দেশের যে কোনও নির্বাচনে ফ্যাক্টর সংখ্যালঘু ভোট । বাংলাও তার থেকে বাইরে নয় । বঙ্গের প্রায় 30 শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট টানতে মরিয়া সব দলই । এই সংখ্যাই আসন্ন নির্বাচনে ভাগ্য নির্ধারণ করবে অন্তত 90টি বিধানসভা আসনের । লড়াইটা বাম-কংগ্রেস জোট, তৃণমূল আর অবশ্যই বিজেপির । আবার এমনও হতে পারে, সংখ্যালঘুদের সামনে রেখে শেষ পর্যন্ত লড়াইটা বাম-কংগ্রেস-তৃণমূল বনাম বিজেপিতে পরিণত হল । আর বাংলার রাজনীতিতে মিমের 'আত্মপ্রকাশ' অনেক হিসাব-নিকেশ নিঃসন্দেহে ওলোটপালোট পালটে দিতে । এই পরিস্থিতিতে আব্বাস সিদ্দিকির ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট নিঃসন্দেহে নতুন বাতাস আনল বাংলার মাটিতে ।
ভোট এলেই মুসলমানের ‘ভালো করার’ তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় । বহু দিন ধরেই রাজ্য-রাজনীতিতে এটাই রেওয়াজ । ইদানিং আর ভোটের সময়টুকুতে তা আটকে নেই, বছরভর নানা ভঙ্গিতে চলছে এর মহড়া । কখনও নেত্রী চাদরে মাথা ঢেকে মুসলমানি ধরনে পর্দা করেন, কখনও নমাজ বা দোয়ার ভঙ্গি করেন, বক্তৃতার শেষে (ভুল জায়গায়) ‘ইনশা আল্লা’ বলেন, ইমাম-মুয়াজ্জিনদের মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করে মুসলমানের ‘ভালো করে’ চলেছেন । এতে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর কাছে তিনি আজ ভিলেন । সংখ্যালঘু মুসলমান তোষণের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন । তকমা লেগেছে সংখ্যালঘুদের 'ভোটব্যাঙ্ক' হিসেবে ব্যবহার করার ।
এই ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখার লড়াই বাম আমলেও দেখা গিয়েছে । কিন্তু, হয়তো বাম নেতাদের 'দূরদর্শীতার' অভাবের জন্য বিষয়টি তেমন ভাবে প্রচার পায়নি অনেক ক্ষেত্রে । যখন এই প্রচারের গুরুত্ব বাম নেতারা বুঝেছেন, ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে । 2011 সালে ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার প্রায় সাত বছর পর পুস্তিকা প্রকাশ করে নিজেদের কাজের তুলে ধরতে চেয়েছিলেন বাম নেতারা । আসলে দীর্ঘ 34 বছরের বাম জমানায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ক্ষমতার ভিত্তি ছিল রাজ্যের তপশিলি জাতি ও উপজাতি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অটুট সমর্থন । বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায় রাজ্যে জমি অধিগ্রহণ-পর্বে বামেদের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরে । শত চেষ্টা করেও সেই ক্ষত আর মেটানো যায়নি । তাই পরবর্তীতে 2010 সালের নিরিখে আলিমুদ্দিনের তরফে দাবি করা হয়, ভূমি সংস্কারের ফলে রাজ্যে জমি-প্রাপকদের 18 শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু জনতা, ইন্দিরা আবাস যোজনার প্রাপকদের 22 শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত, রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের 9.7 শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, এমএসকে-এসএসকে শিক্ষকদের 37 শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্যদের 18 শতাংশ সংখ্যালঘু । এর পাশাপাশি, দেশের মধ্যে প্রথম সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক দপ্তর গঠন থেকে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন তৈরি হয়েছিল বাম জমানায় । দু'টি হজ হাউস থেকে উর্দু অ্যাকাডেমি তৈরির উদাহরণ দেওয়া হয় । এ সব প্রচার করেই পরবর্তীতে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক মজবুত করতে চেয়েছে বামেরা ।
