কলকাতা, 25 ডিসেম্বর: পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং সেই ভোটকে ঘিরে হওয়া হিংসা যদি 2023 সালে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘটনা হয়ে থাকে, তাহলে পিছিয়ে থাকবে না তৃণমূল কংগ্রেসের দিদির দূত, নবজোয়ারের মতো কর্মসূচিও ৷ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিজেপি কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও গেরুয়া শিবিরের শীর্ষনেতা তথা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দেওয়া লোকসভা নির্বাচনে 35 আসন জয়ের টার্গেট এই রাজ্যে আলোচনায় রেখেছিল শুভেন্দু অধিকারী-সুকান্ত মজুমদারদের ৷ বছরের শেষলগ্নে রাজনীতির বাইরের অনুষ্ঠান নিয়ে যেভাবে রাজনৈতিক ময়দান গরম হয়ে উঠল, তা নিশ্চিতভাবেই ঠাঁই পেতে পারে 2023 সালের বঙ্গ-রাজনীতির রঙ্গমঞ্চকে ফিরে দেখতে গিয়ে ৷
পঞ্চায়েত নির্বাচন: গ্রাম বাংলার ভোট ৷ পঞ্চায়েত নির্বাচনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় ৷ কারণ, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অংশের প্রশাসক ঠিক হয় এই ভোটের মাধ্যমেই ৷ তিনটি স্তর- গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ ৷ এবার 8 জুলাই এই তিনটিস্তরে ভোট হয় ৷ গণনা হয় 11 জুলাই৷ ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায় শাসক দল তৃণমূল প্রায় সাড়ে 35 হাজার গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে জিতেছে ৷ দ্বিতীয়স্থানে বিজেপি ৷ তারা প্রায় 9700 আসনে জিতেছে ৷ বাম ও কংগ্রেস মিলিয়ে প্রায় 6800 আসনে জয় পায় ৷
পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূল জেতে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার আসনে ৷ বিজেপির আসন জয়ের সংখ্যা প্রায় এক হাজার ৷ বাম ও কংগ্রেস প্রায় সাড়ে চারশো আসনে জিতেছে ৷ রাজ্যের সবক’টি জেলা পরিষদ তৃণমূলের দখলেই গিয়েছে ৷ আসন সংখ্যার পরিসংখ্যান অনুযায়ী - তৃণমূল 877, বিজেপি 26 ও বাম-কংগ্রেস 17টি আসনে জিতেছে ৷ ভোট শতাংশের হিসেবে - তৃণমূল 51, বিজেপি 23, বামফ্রন্ট 14 ও কংগ্রেস 7 ৷
পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসা: এবার পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তার থেকেও বেশি আলোচনা হয়েছে ভোট প্রক্রিয়া ও হিংসা নিয়ে ৷ 8 জুলাই নির্বাচন করার কথা ঘোষণা করা হয় 8 জুন ৷ মনোনয়নের জন্য সময়সীমা নিয়ে আপত্তি তোলে বিরোধীরা ৷ তাছাড়া কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে টানাপোড়েন চলে ৷ শেষে আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় ভোট হয় ৷ তাছাড়া মনোনয়ন পেশ নিয়েও একাধিক মামলায় আদালতকে একাধিক নির্দেশ দিতে হয়েছে ৷
তার পরও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় হিংসা হয়েছে ৷ বিশেষ করে মনোনয়ন পেশকে কেন্দ্র করে হিংসার ছবি সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে ৷ বোমাবাজি, গুলির লড়াইয়ের সাক্ষী থেকেছে দক্ষিণ 24 পরগনার ভাঙড় থেকে রাজ্যের বিভিন্ন অংশ ৷ একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, 2023 সালের 8 জুন থেকে 16 জুলাইয়ের মধ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে হওয়া হিংসায় 55 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ এর মধ্য়ে ভোটের দিনই 18 জনের মৃত্যু হয় ৷
অভিষেকের নবজোয়ার ও দিদির দূত: পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে 2023 সালের শুরুতেই ময়দানে নেমে পড়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস ৷ জানুয়ারিতেই তারা দিদির সুরক্ষা কবচ নামে একটি কর্মসূচি শুরু করে ৷ সেখানে শাসক দলের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন ৷ অভাব-অভিযোগ শোনেন ৷ যাঁরা এই কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলেন, তাঁদের পোশাকি নাম হয় ‘দিদির দূত’, অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের দূত ৷
