কলকাতা, 20 ডিসেম্বর: এ বার উচ্চশিক্ষায় পাঠ্যক্রমের (University Curriculum) অঙ্গ হিসেবে পড়ানো হতে পারে ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, শুক্রনীতি, বৈদিক অঙ্ক, বৈদিক রসায়ন, রামায়ণ ও মহাভারতের মতো একাধিক ভারতীয় প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্র (UGC Draft Controversy)। সম্প্রতি এই বিষয়ে খসড়া গাইডলাইন প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি । জাতীয় শিক্ষা নীতির অঙ্গ হিসেবে এই বিষয়গুলি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার কথা জানিয়েছে ইউজিসি । এই বিষয়টি সামনে আসার পরেই শিক্ষা মহলে শুরু হয়েছে জোর চর্চা (UGC draft guidelines)।
ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম (আইকেএস) নামে এই খসড়ার বিষয়ে মতামত, অভিযোগ এবং কারও কোনও পরামর্শ বা মতামত থাকলে সেগুলি 28 ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশনকে জানাতে হবে । আইকেএস-এর খসড়া নির্দেশিকায় বলা হয়েছে যে, প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চা ও ঐতিহ্যকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতেই এই উদ্যোগ । প্রাচীন ভারতের জ্ঞান এখনকার পড়ুয়াদের আরও সাহায্য করবে । তাই আধুনিক পাঠ্যক্রমের সঙ্গে প্রাচীন জ্ঞানচর্চার কিছু নির্দিষ্ট অংশ পড়ানো হবে । এই খসড়া পাশ হলে উচ্চশিক্ষায় এই পাঠ্যক্রম বাধ্যতামূলক করা হবে বলে জানানো হয়েছে ।
এই বিষয়গুলি পড়াবার জন্য শিক্ষকদের বাধ্যতামূলকভাবে ইনডাকশন কোর্স এবং তারপর সময় সময় রিফ্রেশার্স কোর্স করতে হবে । নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে যে, 10-10-10 ফরম্যাটে মোট 30 ঘণ্টা এই কোর্সের জন্য ব্যয় করতে হবে ।
এই বিষয়ে সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটির সম্পাদক অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর মনে করেন, "ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের (IKS) উপর গত নভেম্বর মাসে একটি গাইডলাইন প্রকাশ করে ইউজিসি, 14/12 তারিখে পাবলিক নোটিশ জারি করে 28/12 তারিখের মধ্যে স্টেক হোল্ডারদের মতামত জানাতে বলেছে, এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় সম্পর্কে যে সময় অত্যন্ত কম । গাইডলাইনের উপক্রমণিকায় জগদীশ কুমার বলেছেন, ভারতবর্ষে শিল্প, সাহিত্য, ঐতিহ্য, প্রথা, ভাষা, স্থাপত্যবিদ্যা প্রভৃতি খুবই প্রাচীন এবং তার চর্চা গত শতাব্দীতে বন্ধ হয়েছে তাই তার চর্চা শুরু করার দরকার । আধুনিক পাঠ্যবস্তুর সঙ্গে প্রাচীন ঐতিহ্যকে তাই ইউজিসি মেশাতে চাইছে । হিন্দু মহাসভা যা একটি পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক গোষ্ঠী, তার প্রতিষ্ঠাতা মদন মোহন মালব্যের চিন্তার ভিত্তিতে শিক্ষকদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করাই এই গাইডলাইনের মূল উদ্দেশ্য ।"
আরও পড়ুন: রাজ্য থেকে সরতে পারে ইউজিসি'র আঞ্চলিক দফতর, সরব শিক্ষামহল
তিনি আরও বলেন, "প্রথম বর্ষের ছাত্রদের যে ইন্ডাকশন প্রোগ্রাম হয়, তা এখন থেকে IKS ভিত্তিক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে । এর জন্য বই, নথি, ভিডিয়ো প্রবন্ধ তৈরি করতে বলা হয়েছে । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি মন্দির, গুরুকুল ব্যবস্থা, হস্তবিদ্যার কেন্দ্র, আয়ুর্বেদিক কেন্দ্র এ সব জায়গায় পড়ুয়াদের নিয়ে যাওয়া হবে (মসজিদ বা গুরুদ্বারের কথা নেই)। বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, কারগরি বিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, অঙ্ক শাস্ত্র প্রভৃতি সব কিছুর সঙ্গে ভারতীয় ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটানো হবে । শিক্ষকদের রিফ্রেশার কোর্সে এ সবগুলি কেমন করে ছাত্রদের কাছে তাঁরা নিয়ে যাবেন, তার পাঠ দেওয়া হবে । রসায়নের সঙ্গে রসরত্নাঙ্করা, হার্বো ধাতু প্রভৃতি শিখবে পড়ুয়ারা, পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে শিখবে বৈশেষিকা দর্শন ইত্যাদি । ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের নামে এমন সব উদ্ভট জিনিস তারা শেখাতে চাইছেন, যার সংগে আধুনিক শিক্ষার কোনও যোগ নেই । হিন্দু ধর্ম কত মহান এবং অন্য ধর্মগুলি কত অপ্রাসঙ্গিক ! এই চর্চার আজ কোনও প্রয়োজন আছে ? এর একটাই উদ্দেশ্য হল ভারতীয় ঐতিহ্যের নামে হিন্দুত্ববাদী উগ্র জাত্যাভিমানের জন্ম দেওয়া । এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশের জন্য তাঁরা প্রয়োজনীয় সময় দিতেও রাজি নন । আবার কোনও বিরুদ্ধ মত থাকলেও অতীতের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী তা যে গ্রহণ করবে না তাও বলে দেওয়া যায় । আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করছি এবং অবিলম্বে এই গাইডলাইন প্রত্যাহার করার দাবি করছি ।"
ওয়েস্ট বেঙ্গল কলেজ অ্যান্ড ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কেশব ভট্টাচার্য বলেন, "ভারতবর্ষ একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ৷ এখানে জোর করে প্রাচীন ভারতবর্ষের শাস্ত্র এবং অন্যান্য বিষয়গুলি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করাটা একেবারে উচিত নয় । আসলে এইভাবে আরএসএস ও বিজেপি যে ভারতবর্ষকে একটা হিন্দু দেশে পরিণত করার চেষ্টা করছে এটা তারই প্রথম ধাপ । আজ থেকে এত বছর আগের শাস্ত্র বা অঙ্ক কিংবা রসায়ন শাস্ত্র বর্তমান যুগে দাঁড়িয়ে কতটা প্রাসঙ্গিক সেই বিষয়টিও ভাবতে হবে । ছাত্রছাত্রীদের আগামী জীবনের জন্য হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন । হ্যাঁ, এই জ্ঞান নিঃসন্দেহে ভালো । তবে এগুলো পাঠ্যক্রমে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে না ৷"