কলকাতা, 1 ডিসেম্বর : HIV নিয়ন্ত্রণে কলকাতার সোনাগাছির যৌনপল্লি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে । AIDS-র মোকাবিলায় এখনও পর্যন্ত যে সাফল্য এসেছে, তার পিছনে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভূমিকা রয়েছে । এই সব জনগোষ্ঠীকে আরও কাজে লাগানোর কথাও এবার বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) । অথচ, আগামী দিনের জন্য আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে । তার কারণ, যেভাবে এখন রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রকল্প চলছে, তার জেরে আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে HIV সংক্রমণ নতুন আকারে বাড়তে শুরু করবে । কেন এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, সমাধান কীভাবে সম্ভব হতে পারে, এ সব নিয়ে বলেছেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির মুখ্য উপদেষ্টা, ডাক্তার স্মরজিৎ জানা ।
ওয়ার্ল্ড এইডস ডে। পরিস্থিতি এখন কী রকম?
উত্তর : 10 বছর আগের সঙ্গে যদি তুলনা করা যায় তাহলে আমরা দেখতে পাব, আগের থেকে অনেক উন্নতি ঘটেছে । অর্থাৎ, HIV নিয়ন্ত্রণ অনেকটা করা সম্ভব হয়েছে । এটা সম্ভব হয়েছে অর্থাৎ, বহু দেশে HIV ছড়ানোর হারটাকে যে কমানো গিয়েছে তার পিছনে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী । যে কারণে এতদিন পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই বারের থিম হিসাবে জনগোষ্ঠীর ভূমিকা এবং তার গুরুত্বের কথা বলেছে ।
সত্যি কথা বলতে কি, যদি গোটা দেশের দিকেও এখন আমরা তাকায়, তাহলে দেখতে পাব, যাঁরা সবথেকে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারের মধ্যে থাকেন অর্থাৎ, যৌনকর্মী, বৃহন্নলা বা ট্রান্সজেন্ডার, সমকামী এবং, যাঁরা ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক দ্রব্য ব্যবহার করেন, তাঁরা অর্থাৎ, সামগ্রিকভাবে এই সব জনগোষ্ঠীর ভিতরে HIV নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সাফল্য অর্জন করেছে । সোনাগাছি প্রোজেক্ট, কলকাতার সব থেকে বৃহত্তম যৌনপল্লির যৌনকর্মীরাই কিন্তু পৃথিবীতে HIV নিয়ন্ত্রণের রাস্তা দেখিয়েছে । এটা 1992-93 সালের কথা । যে জায়গা থেকে 1993 সালে, ভারতে যে HIV নিয়ন্ত্রণ সংস্থা, যেটাকে বলা হয় ন্যাশনাল AIDS কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন, তারা ঠিক করে নিল যে সোনাগাছির মডেলে সারাদেশে HIV নিয়ন্ত্রণ করবে । সেই জায়গা থেকে শুধু জনগোষ্ঠীকে বললেই তো হবে না, তাদেরকেও তো ক্ষমতায়ন করতে হবে, তাদেরকে শক্তিশালী করতে হবে । যে জায়গা থেকে ন্যাশনাল AIDS কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল । সেই জায়গা থেকে বলা হচ্ছিল, জনগোষ্ঠীর হাতেই যেন HIV নিয়ন্ত্রণটা তুলে দেওয়া হয় । যেটা আমরা 1999 সালে করতে পেরেছিলাম বলেই আজকে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি HIV নিয়ন্ত্রণের মূল কান্ডারি হিসেবে কাজ করছে । এটা সাফল্যের কথা, গর্বের কথা যে ভারত গোটা পৃথিবীকে রাস্তা দেখিয়েছে । অর্থাৎ, কলকাতা ভারতকে এবং, সেই ভারত সারা পৃথিবীকে রাস্তা দেখিয়েছে ।