মাস দুয়েকের এই কর্মসূচি শেষ হতে না হতেই ময়দানে নেমে পড়েন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ এপ্রিলের শেষে কোচবিহার থেকে নতুন কর্মসূচি শুরু করেন তিনি ৷ যার নাম ছিল ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ ৷ পঞ্চায়েতের প্রার্থী সাধারণ মানুষ ঠিক করবে বলে জানানো হয় ওই কর্মসূচিতে ৷ বিভিন্ন জেলায় অভিষেক সভা করেন ৷ সেখানে প্রতীকী ব্যালটও দেওয়া হয় ৷ কিন্তু সেই ব্যালট ঘিরে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছবিও সামনে আসে ৷
কেন্দ্র বিরোধী আন্দোলন: 2023 সালের মার্চের শেষে কেন্দ্র বিরোধী বঞ্চনার অভিযোগ তুলে ধরনায় বসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ প্রথমে জানা গিয়েছিল তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ওই আন্দোলন করবেন ৷ পরে জানা যায় যে তৃণমূল নেত্রী হিসেবে কলকাতা রেড রোডে আম্বেদকর মূর্তির পাদদেশে তিনি ধরনা দেবেন ৷ তাঁর দু’দিনের ধরনার প্রথম দিনই আবার শহিদ মিনারের পাদদেশে সভা করে তৃণমূলের ছাত্র-যুবরা ৷ সেই সভা থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার ডাক দেন ৷ পরে তিনি নিজেও দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী গিরিরাজ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন ৷
এর পর গান্ধিজয়ন্তীর সময় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আবার যান দিল্লিতে ৷ সেখানে ধরনা দেন ৷ দেখা করার চেষ্টা করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে ৷ দেখা না পেয়ে ধরনায় বসেন ৷ পরে দিল্লি পুলিশ অভিষেক-সহ তৃণমূলের অন্য নেতা-নেত্রীদের সেখান থেকে আটক করেন ৷ কলকাতায় ফিরে একই ইস্যুতে রাজভবনের উলটোদিকে ধরনায় বসেন অভিষেক ৷ রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ধরনা তুলে নেন ৷
এর পর চলতি ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ নিয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে হাজির হন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তাঁর সঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেরেক ও’ব্রায়েনের মতো বেশ কয়েকজন তৃণমূল সাংসদও উপস্থিত ছিলেন ৷
গ্রেফতার জ্যোতিপ্রিয়-জীবনকৃষ্ণ: নিয়োগ দুর্নীতিতে চলতি বছরের অক্টোবরের একেবারে শেষে গ্রেফতার হন রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ৷ রেশন বণ্টন দুর্নীতিতে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় ৷ খাদ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি এই দুর্নীতিতে জড়িয়ে ছিলেন বলে অভিযোগ ৷ এছাড়া স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার হন মুর্শিদাবাদের বড়ঞার বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা ৷ তাঁকে গ্রেফতার করে সিবিআই ৷ এছাড়া এই বছর নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত সন্দেহে তৃণমূলের দুই যুবনেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় ও কুন্তল ঘোষকে গ্রেফতার করে তদন্তকারী সংস্থা ৷ একই দুর্নীতির অভিযোগে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকু ও অয়ন শীলকেও গ্রেফতার করা হয় ৷
বঙ্গ বিজেপিকে অমিত শাহের টার্গেট: চলতি বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি বীরভূমের সিউড়িতে এসে জনসভা করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৷ সেই সভা থেকে তিনি বঙ্গ বিজেপির জন্য লোকসভা নির্বাচনের টার্গেট বেঁধে দেন ৷ জানিয়ে দেন যে 2024 সালের লোকসভা নির্বাচনের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপি 35টি আসন জয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোবে ৷ নভেম্বরের শেষে কলকাতায় এসে সভা করেন অমিত শাহ ৷ সেখানে অবশ্য বিজেপির এই হেভিওয়েট নেতার মুখে সেভাবে লোকসভায় আসন জয়ের লক্ষ্যমাত্রার কথা শোনা যায়নি ৷ তবে ভোটের আগে কোন পথে নির্বাচনী প্রচারে ঝাঁপাবে বিজেপি, সেই দিকনির্দেশও অবশ্য দিয়ে গিয়েছেন গেরুয়া শিবিরের এই শীর্ষ নেতা ৷
