কলকাতা, 23 জানুয়ারি : তিলোত্তমায় তখন বইছে স্বদেশী হাওয়া ৷ মিটিং বা আড্ডায় তখনও আধুনিক পদের অভাব। কিন্তু মিটিং এবং ইটিং'এ সেদিনও কোনও বৈপরীত্য ছিল না। কারণ, বাঙালির জিহ্বায় সেই অভাব পূরণ করে এসেছে তেলেভাজা ৷ এবং আজও কলকাতার বুকে এমন কিছু দোকান আছে যারা সেই ঐতিহ্যকে বহন করে বিদেশি খাবারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে একটা আস্ত ইতিহাস ।
পিছিয়ে যাওয়া যাক 103 বছর আগে । সালটা 1918 । বিহারের গয়া থেকে কলকাতায় পা রাখলেন খেঁদু সাউ । উত্তর কলকাতায় দিলেন একচিলতে তেলেভাজার দোকান ৷ পিঁয়াজি, বেগুনি, কাশ্মীরি চপ তৈরি করা শুরু হল । এমনই তার স্বাদ যে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে খুব একটা সময় লাগল না । রান্নার কারিগরি দেখে এবং চপ, বেগুনি, পিঁয়াজি চেখে বাঙালির বুঝতে অসুবিধা হল না যে খেঁদু সাউ একজন দক্ষ কারিগর । রাঁধুনির রন্ধনে বাঁধা পড়ল উত্তর কলকাতার মানুষ । সেই সময় চপ, তেলেভাজা পরিবেশন করা হত শালপাতায় । খেঁদু সাউয়ের জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছাল যে দারোগা থেকে কেরানির ভিড় বাড়তে লাগল । শালপাতায় মোড়া চপ গলাধকরণের ধুম বেড়ে যেত । পাশাপাশি এই শালপাতাই ব্যবহার হতে লাগল আরও একটি উদ্দেশে । পরাধীনতার বন্ধন ছিঁড়ে স্বাধীনতার আশায় বহু তথ্য চালাচালি হত সেই শালপাতায় । ইতিমধ্যে খেঁদু নিজেও জড়িয়ে পড়লেন স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে । ক্রমশ ভিড়ের মাঝে থেকে ভেসে আসা তথ্য বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ভার নিলেন খেঁদুবাবু নিজেই । ক্রমশ খেঁদু সাউয়ের দোকান হয়ে উঠল বিপ্লবীদের তথ্য চালানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান ।
ক্রমশ দোকানের খ্যাতি যখন ছড়িয়ে পড়ত শুরু করল তখন খেঁদু সাউ ছেলের নামে দোকানের নাম রাখলেন 'লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ অ্যান্ড সন্স' । স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া এই লক্ষ্মীনায়ারণ অ্যান্ড সন্সের তেলেভাজায় নাকি মুগ্ধ ছিলেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ৷ ততদিনে স্বদেশী আন্দোলনের আখড়ায় পরিণত হয়ে গেছে এই দোকান । স্বদেশী আন্দোলন করার জন্য খেঁদু সাউকে নিজেও দু'বার যেতে হয়েছে কারাগারে । কিন্তু দেশ স্বাধীনের উৎসাহে ভাটা পড়েনি কোথাও । দোকানের আশপাশে তখন স্বদেশীদের মিটিং বসত । আর সেইসকল মিটিংয়ে মুড়ি, তেলেভাজার বরাত পেতেন খেঁদু সাউ । তেমনই একটি মিটিংয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল স্বয়ং নেতাজির । খেঁদুর হাতের বানানো চপ খেয়ে তিনি আপ্লুত হলেন । এদিকে প্রশংসা পেয়ে খেঁদু তখন নেতাজি জ্বরে মগ্ন । তারপর 1942 সাল থেকে প্রতি বছর নেতাজির জন্মদিনে বিনে পয়সায় চপ বিলি করতে শুরু করলেন খেঁদু সাউ ।
23 জানুয়ারি সকাল হলেই ধামা ভরতি করে বেরিয়ে পড়তেন । তারপর পরিচিত মহল, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে নেতাজির গুণকীর্তন করতে করতে বিতরণ করতে শুরু করতেন চপ, ফুলুরি, পিঁয়াজি । স্বাধীনতার পর বদলে গেল বিতরণের ধরণ । নেতাজির জন্মদিনে দোকান থেকেই কচিকাঁচাদের জন্য দুটো এবং বড়দের জন্য চারটে করে তেলেভাজা বিতরণ শুরু হল । সেই ঐতিহ্যে ভাঁটা পড়েনি আজও । সকাল সাতটা থেকে দুপুর তিনটে পর্যন্ত চলে তেলেভাজা বিতরণ । কারণ মধ্যমণি যে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্বয়ং । দোকানের সাইনবোর্ডেও জ্বলজ্বল করে নেতাজির ছবি । এখানেই শেষ নয় । কত রথী-মহারথীর পদধূলি পড়েছে এই দোকানে । রামকুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে জহর রায় সবাই মজেছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণের তেলেভাজার স্বাদে । হাল আমলে সেই স্বাদের ভাগীদার হয়েছেন বিসিসিআই সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ।
বর্তমানে উত্তর কলকাতার সুবিখ্যাত এবং ঐতিহ্যবাহী এই দোকানের হাল ধরেছেন তৃতীয় প্রজন্ম কেষ্টকুমার গুপ্তা (সাউ) । একইভাবে ঐতিহ্য এবং জনপ্রিয়তা বজায় রেখে রমরমিয়ে চলছে লক্ষ্মীনারায়ণ সাউয়ের তেলেভাজা । হাতিবাগান থেকে হেদুয়ার দিকে এগিয়ে গেলে ডান হাতে পড়বে এই দোকান । রয়েছে রকমারি চপ । চিরাচরিত আলুর চপ, কাশ্মীরি চপ, বেগুনি, ধোঁকা ইত্যাদি তো রয়েছেই, একইভাবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তালিকায় যুক্ত হয়েছে আমের চপ, পনিরের চপ, চাউমিনের চপের মতো অভিনব পদ । কিন্তু এই দোকানে সবার সেরা যদি বলতে হয় তা হল পিঁয়াজি । একে লক্ষ্মীনারায়ণের একটি সিগনেচার পদ বলা যেতে পারে অনায়াসে । কারণ এই দোকানের পিঁয়াজির স্বাদ অন্যান্য দোকানের থেকে একেবারে আলাদা । তাই পিঁয়াজি খাবার লোভে শুধু উত্তরই নয়, বহু দূর-দূর থেকে লোকে ছুটে আসেন এই স্বাদের ভাগ নেওয়ার জন্য ।
যুগ পালটালেও স্বাদের তেমন হেরফের হয়নি । অতীতের স্বাদ টিকিয়ে রাখা হয়েছে ৷ যুগের পরিবর্তনে মুখের পরিবর্তন হলেও স্বাদে অপরিবর্তিত থেকে গেছে লক্ষ্মীনারায়ণ । ঐতিহ্য এবং স্বাদের এমন অভাবনীয় মিশ্রণেই লক্ষ্মীনারায়ণ পার করতে থাকবে এমনই কত যুগ !