ETV Bharat / state

ব্যক্তিগত ক্যারিশমাই প্রণব-মমতাকে কাছে এনেছিল, বাড়িয়েছিল চাপানউতোরও - প্রণববাবু

মমতা যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখনও এই দুই নেতার সম্পর্ক ছিল আপাত-মধুর । মমতা প্রায়ই 13 নম্বর তালকাটোরা রোডে প্রণববাবুর বাসভবনে যেতেন । রেল বাজেটের ব্যাপারে প্রণববাবুর পরামর্শ নিতেন । যখনই যেতেন, তখনই মমতা সঙ্গে নিয়ে যেতেন চকোলেট ।

প্রণববাবু
প্রণববাবু
author img

By

Published : Aug 31, 2020, 6:31 PM IST

Updated : Sep 1, 2020, 9:48 PM IST

কলকাতা, 31 অগাস্ট: আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতক আগে নীরদ সি চৌধুরি লিখেছিলেন ‘আত্মঘাতী বাঙালি’। আর আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে জ্যোতি বসুর সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল । কিন্তু দলের বাঙালি নেতারাই তখন তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন । জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি ।

অনেক উথালপাথালের পর UPA-র রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় । নাম ঘোষণার সময়ে সোনিয়া গান্ধি এবং মনমোহন সিংহের মাঝখানে দাঁড়ালেন তিনি । করুণানিধির প্রতিনিধি টি আর বালু তাঁকে পরিয়ে দিয়েছিলেন সোনালি রঙের গরদের চাদর । শরদ পাওয়ার থেকে অজিত সিং সকলে হাততালিতে মুখর । এক জন সেদিন সেখানে ছিলেন না, তিনি বঙ্গললনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । শুধু ছিলেন না বললে ভুল হবে, প্রণববাবুর রাষ্ট্রপতি হওয়ার পথে প্রধান বাধা হয়েছিলেন তিনিই ।

কেন এমন হল?

মমতা যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখনও এই দুই নেতার সম্পর্ক ছিল আপাত-মধুর । মমতা প্রায়ই 13 নম্বর তালকাটোরা রোডে প্রণববাবুর বাসভবনে যেতেন । রেল বাজেটের ব্যাপারে প্রণববাবুর পরামর্শ নিতেন । যখনই যেতেন, তখনই মমতা সঙ্গে নিয়ে যেতেন চকোলেট । ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও অম্লান বদনে মমতার দেওয়া চকোলেট খেতেন প্রণববাবু । এ নিয়ে একবার পরিচিত মহলে প্রণববাবু বলেছিলেন, “কী করা যাবে? ও যে মমতা । ও কিছু বললে না শুনে উপায় আছে?”

প্রণববাবু
13 নম্বর তালকাটোরা রোডে প্রণববাবুর বাসভবনে যেতেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

রেল মন্ত্রককে যাতে পরিষেবা কর দিতে না হয়, তার জন্য প্রণববাবু অতিরিক্ত অর্থ সাহায্য করেছিলেন বাজেটে । বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে যতই বাদানুবাদ হোক, মমতা-প্রণব সম্পর্ক ছিল বেশ অনেকটাই সাধারণ । প্রণববাবু কালীঘাটে মমতার বাড়িতেও গিয়েছেন বেশ কয়েকবার । নিজের আত্মজীবনীতে মমতার প্রশংসাও করেছেন । তাহলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় এই দুই জনের সম্পর্ক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করতে শুরু করেছিল কেন? এর কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, এই বিরোধ যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়েও বেশি ব্যক্তিত্ব এবং আবেগের সংঘাত । যার সূচনা হয় প্রণববাবুর অর্থমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই ।

পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিন বছরের মোরাটোরিয়াম চেয়েছিলেন মমতা । মমতার অভিযোগ, সেই সুযোগ না দিয়ে অর্থমন্ত্রী রাজ্যকে বঞ্চিত করেন । তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় মমতার বক্তব্য ছিল, যিনি রাজ্যকে আর্থিক সাহায্য করলেন না, তাঁকেই তৃণমূল সমর্থন করবে? তা হলে রাজ্যের মানুষের কাছে কী জবাব দেওয়া হবে? যদিও প্রণববাবু বহু বার অমিত মিত্রকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, প্রকল্প-ভিত্তিক আর্থিক সাহায্য দেওয়া সম্ভব হতে পারে । কিন্তু কোনও একটি রাজ্যকে পৃথক ভাবে মোরাটোরিয়াম দেওয়া সম্ভব নয় । কেন নয়, তাও বুঝিয়েছিলেন তিনি ।

