মালদা, 26 অগস্ট: মৃত্যু তাঁকে খুঁজতে এসেও না পেয়ে ফিরে গিয়েছে ৷ এমনটাই বলছেন কোকলামারি চৌদুয়ার গ্রামের আজারুল হক ৷ বুধবার সকালে যখন দুর্ঘটনার খবর পেয়েছিলেন, তিনিই প্রথম মিজোরামে পরিচিতদের ফোন করে গোটা ঘটনা জেনেছিলেন ৷ তাঁর মুখ থেকে দুর্ঘটনার বৃত্তান্ত জেনেছিল গোটা গ্রাম ৷ প্রাণে বেঁচে আজারুল এখন শুধু আল্লার কাছেই দোয়া করছেন ৷ আর চিন্তা করছেন, ফের কীভাবে ওই কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাবেন ! যাঁদের সঙ্গে এতদিন একই জায়গায় কাজ করেছেন, সেখানে আর তিনি কাজে যেতে পারবেন কি ?
আগের একটি দুর্ঘটনা প্রাণে বাঁচিয়েছে চৌদুয়ারের আজারুলকে ৷ মিজোরামের সাইরাংয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি রেল ব্রিজ নির্মাণের কাজ করছিলেন ৷ বছর খানেক আগে অসতর্কতাবশত ব্রিজের উপর থেকে পড়ে যান ৷ চোয়াল ভেঙে যায় তাঁর ৷ বুধবারের দুর্ঘটনায় যে 23 জন প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বাড়ি ফিরেছিলেন ৷ পঞ্চায়েত ভোটপর্ব শেষে মাস দেড়েক আগে যখন বাকিরা কর্মস্থলে ফিরে যান ৷ আজারুলের ভাঙা চোয়ালের ব্যথাটা ফের বেড়েছিল ৷ সহকর্মীদের জানিয়েছিলেন, খানিকটা সুস্থ হয়ে তিনি কাজে যোগ দেবেন ৷ সেই সিদ্ধান্তই প্রাণে বাঁচিয়েছে তাঁকে ৷
দুর্ঘটনার চারদিন পরেও সহকর্মীদের মৃত্যুর আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি আজারুল ৷ তার মধ্যেও তিনি বলেন, “পুরো এলাকাটা পাহাড়ি ৷ জীবন ধারণ করা খুব কষ্ট সেখানে ৷ পয়সার জন্য সেখানেও আমাদের কাজে যেতে হচ্ছে ৷ কী করব ! এলাকায় তো কাজকর্ম নেই ৷ ওখানে আমি সাত মাস সাতদিন কাজ করে ভোটের চারদিন আগে বাড়ি ফিরেছিলাম ৷ তার পর আর মিজোরাম যাইনি ৷ বাড়িতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ি ৷ এক বছর আগে ওই নির্মীয়মান ব্রিজ থেকেই পড়ে গিয়েছিলাম ৷ চোয়ালের হাড় ভেঙে গিয়েছিল ৷ সেখানে প্লেট বসাতে হয়েছে ৷ সেই ব্যথাই ফের বেড়েছে ৷ ওখানে ডাক্তারের সমস্যা ৷ খাবারও ঠিকমতো পাওয়া যায় না ৷ তাই ভেবেছিলাম, পুরো সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দেব ৷ কিন্তু, তার মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে গেল ৷ কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, ব্রিজটা ভাঙল কীভাবে ? ওই ব্রিজ তো ভেঙে পড়ার কথা নয় ৷ বাকিদের সঙ্গে না গিয়েই প্রাণে বেঁচে গিয়েছি ৷ উপরওয়ালা বাঁচিয়ে দিয়েছেন ৷”
আরও পড়ুন: মিজোরামে নিহত শ্রমিকের পরিবারের হাতে রেলের তরফে আর্থিক সাহায্য তুলে দিলেন রাজ্যপাল
মালদা জেলায় পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন পাঁচ লক্ষের বেশি ৷ এই মুহূর্তে অবশ্য জেলা প্রশাসনের কাছে এই শ্রমিকদের বিষয়ে সঠিক কোনও তথ্য নেই ৷ কোভিডের সময় প্রশাসন দেড় লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে খাবার বিলি করেছিল ৷ সেই অনুযায়ী, প্রশাসনিক হিসাবে জেলায় পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা দেড় লক্ষ ৷ সম্প্রতি রাজ্য সরকার এই শ্রমিকদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে একটি অ্যাপ চালু করেছে ৷
আগামী 16 সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের সেই অ্যাপে নিজেদের তথ্য আপলোড করতে বলা হয়েছে ৷ কিন্তু, এ নিয়ে জেলায় এখনও তেমন প্রচার করা হয়নি ৷ জেলাশাসক জানিয়েছেন, সোমবার থেকে জেলা জুড়ে এই অ্যাপ নিয়ে প্রচার চালানো হবে ৷ গ্রামেগঞ্জে মাইকিংও করা হবে ৷
আরও পড়ুন: শ্রমিকদের রাজ্যে ফিরে মদ বিক্রির পরামর্শ মুখ্যমন্ত্রীর ! মালদায় এসে তোপ দাগলেন অধীর
যদিও এই অ্যাপ করেও তেমন কোনও লাভ হবে না বলে মনে করছেন শ্রমিক সংগঠন সিটুর জেলা সম্পাদক দেবজ্যোতি সিনহা ৷ তাঁর অভিযোগ, “বাংলায় শ্রমিকদের জন্য কোনও কাজ নেই ৷ এর কারণ মূলত তিনটি ৷ প্রথমত, তৃণমূল পরিচালিত সরকারের আমলে রাজ্যে একটি কারখানাও তৈরি হয়নি ৷ যারা কারখানা গড়ছিল, তৃণমূল-বিজেপি-মাওবাদীরা ষড়যন্ত্র করে তাদের এখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে ৷ দ্বিতীয়ত, রাজ্যে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে না ৷ ফলে বড় আকারের নির্মাণ কাজ পুরোপুরি বন্ধ ৷’’
ওই বাম নেতা অভিযোগ করেছেন মালদা জেলার পরিযায়ীদের 90 শতাংশই নির্মাণ শ্রমিক ৷ পাশাপাশি 100 দিনের কাজে ব্যাপক লুঠের কারণে শ্রমিকরা বাইরে চলে যাচ্ছেন বলে জানান দেবজ্যোতি সিনহা ৷ তাঁর দাবি, প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে বছরে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার কাজ বরাদ্দ হয় ৷ কিন্তু সেই টাকার প্রায় পুরো অংশ চলে যায় শাসকদলের নেতাদের কাছে ৷