কলকাতা, 30 জুন: পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারের মাঝেই শুক্রবার ছিল হুল দিবস । প্রত্যেকবারই রাজ্য সরকারের তরফ থেকে এই দিনটি ঘটা করে পালন করা হয় । শাসক থেকে বিরোধী - প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই এই দিনটি গুরুত্ব দিয়ে পালন করতে দেখা যায় । এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনের মধ্যে দিনটি পড়ায় বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রচারের ফাঁকে হুল দিবস উদযাপন কোথাও যেন কিছুটা ম্লান । জঙ্গলমহলের গুরুত্বপূর্ণ চারটি জেলা তো বটেই, এ ছাড়াও আদিবাসী অধ্যুষিত একাধিক জেলাতে দিনটি উদযাপিত হয়েছে । তবে মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট চালু থাকায় বহু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভাবে এই অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে । সে কারণেই কোথাও কোথাও এ বার এই উদযাপনের বহর কিছুটা ছিল ম্রিয়মাণ ।
প্রতি বছর এই দিনটিতে ঝাড়গ্রামে বড় করে অনুষ্ঠান হয় । তবে এ বার ভরা পঞ্চায়েত ভোটের বাজারে জাঁকজমক ছাড়াই পালিত হল হুল দিবস । প্রতিবছর শাসক, বিরোধীর পাশাপাশি প্রশাসনের উদ্যোগে ঘটা করে পালিত হয় হুল দিবস । গত বছর ঝাড়গ্রাম ব্লকের বাঁধগড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তপাতি এলাকায় হুল দিবস পালনের জন্য রাজ্যস্তরীয় অনুষ্ঠান হয়েছিল । যেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন রাজ্যের আদিবাসী উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী বুলুচিক বরাইক, রাজ্যের বন প্রতিমন্ত্রী তথা স্বনিযুক্তি ও স্বনির্ভর দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা । উপস্থিত ছিলেন আদিবাসী উন্নয়ন দফতরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ছোটান ডি লামা । ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক, পুলিশ সুপার-সহ জেলার অন্যান্য আধিকারিকরাও ছিলেন সেখানে ।
হুল দিবসের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আদিবাসী সমাজের কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের সংবর্ধনা প্রদান, জাতিগত শংসাপত্র প্রদান, এছাড়াও একাধিক প্রকল্পের পরিষেবা প্রদান করা হয় । 30 জুন হুল দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন দূর দূরান্তের বহু লোকশিল্পী, পহেলা জুলাই পর্যন্ত চলেছিল অনুষ্ঠান ।
কিন্তু এই বছর নির্বাচনবিধি জারি থাকায় দেখা গেল এক অন্য চিত্র । ঝাড়গ্রাম জেলাশাসকের কার্যালয়ের সিধু-কানু হলে জেলাশাসকের উপস্থিতিতে পালিত হয় হুল দিবস । যেখানে অংশগ্রহণ করেন আদিবাসী সমাজের মানুষজনেরা । আদিবাসী সমাজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয় । এ ছাড়াও ঝাড়গ্রাম শহরের রঘুনাথপুরে সিধু-কানুর মূর্তিতে ঝাড়গ্রামের সাংসদ কুনার হেমব্রম হুল দিবস উপলক্ষে সিধু-কানুর মূর্তিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন ।
অন্তপাতিতে সিধু-কানুর মূর্তিতে সকালে গিয়ে মাল্যদান করেন ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক সুনীল কুমার আগরওয়াল । আদিবাসী সামাজিক সংগঠনের নেতা গুরুপদ মুর্মু বলেন, "গত বছরের মতো এ বছরও রাজ্যস্তরীয় হুল দিবস উদযাপনের জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে প্রস্তাব জানিয়েছিলাম । কিন্তু নির্বাচনবিধি জারি থাকার কারণে তা হয়ে ওঠেনি । তাই প্রশাসন তাদের মতো করে হুল দিবস উদযাপন করেছে এবং আমরাও আমাদের মতো করে হুল দিবস উদযাপন করেছি । গত বছরের মত বড়সড়ভাবে হুল দিবস পালিত হল না এই বছর ৷"
আরও পড়ুন: হুল দিবসে কেন্দ্রকে তোপ তৃণমূলের আদিবাসী নেতার
একইভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরে হুল উৎসব ছিল ম্রিয়মাণ । পশ্চিম মেদিনীপুরে শুধু মালা দিয়ে ক্ষান্ত হয় শাসক বিরোধীরা । যদিও এর কারণ হিসেবে তারা নির্বাচনকেই দায়ী করেছে। কারণ ভোটের প্রচারপর্বই চলছে রাত দিন ধরে । এই নিয়ে তৃণমূলের জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা বলেন, যেহেতু ভোটের প্রোটোকল চালু হয়ে গিয়েছে এবং ভোটের প্রচার পর্ব চলছে, তাই বড় করে প্রোগ্রাম করার সময় হয়ে ওঠেনি । কিন্তু প্রতি বারের মতোই বিভিন্ন জায়গায় সিধু কানুর মূর্তিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে । আমাদের ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল-সহ বিভিন্ন সংগঠনও এই হুল দিবস উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করেছে । বেলদা, দাঁতন, সবং, পিংলা, শালবনি, গড়বেতাতেও হুল দিবস পালন হয়েছে ।
অন্যদিকে, পঞ্চায়েত ভোটে হুল দিবসের কোনও খামতি নেই বলে দাবি বিরোধীদের । বিরোধী বিজেপি জেলা সহ-সভাপতি শংকর গুছাইত বলেন, "হুল দিবস আমরা পালন করেছি । আমাদের বিরোধী দলনেতা গোয়ালতোড়ে মালা দিয়েও গিয়েছেন সিধু কানুর মূর্তিতে । এ ছাড়াও আমরা কেরানি চটি, নারায়ণগড়-সহ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় মালা দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ দিয়েছি । তবে পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার পর্ব চলছে । সে ক্ষেত্রে হয়তো কোথাও কোথাও বড় কোনও অনুষ্ঠান করা হয়ে ওঠেনি ।"
একইভাবে বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমানে হুল দিবসের যে চিত্র প্রকাশ্যে এসেছে, তাও কমবেশি একই রকম । পঞ্চায়েত নির্বাচনকে মাথায় রেখে আজ হুল দিবসে আদিবাসী মানুষের মন পেতে দুর্গাপুর মহকুমার কাঁকসার জঙ্গলমহলে শাসক দল থেকে বিরোধী বিজেপি আদিবাসীদের সঙ্গে নিয়ে হুল দিবস পালন করলেন উৎসাহের সঙ্গেই । তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে গত বছর হুল দিবস উপলক্ষে কাঁকসাতে বিরসা মুন্ডার মূর্তি বসানো হয় । মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং নবান্নে বসে ভার্চুয়ালি সেই মূর্তির উদ্বোধন করেন । তার আগে কাঁকসার গড় জঙ্গলের ছোট ছোট যে আদিবাসী প্রায় 12 টি গ্রাম রয়েছে তারা একসময় বামেদের সঙ্গী ছিলেন । 2011 সালে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের সময়ও কাঁকসার জঙ্গলমহল বামেদের পক্ষেই রায় দিয়েছিল ।
আরও পড়ুন: হুল দিবসের অনুষ্ঠানে মমতাকে একহাত নিলেন শুভেন্দু
কাঁকসার জঙ্গল থেকে পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম ব্লকের আদিবাসীদের একটা বড় অংশ 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে গেরুয়া শিবিরের দিকে ঝুঁকে পড়ে । কিন্তু সাম্প্রতিককালে আবার দেখা যাচ্ছে, আদিবাসীরা কিছুটা হলেও শাসক দলের দিকে ঝুঁকেছে । যদিও বাঁকুড়া জেলার ছবিটা একটু অন্যরকম । এখানে সাম্প্রতিক কালে কুড়মি সম্প্রদায় তাঁদেরকে আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত করতে হবে, এমন দাবি নিয়ে গোটা রাজ্য জুড়ে আন্দোলনে নেমেছে । আর আদিবাসীদেরকে দেখা যাচ্ছে কুড়মিদের এই দাবির বিরোধিতায় রাস্তায় নামতে ।
বাঁকুড়ায় এক সময় আদিবাসীরা শাসক দলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল । বাঁকুড়ার তালডাংরা, রায়পুর ব্লক, রানিবাঁধ ব্লক আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা বলেই পরিচিত । এই আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা অনেকেই গেরুয়া শিবিরে নাম লিখিয়েছিলেন । এরা একসময় বামেদের কমিটেড ভোটার ছিলেন । 2011 এর পরিবর্তনের পর এরাও পরিবর্তিত হন । তবে বর্তমানে বাঁকুড়াতেও দেখা গেল হুল দিবসকে সামনে রেখে আদিবাসীদের মন পেতে মরিয়া শাসক দল থেকে বিরোধী বিজেপি নেতৃত্ব ।
বাঁকুড়াতে এক সময় আদিবাসীদের মন পেতে আসতে দেখা গিয়েছিল দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে । মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহুবার বাঁকুড়ার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন । হুল দিবস আদিবাসীদের কাছে অন্যতম পবিত্র দিবস, তাই রাজনৈতিক ফায়দা তোলার উদ্দেশ্যে এখন শাসক থেকে বিরোধী সকলেই সাড়ম্বরে এই দিবসকে পালন করার জন্য তাদের সঙ্গদান করেছে এ বারেও ।