ভোটব্যাঙ্ক অভিধাটি সংবাদমাধ্যমে প্রায়শই ব্যবহার হয়ে থাকে । এমনকী মুসলমানদের অনেকেই নিজেদের কোনও না কোনও দলের ভোটব্যাঙ্ক ভেবে শ্লাঘা বোধ করেন । অনেক সংখ্যালঘু মুসলমান ভদ্রলোককে বলতে শোনা গিয়েছে, মুসলমানদের ভোটেই এত দিন সিপিএম ক্ষমতায় ছিল । বামফ্রন্টকে সরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতায় বসানোর মূলেও নাকি মুসলমানদেরই একচেটিয়া সমর্থন । এ রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন অনেক রাজনৈতিক পণ্ডিতও । কোনও সম্প্রদায়ের গায়ে ভোটব্যাঙ্ক ছাপ লেগে যাওয়াটা যে কত বড় অপমানের সেটা বোধ হয় তাঁরা ভেবে দেখেননি ।
আরও পড়ুন : রাজ্যে সংখ্যালঘু জোটের হাওয়া, চাপে মমতার ভোট ব্যাঙ্ক
তৃণমূল-বাম-কংগ্রেস সকলের কাছেই মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক বেশ গুরুত্ব পেয়েছে-পেয়ে এসেছে । পাশাপাশি এতদিন একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে, বিজেপি এই ভোট টানার লড়াইয়ে নেই । এই ভোটব্যাঙ্ক নাকি বিজেপির খুব একটা কাজেও লাগে না । তারা তেমন ভাবে মুসলিম ভোট পায় না এবং মূলত সংখ্যাগুরু ভোটটুকু নিশ্চিত করতে পারলেই তাদের কাজ শেষ । কিন্তু সময় যত এগিয়েছে, প্রচলিত এই ধারণার ততই পরিবর্তন হয়েছে । আরও হচ্ছে । সাম্প্রতিক সময়েই বিভিন্ন রাজ্যের ভোটের দিকে তাকালে এটা আরও স্পষ্ট হবে । আর পাঁচটা রাজ্যের মতো বাংলাতেও এই মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক ইস্যু তীব্র হয়েছে দিন দিন ।
দীর্ঘদিন চালু থাকা এই 'মিথ' রাজ্যে ভেঙেছে 2019-এর লোকসভা ভোটে । এ রাজ্যে মুসলিম ভোটার বেশি এমন কেন্দ্রগুলিতে বিজেপি প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটসংখ্যা অনেকটাই প্রমাণ করেছে, মুসলিমরাও বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন । আর দিন কয়েক আগে মুসলিম অধ্যুষিত নিজামের শহর হায়দরাবাদে যে ফল করেছে বিজেপি, তাতে বোধহয় আরও স্পষ্ট হয়েছে এই 'মিথ'-এ ভরসা করে ভোটে নামা আত্মঘাতী হবেই ।
হায়দরাবাদ পুরসভায় বিজেপি চার আসন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল । এখন 48 । গ্রেটার হায়দরাবাদ মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের ভোটের ফল বুঝিয়ে দিয়েছে একুশের ভোটে যাওয়ার আগে বাংলার বিজেপি-বিরোধী দলগুলির উচিত নতুন করে অঙ্ক কষা । পুরভোটের ফল প্রমাণ করেছে মুসলিম মন জয়ে অনেকটাই সাফল্য পাচ্ছে গেরুয়া-শিবির । সন্দেহ নেই হায়দরাবাদের এই ভোটকে অন্য ভাবে দেখেছিল বিজেপি । একটি পুরসভার ভোট হওয়া সত্ত্বেও রাজ্য নেতাদের উপর আদৌ ভরসা করেননি কেন্দ্রীয় নেতারা । ঠিক যেমন বঙ্গ-বিজেপির নেতাদের উপর এখনও পর্যন্ত ন্যূনতম ভরসা করছেন না শাহ-নাড্ডারা । উত্তরপ্রদেশ থেকে যোগী আদিত্যনাথ-সহ একাধিক ভিন রাজ্যের নেতাকে হায়দরাবাদে প্রচার করতে পাঠানো হয়েছিল । নিজামের শহরে প্রচারেও নিজস্ব স্টাইলেই হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলেছিলেন যোগীরা । তবুও ফলাফলে দেখা গিয়েছে মুসলিম ভোট যথেষ্টভাবেই কুড়িয়েছে বিজেপি । যোগী দাপটের সঙ্গে বলেছিলেন, হায়দরাবাদের নাম বদল করে ‘ভাগ্যনগর’ করা হবে । তবুও ভোট পেয়েছে বিজেপি । প্রচারে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-ও সরাসরি হিন্দুত্বের বার্তা দিয়েছেন । দক্ষিণ বেঙ্গালুরুর বিজেপি সাংসদ তেজস্বী সূর্য প্রচারে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কেসিআর হায়দরাবাদকে ইস্তানবুল করতে চান । মিম ভারতের হায়দরাবাদকে পাকিস্তানের হায়দরাবাদ করতে চায় । আর আমরা হায়দরাবাদকে ভাগ্যনগর বানাব, ইস্তানবুল নয় ।’’এর পরও বিজেপি চার থেকে 48 । এই সাফল্য কোন রহস্যে?
