনি৷ তাঁর সামনেই বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে৷ পথ অবরোধ হয়েছে৷ তিনি একাধিক নিদানও দিয়েছেন৷ কিন্তু সেসব কি কেউ মানছে? প্রশ্নটা থেকেই যায়৷ এতদিন রীতিমতো ঢাকঢোল বাজিয়ে, সাংবাদিকদের ডেকে শাসকদল প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করত৷ কিন্তু এবার সেই তালিকা রাজ্যের কোনও জেলায় ঘোষণাই করা হয়নি৷ শুধু প্রার্থীদের টেলিফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ কেন এত গোপনীয়তা! নাকি প্রার্থী নিয়ে বিদ্রোহের আতঙ্ক!
আরও পড়ুন: শুক্রবারই ভাঙড়ে যাচ্ছেন রাজ্যপাল, কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি আনন্দ বোসের
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী পরিষ্কার বলেন, “আমরা সাগরদিঘি মডেল এরাজ্যে ধরে রাখতে চাই৷ সাগরদিঘিতে মানুষ নির্ভয়ে ভোট দিতে পেরেছে৷ তাই ভোট কিংবা জোট, সাগরদিঘিই মডেল হোক৷ আমাদের প্রার্থী চলে গিয়েছে, যাক৷ তবে সে চলে গেলেও মডেল থেকে গিয়েছে৷ আর বারবার বায়রন বিশ্বাসের বাহানা বানিয়ে ভোটারদের বিভ্রান্ত করা যাবে না৷ মানুষ এখন পঙ্গপালের মতো কংগ্রেসের দিকে ছুটছে৷ আসলে তৃণমূলে মহামারী শুরু হয়ে গিয়েছে৷ কোনও সমঝদার লোক মহামারী প্রবণ এলাকায় যেতে চাইবে না৷” মাথায় রাখতে হবে, পঞ্চায়েত মিটলে আট থেকে ন’মাস পরেই লোকসভা ভোট৷ তৃণমূল ছাড়ার এই হিড়িক অব্যাহত থাকলে সেই ভোট কিন্তু ঘাসফুলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ সেটা অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন তৃণমূলনেত্রী৷ তবে ঘরে ভাঙন দেখেও দলনেত্রী হিসাবে এখনও তাঁর নিশ্চুপ থাকাটা অনেকের কাছেই বিস্ময়ের৷