কলকাতা, 23 জুন: পুরানো একটি প্রবাদ আছে ৷ "তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারো, ঘৃণা করতে পারো, কিন্তু আমাকে উপেক্ষা করতে পারবে না ৷" পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য তা একেবারে মানানসই । সংসদের নিম্নকক্ষের সদস্যদের তালিকায় তাঁর দল বিজেপি, কংগ্রেস এবং ডিএমকে-র পরে চতুর্থ স্থানে ৷ তা সত্ত্বেও পটনার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বৈঠকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর গুরুত্বই ছিল সর্বাধিক ।
এতদিন যে বৈঠকের দিকে চোখ ছিল রাজনৈতিক মহলের, আজ তা শুরু হয় কিছুটা বিরোধের আবহে ৷ তৃণমূল কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টি (এএপি)-এর মতো আঞ্চলিক দলগুলি ইতিমধ্যেই নিরঙ্কুশ আধিপত্যের সন্ধানে থাকা কংগ্রেসের দিকে গোপন হুমকি দিয়ে রেখেছে ৷ এই অবস্থায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একের বিরুদ্ধে এক প্রস্তাবটি বেশিরভাগ বিরোধী নেতাদের জন্য বিরোধী জোট এগিয়ে নিয়ে চলার একটি পথ বলে মনে হতে পারে ৷ যে নেতারা জোটের প্রয়োজনে বর্তমানে একে অপরের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে ।
পটনায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও দিদির কৌশলী হাতিয়ার । অভিষেককে সামনে রেখে 68 বছর বয়সি তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো দলের অভ্যন্তরে এমনকী জাতীয় স্তরেও ক্ষমতার মসৃণ হস্তান্তরের বার্তা দিয়েছেন ৷ পিসির অনুপস্থিতিতে 2024 সালের সাধারণ নির্বাচনের দৌড়ে বেশ কয়েকটি বিরোধী বৈঠকে অভিষেকই যে অংশ নেবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । এ দিনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম এবং ডেরেক ও'ব্রায়েনও ।
উল্লেখ্য, 1989 সালে যখন ভিপি সিং-এর নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা রাজীব গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেসকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল, তখন লালু প্রসাদ যাদব সেই বিরোধীদের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন ৷ যেখানে ছিলেন জ্যোতি বসু এবং অটল বিহারী বাজপেয়ীর মতো নেতারাও । আর এ বার দীর্ঘ ব্যবধানের পরে আবারও একই রকম রাজনৈতিক ময়দানে একই রকম উজ্জ্বল উপস্থিতি সেই লালুর ৷ তবে এখন তিনি 75 ৷
আরও পড়ুন: ভারতমাতার নাম নিয়ে স্বৈরতন্ত্রী সরকার চালাচ্ছে বিজেপি: মমতা
রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই বৈঠকে আজ অংশ নেয় 17টি দল এবং প্রথমবারের মতো কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দিতে দেখা যায় । 2024 সালের লড়াইয়ে এই দুই নেতা-নেত্রী একই দিকে থাকছেন কি না তা যদিও এখনও স্পষ্ট নয় ৷
বর্তমানে রাজ্যে শাসকদলের যা পরিস্থিতি, তাতে মমতার জন্য এই বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৷ কারণ তাঁর ভাইপো অভিষেক-সহ তাঁর দলের বেশিরভাগ নেতাকে একাধিক দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং সিবিআই ও ইডি-এর মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি ক্রমাগত জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত প্রক্রিয়া চালিয়ে অস্বস্তিতে রেখেছে রাজ্য সরকারকে ৷ আর বেশিরভাগ বিরোধী দলই একটা ব্যাপারে একমত যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিরোধীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করছে বিজেপি ৷
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের বাসভবনে বিরোধীদের এই বৈঠককে বেশ ফলপ্রসূ বলেই মনে করা হচ্ছে, কারণ বিরোধী সমস্ত নেতাই এ দিন এক মঞ্চে এসেছেন এবং বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছেন ৷ বৈঠক শেষে বিরোধী শিবিরের সবার বক্তব্যের সারসংক্ষেপ করে মমতাই বলেন, "আমরা ঐক্যবদ্ধ"৷
এ দিন মণিপুর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে মমতা সরাসরি গেরুয়া শিবিরকে আক্রমণের পথে যান ৷ এরপর বৈঠকে উপস্থিত প্রত্যেকের নাম করে করে এই বার্তাই দেন যে, আগামী দিনে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দল একটি রণকৌশল তৈরি করে এক পথে হাঁটবে ৷
আরও পড়ুন: 'এখনও সময় যায়নি, এবার কথা শুনুন, বিয়েটা করে নিন'; রাহুলকে পরামর্শ লালুর
সম্ভবত প্রথমবার, কোনও বিরোধী নেতাকে 'ভারতমাতা' বলতে শোনা যায়, যা এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে বিজেপি ব্রিগেডের পেটেন্ট হিসেবে পরিচিত । বছরের পর বছর ধরে যে ভারতমাতার নাম নিয়ে বিজেপি ব্যালট বাক্সে সাফল্য পেয়েছে, সেই স্লোগানকেই ছিনিয়ে নিয়ে মমতা এ দিন বলেন, "আমরাও ভারতমাতাকে ভালোবাসি ৷"
শরদ পাওয়ার, মল্লিকার্জুন খাড়গে, মেহবুবা মুফতি এবং অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও কথায়, বার্তায়, বডি ল্যাঙ্গোয়েজে বিরোধী বৈঠকের মধ্যমণি যেন ছিলেন মমতাই ৷
উল্লেখ্য, মমতা এবং নীতীশ উভয়ের সঙ্গেই অতীতে বিজেপির সখ্যতা ছিল ৷ কিন্তু এই দুই নেতাই এই বিরোধী বৈঠকের মূল উদ্যোক্তা ৷ তাঁরাই আবার বাংলার মাটিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেস ও সিপিএম (সভায় সীতারাম ইয়েচুরির উপস্থিতি) এবং কাশ্মীরের চির প্রতিদ্বন্দ্বী মেহবুবা মুফতি ও ওমর আবদুল্লাহকে এক মঞ্চে টেনে আনার মূল কাণ্ডারী ৷
এখন একটাই কথা বলার, এতগুলো দলের এই প্রচেষ্টা 'অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট' প্রবাদটিকে যেন সত্যি করে না দেয় !