আরও পড়ুন : নতুন দল ঘোষণা আব্বাস সিদ্দিকির
আর এখানেই প্রকট হচ্ছে বাংলায় মুসলিম ফ্যাক্টর ।
আগামী একুশে দেশের যে চার রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভোট হতে চলেছে, তার অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ । ভোটের ফল কী হবে, সময় তা বলবে । কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে রাজ্যের শাসক দলকে এখন থেকেই কিছুটা চাপে রেখেছে বিজেপি । তারা যথারীতি বাংলার ভোটে হিন্দু-কার্ডই খেলতে শুরু করেছে । তার মোকাবিলায় তৃণমূল-সহ রাজ্যের বিজেপি-বিরোধী দলগুলির ভরসা ওই মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক । কারণ, এই দলগুলি যে কোনও কারণেই হোক, আজও ভাবে মুসলিমরা কখনই বিজেপিকে ভোট দেবে না । বাস্তব চিত্র কিন্তু অন্য কথা বলে । অন্তত, 2019-র লোকসভা ভোটের নিরিখে ।
গত লোকসভা নির্বাচনের দু-একটি কেন্দ্রের ফলাফলের দিকে নজর দেওয়া যাক...
ক) দক্ষিণ মালদা লোকসভা কেন্দ্র :-
64 শতাংশ ভোটার মুসলিম । কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছেন 444270 ভোট, (34.73%) । বিজেপি পেয়েছে 436048 (34.09%) এবং তৃণমূলের মুসলিম প্রার্থীর প্রাপ্তি 351353 (27.47%) ।
খ) উত্তর মালদা লোকসভা কেন্দ্র:- বিজেপির হিন্দু প্রার্থী পেয়েছেন 509524 ভোট (37.61%) । তৃণমূলের মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন 425,236 ভোট (31.39%) এবং কংগ্রেসের মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন 305,270 ভোট (22.53%) ।
গ) জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্র:-
তৃণমূলের মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন 562,838 ভোট (43.15%) । এখানে মুসলিম ভোটার 82% এবং বিজেপির মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন 317,056 ভোট (24.3%) এবং কংগ্রেসের হিন্দু প্রার্থী পেয়েছেন 255,836 ভোট (19.61%) ।
এই তিন কেন্দ্র, যেখানে মুসলিম ভোটারই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে বিজেপি প্রার্থীরা এত বিপুল ভোট কোথা থেকে পেলেন? কারা দিলেন ? কেন পেলেন ? এই তিন কেন্দ্রে শুধু হিন্দুরাই বিজেপিকে প্রায় সাড়ে 12 লাখ ভোট এনে দিলেন ? সুতরাং ধরে নেওয়াই যায়, মুসলিম ভোটাররা জেনে বুঝে, সজ্ঞানে ভোট দিয়েছেন বিজেপিকে । ফলে, তৃণমূল সংখ্যালঘু ভোট পেয়ে থাকে আর বিজেপি হিন্দু ভোট পায়, এই ধারণা ভুলে যাওয়ার সময় এসেছে । একুশের বঙ্গভোটে যদি মিম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করে, তাহলেও বিজেপির 10-15 শতাংশ মুসলিম ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি । সন্দেহ নেই, তেমন হলে অনেক হিসাব গুলিয়ে যাবে ।
2011-এর আগে প্রতিটি ভোটে দেখা গিয়েছে, মুসলিমরা বামফ্রন্ট বা সিপিএমকে ভোট দিয়েছে । মুসলিম ভোটের কিছু অংশ অবশ্য কংগ্রেসও পেয়েছে । 2011-র পর থেকে তৃণমূল ধারাবাহিকভাবেই দাবি করে আসছে, রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগ তাদের ঝুলিতে । তাই যদি হয়, তাহলে মালদার দুই আসনে তৃণমূল হারল কেন? 2019- এর লোকসভা ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদের সংখ্যালঘুরা এখন বিজেপিকে পছন্দ করছেন । 2021-এর বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের মুসলিম ভোট কোন দল পাবে, কেন পাবে এবং 2019-এ কেন তৃণমূল পেল না, তা নিয়ে পুরোদস্তুর সমীক্ষা নিশ্চয়ই করেছে তৃণমূল ।
এ রাজ্যে এই প্রথমবার কোনও রাজনৈতিক দল ভোট-ময়দানে নেমেছে এক পেশাদার ভোট-কৌশলীর অধিনায়কত্বে । তৃণমূলকে এবং তৃণমূলের ভোট- বিশেষজ্ঞদের মাথায় রাখতে হবে, এবারের ভোটে মুসলিম ভোট ভয়ঙ্করভাবে কাটাকাটি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে । সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ভোট নিজেদের পক্ষে আনতে তৃণমূলকে লড়তে হবে কংগ্রেস, বাম, বিজেপি, মিম, আব্বাস সিদ্দিকির দলের সঙ্গে । আর মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আব্বাস সিদ্দিকির জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ছে । ফুরফুরার অন্যান্য পীরজাদাদের একশো হাত পিছনে ফেলে দিয়েছেন এই আব্বাস সিদ্দিকি । নতুন দল গড়ে এবারের ভোটে নামছেন আব্বাস । সন্দেহ নেই কিছুটা হলেও অন্যদের ভোট কাটবেন তিনি । আবার এই পাঁচ শিবিরের কেউ, অন্য কারও সঙ্গে জোট বেঁধে ফেললে, লড়াই আরও কঠিন হয়ে উঠবে । এই লড়াইটা তৃণমূলের কাছে আরও বেশি কঠিন, কারণ তৃণমূলে গ্রহণযোগ্য মুসলিম নেতার অভাব । যে ক'জন আছেন, তাঁদের হয় মানুষ ভুলতে বসেছেন অথবা তাঁরা শহরকেন্দ্রীক । গ্রামীণ ভোটে তাদের প্রভাব বা গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে । ফলে তাদের প্রায় শূন্য থেকে শুরু করতে হবে । তা ছাড়া, 'মিম - মিম' প্রচার চালিয়ে শাসক দলই বাংলায় ওই দলকে একটা আকার দিয়ে দিয়েছে । আর ওয়েইসির একটা আলাদা নিজস্ব জনপ্রিয়তা আছে । যা যুব-মুসলিমদের আকর্ষণ করে ।
আরও পড়ুন : ওয়েইসিসের সফরের পরেই রাজ্যে মিমের সাংগঠনিক প্রধানের যোগদান তৃণমূলে
আর একটা লক্ষণীয় বিষয় হল, রাজ্যে এতদিন মুসলমান ভোটারের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে । কিন্তু, সে ভাবে কোনও মুসলিম রাজনৈতিক দল কিছু করে উঠতে পারেনি । 1970 সালে অজয় মুখোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভায় মুসলিম লিগ ছিল । ওই সময় পশ্চিমবঙ্গে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগের ছিল সাত জন বিধায়ক । গত চল্লিশ বছরে সে দলের অস্তিত্ব এ রাজ্য থেকে মুছে গিয়েছে । জামিয়তে উলামায়ে হিন্দের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুল্লাহ্ চৌধুরি পিপলস ডেমোক্র্যাটিক কনফারেন্স অব ইন্ডিয়া নামে একটা দল তৈরি করে ভোটে লড়েছিলেন । কিছুই করে উঠতে পারেননি । হাজার হাজার মাদ্রাসা ছাত্র আর তাবড় তাবড় উলামা-মৌলবিদের নামিয়ে প্রচুর খরচ করেও এ রাজ্যের মুসলমান ভোটারদের ভোট তিনি পাননি । বিধায়ক হওয়ার জন্য তাঁকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বাঁধতে হয়েছে । ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়া এবং সোশাল ডেমোক্রাটিক পার্টি অব ইন্ডিয়া নামে আরও দুটো ‘মুসলিম’ পার্টি এ রাজ্যে ভোটে লড়েছিল । কিন্তু তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে মুসলমানরাও সম্ভবত অবগত নয় । বেশ কয়েক বছরের চেষ্টার পর আসাদুদ্দিন ওয়েইসির অন্ধ্রপ্রদেশ ভিত্তিক মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন বাংলায় কিছুটা নিজেদের উপস্থিতি জাহির করতে পেরেছে ।
মুসলমান সমাজ সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত ধারণাও কাজ করে । মনে করা হয়, মুসলমান হল মোল্লা-মৌলবি শাসিত ধর্ম নিয়ন্ত্রিত একটি সমাজ । এমনই একটি ধারণা থেকে মনে করা হয়, মুসলিমরা মসজিদের ইমামের কথায় চলেন । ভোটও দেন ইমামের নির্দেশে । সেই ভাবনা থেকেই মমতা ইমামদের মাসোহারার ব্যবস্থা করেন । কিন্তু মুসলিম সমাজকে যাঁরা একটু কাছ থেকে দেখেন তাঁরা জানেন মসজিদের বাইরে সমাজে ইমামদের তেমন কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই । কারণ তিনি প্রায়শই পরান্নভোজী এবং মুসলিমদের চাঁদায় তাঁর সংসার চলে । অথচ পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্য সরকার কয়েক জন মোল্লা-মৌলানা এবং পিরজাদাকে হাজির করে । সরকারি বা শাসক দলের মঞ্চে বাংলার মুসলমানের ‘মুখ’ হিসেবে এঁদেরই দেখা মেলে । উচ্চশিক্ষিত উদার মুসলমানের কোনও ঠাঁই হয় না সেখানে । বাম আমলেও এর প্রায় কোনও ব্যতিক্রম দেখা যায়নি । পর্যবেক্ষকদের মতে, এখানেই ব্যবধানটা তীব্র হচ্ছে । ভোট যত এগিয়ে আসছে, স্ববিরোধিতার ছবিটা ততই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ।
ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে মুসলিমদের দেগে দেওয়ার একটা বড় কারণ সম্ভবত তাদের ইমামের পিছনে কাতারে দাঁড়িয়ে নমাজ পড়া বা ফি শুক্রবার জুম্মার নমাজে বা ইদের নমাজের বিপুল সুশৃঙ্খল জমায়েত । তা ছাড়া কলকাতা এবং বিভিন্ন শহরে ও গ্রামে মুসলমানদের গেট্টো-বদ্ধ জীবনযাপনও হিন্দুদের মধ্যে এই ধারণার জন্ম দিয়ে থাকতে পারে । এই ভ্রান্ত ধারণার জন্ম আসলে অজ্ঞতা থেকে । এই ব্যবধানকেই কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলেছে গেরুয়া শিবির । নিজেদের থেকে দূরে সরে যাওয়া মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে টানতে আজ অনেকটাই সক্ষম বিজেপি । সঙ্গে কাজ করছে--বিজেপি বিরোধী শিবিরের আত্ম- সন্তুষ্টি, 'মুসলিমরা বিজেপিকে ভোট দেয় না' ।
সন্দেহ নেই এই 'নিশ্চিত বিশ্বাস'-ই এবার অগ্নিপরীক্ষার সামনে ৷