উত্তর : একটা কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ । আজকে আমরা সাফল্য পেয়েছি, সত্যি কথা । কিন্তু, আমরা এটা বলতে পারি না পুরোপুরি এটা নিয়ন্ত্রণ হয়েছে । তার কারণ, কিছু কিছু রাজ্যে এই হার আবার বাড়তে দেখা যাচ্ছে । মাদক দ্রব্য ইনজেকশনের মাধ্যমে পঞ্জাব, রাজস্থানের ওদিকে ব্যবহার করে । গুজরাতে এবং আরও দুই রাজ্যের জনগোষ্ঠীর মধ্যে HIV-এর সংক্রমণ কিন্তু কমেনি । একই চিত্র সারা পৃথিবী জুড়ে । তার একটা কারণ, আমি বলতে চাই যে, জনগোষ্ঠীর হাতে প্রোগ্রাম আমরা দিচ্ছি সত্যি । কিন্তু, তাদের ক্ষমতায়নের জন্য যা যা করা দরকার তা কিন্তু করা হচ্ছে না । যৌন পেশাকে অপরাধমূলক কাজ হিসাবে বহু দেশে আইন রয়েছে, কিন্তু এটাকে WHO পাল্টাতে বলেছে । WHO বার বার বলেছে এটা । কিন্তু, বহু দেশ করেনি । সমকামিতা, এই এক বছর আগেও আমাদের দেশে আইনের চোখে অপরাধমূলক কাজ হিসেবে চিহ্নিত হতো । কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট সেটা পালটেছে । আজকে ট্রান্সজেন্ডাররা যাঁদের মধ্যে HIV-র হার কিন্তু তুলনামূলকভাবে অন্যান্য গ্রুপের থেকে একটু বেশি । তাঁদের জন্য একটি বিল আনা হয়েছে । কিন্তু, ট্রান্সজেন্ডারদের সঙ্গে কোনও আলোচনা, পরামর্শ করা হয়নি । যে কারণে যে বিলটা এনেছে, সেটা লাভের থেকে অসুবিধাটা বেশি সৃষ্টি করবে । যে কারণে ট্রান্সজেন্ডাররা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন ।
সমস্যা কেন দেখা দিচ্ছে?
উত্তর : কমিউনিটির গুরুত্ব যখন বলছি, তার মানে এটা মানতে হবে যে, এই জনগোষ্ঠীর বক্তব্য শুনতে হবে । নীতি নির্ধারণের জায়গায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে তুলে আনতে হবে । যে কাজটা 1995-96 সালে বেশ জোরদার ভাবে শুরু হয়েছিল । বলতে গেলে, 2010-11 পর্যন্ত সেটা ভালো গতিতে চলেছে । তার পরে কিন্তু ঢিমে তালে শুধু চলছে, তা নয় । উল্টো দিকেও হাঁটছে । মানে বহু জায়গাতেই এই জনগোষ্ঠীর সংগঠনগুলির হাতে কিন্তু HIV নিয়ন্ত্রণের প্রকল্পগুলি তুলে দেওয়া হচ্ছে না । দেওয়া হচ্ছে এমন কিছু গোষ্ঠীকে বা NGO-কে, যারা কিন্তু এই জনগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কোনওভাবেই যুক্ত নয় । প্রোজেক্ট হিসাবে তারা করছে । ফল হিসাবে প্রোজেক্টগুলির যে গুণমান, তার পতন হচ্ছে । এটা শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে নয়, অন্য আরও বিভিন্ন রাজ্যেও ঘটছে ।
তৃতীয় যে সমস্যা দেখা যাচ্ছে, তা হল, এই প্রকল্পের যে অর্থ, যেটা কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন থেকে আসে, সেটা খুবই অনিয়মিতভাবে আসছে । বেশ কিছু প্রকল্প বন্ধ রাখা হয়েছে বা বন্ধ হয়ে আছে । যার ফলে একটা জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ কিন্তু HIV নিয়ন্ত্রণের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত নয় । যারা 10 বছর আগেও ছিলেন, তাঁদের অনেকেই বেরিয়ে যাচ্ছেন । ফলে, এটা একটা বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি করছে । আমার ধারণা, গত 30 বছর HIV নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে কঠিন একটি ধারণার জন্ম দিচ্ছে যে, যেভাবে এখন প্রকল্প চলছে, আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে HIV আবার নতুন আকারে বাড়তে শুরু করবে ।
এ বছরের থিমে জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব দেওয়ার হয়েছে...
উত্তর : এটা অবশ্যই সঠিক এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপ যে থিম হিসাবে এ বছর জনগোষ্ঠীর বিষয়টিকে তুলে আনা হয়েছে । কিন্তু, শুধুমাত্র কথায় চিড়ে ভেজে না । বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে । কিন্তু, গুরুত্ব কীভাবে দেবেন, তাঁদের যদি ক্ষমতায়নের রাস্তায় তুলে আনা না হয় ? তাদের হাতে যদি HIV নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বভার তুলে দেওয়া না হয়, তাহলে তো সেটা কথার কথা হয়ে থাকবে ।
কীভাবে সাফল্য এসেছিল?