জাতীয় সঙ্গীত বিতর্ক: নভেম্বরের শেষে বিধানসভা চত্বরে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ধরনা দেয় তৃণমূল ৷ অমিত শাহের সভা শেষে বিধানসভা চত্বরে পৌঁছে পালটা ধরনা ও স্লোগান দিতে শুরু করে বিজেপিও ৷ সেই সময় জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলান তৃণমূলের বিধায়করা ৷ তৃণমূলের অভিযোগ, বিজেপি তাতে অংশ নিয়ে জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা করেছে ৷ পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয় একাধিক বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে ৷ কলকাতা পুলিশ বেশ কয়েকজন বিজেপি বিধায়ককে তলবও করে ৷ তার পর বিজেপির তরফে বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা করা হয় ৷ আপাতত বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন ৷
সাগরদিঘি মডেল: 2011 সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস ৷ তার পর থেকে বিধানসভায় যতগুলি আসনে ভোট হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র দু’তিনটিতে পরাজয় হয়েছে বাংলার শাসক দলের ৷ এর মধ্যে অন্যতম মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি ৷ চলতি বছরের মার্চে ওই আসনে বিধানসভার উপ-নির্বাচন হয় ৷ সেখানে এতদিন বিধায়ক ছিলেন তৃণমূলের সুব্রত সাহা ৷ তাঁর প্রয়াণের জেরেই সেখানে উপ-নির্বাচন হয় ৷ ওই ভোটে বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী বায়রন বিশ্বাস জয়ী হন ৷
এই ভোটে জয় নিয়ে হইচই পড়ে রাজ্য রাজনীতিতে ৷ বিরোধীরা দাবি করে যে একজোট হয়ে লড়াই করলে তৃণমূলকে ধরাশায়ী করা সম্ভব ৷ ফলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মডেল হয়ে ওঠে সাগরদিঘি ৷ যা থেকে রাজ্য রাজনীতিতে ‘সাগরদিঘি মডেল’ কথাটির প্রচলন শুরু হয় ৷ কিন্তু মাস তিনেক পর কংগ্রেসের টিকিটে জেতা বায়রন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে তৃণমূলে যোগদান করেন ৷ ফলে বাম-কংগ্রেসের সাগরদিঘি মডেলে পূর্ণচ্ছেদ পড়ে যায় তখনই ৷
ইনসাফ যাত্রা: পঞ্চায়েত ভোটের আগে যেভাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলে নবজোয়ার কর্মসূচি করেছিলেন, অনেকটা সেই কায়দায় বছরের শেষের দিকে ইনসাফ যাত্রার আয়োজন করে সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই ৷ সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই চলছে এই কর্মসূচি ৷ এই কর্মসূচি শেষ হবে আগামী বছর 7 জানুয়ারি ৷ সেদিন কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সমাবেশ করবে ডিওয়াইএফআই ৷
রামমন্দির-গীতাপাঠ: 2023 সালে পশ্চিমবঙ্গে ঘটে যাওয়া দু’টি ঘটনা কোনোভাবেই রাজনীতির অংশ ছিল না ৷ তার পরও এই দু’টি ঘটনা ঘিরে সরগরম হয়েছে রাজনীতির ময়দান ৷ প্রথমটি হয় কলকাতার সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের রামমন্দির থিমকে কেন্দ্র করে ৷ এই মণ্ডপের উদ্বোধন করতে আসেন স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৷ তিনি সরাসরি না বললেও ঘুরিয়ে কিছু রাজনীতির বার্তা দেন ৷ যা নিয়ে সমালোচনা করে তৃণমূল কংগ্রেস ৷ বিজেপির বিরুদ্ধে দুর্গাপুজো নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ ওঠে ৷ তাছাড়া সেখানে দলের বিজেপির সবস্তরের নেতারা হাজির হয়েছেন বারবার ৷
একই ঘটনা ঘটেছে 24 ডিসেম্বর ব্রিগেডে ‘লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ’ ঘিরে ৷ এই অনুষ্ঠানের আয়োজক কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন ৷ এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ ছিল না ৷ তার পরও এই নিয়ে রাজনীতি হয়েছে৷ অনুষ্ঠানে দলের পতাকা ছেড়ে বিজেপির বহু নেতা অংশগ্রহণ করেন ৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও অংশগ্রহণ করার কথা ছিল ৷ শেষপর্যন্ত তিনি আসেননি ৷ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও ৷ কিন্তু তিনি যাননি এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে বিজেপির সংশ্রব থাকার কারণে ৷ তৃণমূল ও অন্য বিজেপি বিরোধীরা এই অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে বিজেপি ধর্মের রাজনীতি করছে বলেও অভিযোগ করেছে ৷
আরও পড়ুন: