কলকাতা, 29 জুন : এখানে হাওয়ায় ভাসে ইলিশ ভাপার গন্ধ। ধুমায়িত রূপসী রূপচাঁদার ফ্রাই শেষ হয়ে যায় নিমেষে । দিনভর ব্যস্ত থাকে কস্তুরী কিংবা রাঁধুনির শেফরা । ওপার বাংলার মানুষের আনাগোনায় গমগম করে মারকুইস স্ট্রিট । গভীর রাত পর্যন্ত এ তল্লাট জেগে থাকে । এ তল্লাট কলকাতার বুকে একখণ্ড বাংলাদেশ । কিন্তু লকডাউন আর কোরোনা আতঙ্ক সব কেড়ে নিয়েছে ৷ হোটেলে চেক ইন-চেক আউটের ব্যস্ততা নেই । বাংলাদেশি টাকা রুপিতে পরিবর্তন করার তাড়া নেই । সোহাগ পরিবহনের কাউন্টারে ভিড় নেই । খাঁ খাঁ করছে জামা কাপড়ের দোকানগুলি ।
বিশেষ কোনও সিজ়ন নেই ৷ আবার বড় কোনও উৎসবেরও প্রয়োজন নেই । ওপার বাংলার মানুষের কলকাতায় যাতায়াত লেগে থাকে হরদম । কেউ আসেন চিকিৎসার প্রয়োজনে, কেউ কেনাকাটা করতে, কেউ আবার শুধুই ঘুরতে । ওপার বাংলার মানুষের কাছে কলকাতার সেরা গন্তব্য মারকুইস স্ট্রিট- ফ্রি স্কুল স্ট্রিট চত্বর । বাংলাদেশি অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য এ মহল্লায় রয়েছে শতাধিক হোটেল । মার্চের শুরুতেও সেসব হোটেলের পুরোটাই ভরতি ছিল । কোরোনা সংক্রমণ একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়তেই বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেছিল । লম্বা লাইন পড়ে ট্রাভেল এজেন্সির অফিসগুলির সামনে । কিন্তু তারপরও অনেকেই ছিলেন । লকডাউন শুরু হওয়ায় বেজায় সমস্যায় পড়তে হয়েছে তাঁদের । খাবারের হোটেল বন্ধ ৷ খোলা নেই কোনও দোকান ৷ পরিবার নিয়ে তখন রীতিমতো বিপাকে পড়েছিলেন বাংলাদেশিরা । পরে বাংলাদেশ সরকার এদেশে আটকে পড়াদের জন্য বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করে । একে একে দেশে ফেরেন সবাই । তারপরই ফাঁকা হয়ে যায় "মিনি বাংলাদেশ" নামে পরিচিত মারকুইস স্ট্রিট । এলাকার ব্যবসায়ীদের দুর্ভাগ্যের শুরু তখন থেকেই ।
মারকুইস স্ট্রিটের হোটেল সম্রাটের সুনাম রয়েছে বিস্তর । এখন সে হোটেল তালা বন্ধ । অনেক ডাকাডাকির পর বেরিয়ে এলেন কেয়ারটেকার উত্তম ঘোষ । তিনি জানালেন, "তিন মাস হয়ে গেল আমাদের ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ । ব্যবসার পুরোটাই বাংলাদেশিদের উপর নির্ভরশীল । এখন তাঁদের ভিসা বন্ধ । অন্য সময় আমাদের হোটেলে সব সময় ঘর পাওয়া যায় না । আপাতত হোটেল কর্মীরা বাড়িতে রয়েছেন । বেশ কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি ।" হোটেল স্যানিটাইজ়েশনের কাজ করতে করতে টাইমস ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের ম্যানেজার নীলুফার বেগম বললেন, "আমাদের ব্যবসা পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে । অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশিরা দেশে ফিরতে শুরু করে দিয়েছিলেন । কিছু মানুষ লকডাউনে আটকে গিয়েছিলেন । তার মধ্যে আমাদের হোটেলের বোর্ডারও ছিলেন । খুব কষ্ট পেয়েছেন তাঁরা ।"
এই অঞ্চলের আর একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যবসা মানি এক্সচেঞ্জ এবং ট্রাভেল এজেন্সি । তেমনই এক ব্যবসায়ী মহম্মদ সিকন্দর দোকান খুলে বসে ছিলেন । তাঁর চোখে মুখে হতাশা । সিকন্দরের কথায়, "ব্যবসা পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে । আমার তাও নিজের দোকান । কিন্তু, এখানে অনেকে দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা চালান । মাসে 50000 টাকা ভাড়া । তিন মাসে দেড় লাখ টাকা হয়ে গেছে । অথচ এক টাকাও আয় নেই । ওই টাকা তাঁরা দেবেন কীভাবে ! তাই বেশিরভাগ দোকান বন্ধ হয়ে গেছে ।"
মারকুইস স্ট্রিট চাইছে, শেষ হয়ে যাক কোরোনা আতঙ্ক । এ তল্লাট ফের শুনুক পুরানো সেই দিনের কথা । চট্টগ্রাম, বরিশাল, যশোর, ঢাকার নিজস্ব উচ্চারণের কোরাস আবার ফিরে আসুক মহল্লায় ।