উত্তর : যৌনকর্মীদের সঙ্গে বসে আমরা তাঁদের যে ধারণা, তাঁদের যে অভিজ্ঞতা, সেগুলিকে সারসংকলন করে তাঁদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্প চালু করেছিলাম । যার ফল হিসেবে আমরা খুব দ্রুত যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়নও করতে পেরেছিলাম । দুর্বার-এর জন্ম হয়েছে এই ক্ষমতায়নের রাস্তা ধরে । দুর্বার আজ পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৬০ হাজার যৌনকর্মীর মুখপাত্র হিসাবে কাজ করে । যৌনকর্মীদের সমস্যা তো শুধু HIV নিয়ে নয় । তাঁদের প্রতি সমাজের যে বিমাতৃসুলভ ব্যবহার, আচরণ আমরা দেখি, শুধু তাঁদের উপর নয়, তাঁদের ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রেও এটা রয়েছে । এটাকে কাটানোর জন্য জোরদার প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত । বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ এবং মস্তানরা যেভাবে তাঁদের অত্যাচার করে, শোষণ করে, বিশেষ করে জেলাগুলোতে । সেগুলি অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার । এবং, আর কয়েকটা মানুষের মতো তাঁদেরও যে সম্মানের জায়গায় বসা উচিত, এটা যে একটা পেশা, এই পেশার স্বীকৃতি দেওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
ন্যাশনাল AIDS কন্ট্রোল প্রকল্পে যে নীতি, নির্দেশিকা রয়েছে, তাতে যে বিশেষ স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়, কমিউনিটি অর্গানাইজ়িং অ্যান্ড ওনারশিপ বিল্ডিং । জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করো, সঙ্ঘবদ্ধ করো এবং, তাদের হাতে প্রকল্পের ভার দিয়ে দাও । এটা আমি বলছি না, আমরা বলেছিলাম । কেন্দ্রীয় সরকার আজকে এটা শুধু মেনে নেয়নি, সারা ভারতের জন্য লাগু করেছে । এখন প্রকল্প যখন পরিচালিত হচ্ছে রাজ্যের তরফে, সেখানে রাজ্য কীভাবে সেই কাজটা করছে, সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এবং, সেই জায়গাটায় বহু ক্ষেত্রে নীতি অনুযায়ী কিন্তু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না । সেটা এই কাজটাকে দুর্বল করে দিচ্ছে ।
আমরা যখন শুরু করেছিলাম 2001-এ, তার চার-পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা দেখলাম, সারা ভারতে যৌনকর্মীদের মধ্যে HIV-সংক্রমণের হার দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করল । মুম্বই, চেন্নাই, পুনেয় হার তখন 50-60 শতাংশে উঠে গিয়েছিল । সেখানে কলকাতায় আমরা আমাদের প্রকল্পে বা অন্যান্য জায়গায় যেগুলি আমরা চালু করেছিলাম, সেটা 5 শতাংশের নিচে রাখতে পেরেছিলাম । এখন সেটা এক শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে । সে দিক থেকে দেখতে হলে এটা একটা যুগান্তকারী সাফল্য হিসাবে শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে চিহ্নিত হয়েছে ।
অথচ, বলছেন, HIV-র সংক্রমণ বাড়ছে...
উত্তর : কতগুলি রাজ্যে HIV আক্রান্তের হার বেড়েছে । তার মধ্যে রয়েছে গুজরাত, অন্ধ্রপ্রদেশ । এদিকে ইঞ্জেক্টিং ড্রাগ ইউজারদের মধ্যে পঞ্জাব এবং তার পার্শ্ববর্তী জায়গায় HIV বৃদ্ধির হার আমরা দেখছি । এগুলি কমানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে । আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ বা তারও বেশি মানুষ যাঁরা HIV-তে সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁরা মূলত অসুরক্ষিত যৌন সংসর্গের মাধ্যমে HIV-তে সংক্রমিত হয়েছেন । যাঁদের একাধিক যৌনসঙ্গী রয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে HIV-তে হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি ।