মালদা, ২৮ অক্টোবর : এই কালীপুজোয় কোনও পুরোহিত লাগে না। সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণও শোনা যায় না। অথচ পুজোয় মায়ের উদ্দেশ্যে জীবের প্রাণ নিবেদন করা হয়। এই পুজো গ্রামবাসীদের প্রাণের পুজো। শ’খানেক বছর ধরে এমনই এক কালীপুজো করে আসছেন আদিবাসীরা।
পুরাতন মালদার যাত্রাডাঙা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত আদিবাসী গ্রাম গোবিন্দপুর। মালদা শহর থেকে এই গ্রামের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। গ্রামে দুটি পাড়া। দুই পাড়া মিলিয়ে ৯১ ঘর মানুষের বাস। সবাই আদিবাসী। এই আদিবাসী গ্রামেই সেই ব্রিটিশ আমল থেকে হয়ে আসছে কালীপুজো। কখনও তা বন্ধ হয়নি। এই পুজোয় কোনও পুরোহিত লাগে না, গ্রামবাসীরা নিজেরাই এই পুজো করেন ৷ পুজোয় হয় পাঁঠাবলিও ৷
গ্রামের বাসিন্দা চান্দরাই কিস্কু বলেছেন, “৮০-৯০ বছরের বেশি সময় ধরে এই পুজো হয়ে আসছে। আমরাই পুজো করি। গ্রামের সবাই আদিবাসী। দুই পাড়া মিলিয়ে ৯১ ঘর মানুষের বাস । প্রতি ঘর থেকে এক হাজার টাকা করে চাঁদা তোলা হয় পুজোর জন্য। সেই চাঁদার টাকাতেই আমরা পুজো করি। পুজোয় বলিপ্রথা রয়েছে। প্রতি বছর ২০-২৫টা পাঁঠা বলি হয়। শুধু এই গ্রামের মানুষ নয়, বাইরের গ্রাম থেকেও মানুষ পুজো আর মেলা দেখতে আসে এখানে।"
এই পুজো শুরুর একটা ইতিহাস আছে ৷ এ প্রসঙ্গে গ্রামের মোড়ল ভাগমাত সোরেন বলেন, “কীভাবে এই পুজো চালু হয়েছিল তা সঠিক জানি না। তবে ঠাকুরদাদের মুখে যতদূর শুনেছি, একসময় এখানে পুরোটাই ঘন জঙ্গল ছিল। কোনও বসতি ছিল না। পাশে একটিমাত্র গ্রাম ছিল। এখানে তখন গরু-বাছুর চড়ত। হঠাৎ দেখা যায়, গরু, বাছুর, এমনকি অনেকের ছোট বাচ্চাও এখান থেকে গায়েব হয়ে যাচ্ছে। সেই সময় কোনও একজনের নজরে পড়ে, এখানকার জঙ্গলে বাঘ রয়েছে। সেই বাঘের খোঁজে বেরিয়ে গ্রামবাসীরা এখানকার একটি উঁচু ঢিবিতে দেবতাকেও দেখতে পান। তখন অনেক বয়স্ক মানুষ ছিলেন, ওঝা-গুণিন ছিলেন। তাঁরা সবাই পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন, এখানে কালীমায়ের পুজো দিতে হবে। তাহলেই আমাদের এলাকা শান্ত থাকবে। তারপর থেকেই এই পুজো শুরু হয়। পরে এখানে জঙ্গল কেটে বসতি তৈরি হয়েছে। তবে পুজো এখনও হয়ে আসছে ।"
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বছর দশেক আগেও গোবিন্দপুর গ্রামে কালীমন্দির ছিল না। তখনও সেই উঁচু ঢিবির উপর গাছের কোটরে মায়ের মূর্তি তুলে পুজো হত। আদিবাসী পুরুষ ও মহিলারা নিজেদের ইচ্ছেমতো মায়ের পুজো দিতেন। বিকেলে মাদল-ধামসার দ্রিম দ্রিম বোলের ছন্দে নাচে মেতে উঠতেন সবাই। রাতভর চলত নাচগানের আসর। মন্দির নির্মাণের পর থেকে সেই ছবি আর সেভাবে দেখতে পাওয়া যায় না।