মালদা, 15 মে : অনুকূল আবহাওয়া আছে, নেই কোনও রোগ কিংবা পোকামাকড়ের উপদ্রব ৷ তবুও প্রভাব পড়েছে মালদা জেলার অর্থনীতিতে ৷ হ্যাঁ, মালদার বিখ্যাত আম নিয়েই কথা হচ্ছে ৷ জেলার আমবাগানগুলিতে আমের ভারে গাছ ঝুঁকে পড়ছে ৷ গাছ বাঁচাতে দেওয়া হয়েছে বাঁশের খুঁটি ৷ গাছ থেকে আম পাড়ার সময় এসে গেলেও করোনা পরিস্থিতি ও কার্যত লকডাউনের জেরে মিলছে না ক্রেতার দেখা ৷ ফলে গতবারের মত এবারও আম চাষি এবং ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ৷ ভয় একটাই, এবারও কপাল পুড়বে না তো ?
মালদা জেলায় 32 হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে আমবাগান রয়েছে ৷ তবে এবার চাষের পরিমাণ কিছুটা কমেছে বলে জেলা উদ্যানপালন দফতর সূত্রে খবর ৷ জানা গিয়েছে, এ বছর জেলায় প্রায় 31 হাজার হেক্টর জমিতে আমচাষ হচ্ছে ৷ এ বিষয়ে দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর কৃষ্ণেন্দু নন্দন জানিয়েছেন, এবার জেলায় আমচাষের পরিস্থিতি খুব ভাল ৷ চলতি বছর কালবৈশাখীতে উত্তর মালদার কিছু অংশে চাষে কিছুটা ক্ষতি হলেও জেলায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের আশা রয়েছে ৷ কিন্তু করোনা আবহে উৎপাদিত আম বিক্রির ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হতে পারে ৷
আম চাষি শেখ রহমত আলি জানান, “গতবারের তুলনায় এবার আমের উৎপাদন ভাল ৷ কিন্তু করোনা আর কার্যত লকডাউন আমাদের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ এখনও পর্যন্ত আমের কোনও ক্রেতা নেই ৷ ভিন জেলা কিংবা ভিন রাজ্যের কোনও ব্যবসায়ী এখনও আম কেনার জন্য যোগাযোগ করেননি ৷ তাঁদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করছি ৷ কিন্তু এখনই তাঁরা আম কিনতে রাজি নন ৷ মনে হচ্ছে, এবার আম বিক্রি করতে আমাদের ঝামেলায় পড়তে হবে ৷ এই অবস্থায় সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, জেলার উৎপাদিত আম বিক্রির যেন ব্যবস্থা করা হয়৷”
প্রায় একই বক্তব্য আরেক আম চাষি সুশান্ত চৌধুরীর ৷ তিনি বলেন, “পরিস্থিতি খুবই খারাপ ৷ এতদিনে অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ড সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীদের আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ছিল ৷ কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁরা কেউ আম কেনার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি ৷ এবার আমের খুব ভালো ফলন হয়েছে ৷ এত আম কী করব জানি না ৷ ধার-দেনা করে চাষ করেছি ৷ আম বিক্রি করতে না পারলে বিষ খেয়ে মরা ছাড়া আমাদের কোনও উপায় থাকবে না ৷ করোনা আর কার্যত লকডাউন আমাদের ফের পথে বসাতে যাচ্ছে ৷”
একসময়ের জেলা পরিষদের সভাধিপতি মালদা ম্যাঙ্গো মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক উজ্জ্বলকুমার চৌধুরী বলেন, “এই জেলায় একবছর পরপর আমের উৎপাদন ভাল হয় ৷ এবারও জেলায় খুব ভাল আমের ফলন ৷ করোনার জন্য বিধিনিষেধ যদি আরও কঠোর হয়, তাহলে এবার আম বিক্রি করতে চাষিদের প্রচণ্ড সমস্যায় পড়তে হবে ৷ কারণ, গাছে আম বেশিদিন রাখা যায় না ৷ চাষিরা যাতে উৎপাদিত আম বিক্রি করতে পারেন, তার জন্য আমরা বিভিন্ন জায়গায় আবেদন জানাব ৷ করোনার জন্য দিল্লিতে আম মেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ এই পরিস্থিতিতে বিদেশে কিছুতেই আম পাঠানো যাবে না ৷ সভাধিপতি থাকাকালীন আমি জেলায় আমের প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলার জন্য বারবার দাবি জানিয়েছিলাম ৷ কারণ, মালদার বেশিরভাগ আম বর্ষায় পাকে ৷ সেই সময় আম সংরক্ষণ করা কার্যত অসম্ভব ৷ তার উপর এখানকার অনেক আমবাগান তুঁতের জমিতে তৈরি ৷ ফলে মাটি অসমান হওয়ায় অনেক আমই পচে নষ্ট হয় ৷ এই সমস্যা দূর করতে এই জেলায় আমের আচার সহ অন্যান্য উপজাত সামগ্রীর বড় শিল্প গড়ে তুলতেই হবে ৷”
আরও পড়ুন : আজ থেকে কার্যত লকডাউন রাজ্যে, কী কী থাকছে বন্ধ, কী কী থাকবে খোলা;দেখে নিন
মালদা ব্যবসায়ী সমিতি তথা মালদা মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সের সম্পাদক জয়ন্ত কুণ্ডু বলেন, “গত বছর আমের মরশুমে গোটা দেশে পূর্ণ লকডাউন চলছিল ৷ এবার আবহাওয়া ভাল থাকায় জেলায় আমের ফলনও খুব ভাল ৷ প্রতি বছর জেলায় 100 কোটি টাকার বেশি আম কেনাবেচা হয় ৷ উপজাত সামগ্রী ধরলে টাকার অঙ্কটা আরও বেশি ৷ যা পরিস্থিতি তাতে আমাদের ধারণা, ভাল উৎপাদন হলেও কার্যত লকডাউনের জন্যে এবার জেলার চাষিরা আম বিক্রি করতে পারবেন না ৷ আমরা ইতিমধ্যে বিষয়টি জেলার মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনকে জানিয়েছি ৷ তিনি এনিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানালে কিছু কাজ হতে পারে ৷”
মালদার ফজলি, লক্ষ্মণভোগ, হিমসাগর ও ল্যাংড়া আমের নাম বিশ্বজুড়ে ৷ কিন্তু এখন গোটা বিশ্বে একটাই নাম আলোচিত আর তা হল করোনা ৷ এর জের কতদিন চলবে, তা জানে না কেউ ৷ কিন্তু এই মারণ ভাইরাসের জন্য মালদার আম শিল্প যে বিপন্ন, তা নিয়ে কারও কোনও দ্বিমত নেই ৷ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এবার আরও ভয়ঙ্কর আঘাত হানতে চলেছে জেলার অর্থনীতিতে ৷ বিধ্বস্ত হতে চলেছে মালদার আমের ব্যবসা ৷