প্রণববাবু
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন এই দুই নেতার সম্পর্ক ছিল আপাত-মধুর

তবে শুধুই কি আর্থিক প্রস্তাবগুচ্ছ আর মোরাটোরিয়াম নিয়ে বিরোধ? অনেকের যুক্তি যদি সেটাই কারণ হত, তা হলে তো মমতার খুশি মনে প্রণববাবুকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বলে মেনে নেওয়ার কথা ছিল । কারণ, সে ক্ষেত্রে অন্য কেউ অর্থমন্ত্রী হতেন । এবং তাঁকে সামনে রেখে মমতা দাবি আদায়ের সুযোগ পেতেন ।

তাঁদের যুক্তি, আসল কারণ লুকিয়ে ছিল চা-আমন্ত্রণের মধ্যে । 34 বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রণববাবুকে মহাকরণ চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মমতা । চিদম্বরমের মতো নেতারা গেলেও প্রণববাবু যাননি । আর এতেই ক্ষুব্ধ হন মমতা । আসলে, এ জাতীয় বিষয় কোনও দিনই পছন্দ করতেন না প্রণব মুখোপাধ্যায় । আর এটাও ঠিক, রাজনৈতিক মতাদর্শ-ভাবনা চিন্তা-রাজনীতি করার ধরনের দিক থেকে মমতা-প্রণব সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর ।

ছোটোখাটো চেহারার প্রণব মুখোপাধ্যায় সব সময়ই রাশভারী প্রকৃতির । প্রয়োজনের থেকে বেশি কথা বলা কখনই পছন্দ করতেন না । ধুরন্ধর কূটনীতিক থেকে দেশের অন্যতম সফল মন্ত্রী-সংসদের নাম প্রণব মুখোপাধ্যায় । জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কোনও দিনই নজর কাড়তে পারেননি । 1980 তে ইন্দিরা জমানায় যখন অতি সাধারণ কংগ্রেস প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন, সে সময়ও বোলপুর থেকে লড়াই করে হারতে হয়েছিল তাঁকে । রাজনৈতিক মস্তিষ্ক-কূটনৈতিক চিন্তাভাবনায় তিনি ছিলেন অনন্য । কিন্তু, 'জনগণের নেতা' এটা কোনও দিনই হতে পারেননি প্রণব মুখোপাধ্যায় ।

অন্য দিকে, রাস্তায় নেমে রাজনীতিই হল মমতার পরিচয় । বার বারই নিজেকে 'তোমাদের লোক' হিসেবে তুলে ধরতে পছন্দ করেন তিনি । মমতার রাজনীতি করার ধরন সম্পূর্ণ প্রণবের বিপরীত । আবার মমতা যে উগ্রতায় বামেদের বিরোধিতা করে এসেছেন, তাও অনেক সময় পছন্দ ছিল না প্রণববাবুর । মানসিকতার মিল তেমন ভাবে না থাকলেও তাঁরা নিজেদের মধ্যে অনেকটা সমঝোতা করেই চলতেন ।

সন্দেহ নেই, মমতার থেকে অনেক বেশি দিন ধরে রাজনীতির ইনিংস খেলেছেন প্রণববাবু । একই রাজ্যের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত রাজনীতিতে কোনও নতুন ঘটনাও নয় । প্রণববাবুর সঙ্গে অশোক সেনের এক সময় মতপার্থক্য হয়েছিল । ইন্দিরা-জমানায় প্রণববাবুর সঙ্গে বরকত গনি খান চৌধুরির প্রবল সংঘাতের কাহিনিও সুবিদিত । প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে প্রণববাবুর সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর । এখনও সেই সংঘাতের ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে । তবে যাই হোক, প্রণববাবু শেষ দিন পর্যন্ত বলে গিয়েছেন, ‘‘মমতা আমার বোনের মতো”৷ আর রাষ্ট্রপতি নন, প্রণব মুখোপাধ্যায় হলেন মমতার প্রণবদা ।

যদিও, প্রথম দিন থেকে মমতাকে চিনতেন না প্রণব । এই পরিচয়-সূত্রের কাজটা অনেকটা করেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায় । আর অবশ্যই এতে ভূমিকা ছিল প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির ।

গল্পটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক ।

সে দিন রাতে ফোনটা আসতে কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন সুব্রত । ইচ্ছে না থাকলেও, ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা ধরেছিলেন । ঘড়ির কাঁটা তখন রাত একটার কাছাকাছি ।

ফোনের ও-প্রান্তে প্রণব মুখোপাধ্যায় । AICC-র অন্যতম শীর্ষ নেতা । রাজীব গান্ধির নির্দেশেই সে-দিন ফোনটা করা । আসলে, বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলার জন্য মহিলা মুখ খুঁজছিলেন ইন্দিরা-পুত্র । সামনেই লোকসভা নির্বাচন । বাংলায় মাটিতে কিছু একটা ভালো করতে চান । ঘুমের চোখেই সে দিন প্রণবের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন সুব্রত । দু-এক মিনিট না ভেবেই মমতার নাম প্রস্তাব করেছিলেন । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন চুটিয়ে কংগ্রেস করছেন । তাঁর বাম বিরোধিতাও চরমে । তবে, সুব্রত চিনলেও মমতার সঙ্গে তেমন পরিচিতি ছিল না প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির ।

পরের ধাপই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যাদবপুরে প্রার্থী খোঁজাকে কেন্দ্র করে । এই কেন্দ্রের প্রার্থী CPI(M)-র দোর্দণ্ডপ্রতাপ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় । রাজীবের বদ্ধমূল ধারণা ছিল সোমনাথের মতো নেতাকে বেগ দিতে এক জন মহিলা প্রার্থী দরকার । কিন্তু কাকে? তেমন ভাবে কোনও নামই মনে করতে পারছিলেন না রাজীব-প্রণবরা । প্রাথমিক ভাবে পদ্মা খাস্তগিরের নাম নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও তাঁর উপর তেমন ভরসা ছিল না দিল্লির নেতাদের । আসলে, পেশায় আইনজীবী খাস্তগির আর এক আইনজীবীকে বেগ দিতে পারেন বলে দিল্লির নেতাদের বিশ্বাস ছিল না । ঠিক তখনই সুব্রতর মমতা-প্রস্তাব যেন কিছুটা ভরসা দিল । আসলে তরুণ মমতার তীব্র বাম বিরোধিতা ইতিমধ্যেই নজর কাড়তে শুরু করেছিল ।

মমতাকে যাদবপুর থেকেই প্রার্থী করল কংগ্রেস । শুরুতেই চমক । প্রভাবশালী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে লোকসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ।

1984 । সেই প্রথম প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কিছুটা কাছে আসার সুযোগ । যদিও প্রণব তখন রাজ্যসভার সদস্য । মমতা লোকসভার । দিল্লিতে থাকার সুবাদে দু'জনের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে উঠতে শুরু করে । যত সময় এগিয়েছে একাধিক বিষয়ে মমতা-প্রণব সম্পর্ক (আপাত দৃষ্টিতে) মজবুত হয়েছে । একাধিক বিষয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে । রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও রাজ্যের একাধিক বিষয় নিয়ে প্রণব-মমতার মধ্যে বারবার কথা হয়েছে ।

রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও এই দু'জনের সম্পর্কটা ছিল দাদা-বোনের মতোই । বারবার প্রোটোকল ভেঙে নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া রেখেছেন তাঁরা । তাই তো, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও মমতাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, "প্রণবদা কেমন আছো?" ৷ দাদা প্রণবও মমতার শরীরের হাল দেখে উষ্মা প্রকাশ করে তাঁকে রাষ্ট্রপতি ভবনে কয়েক দিন বিশ্রাম নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন । আবার প্রণবকে দার্জিলিঙে দিন কয়েক কাটিয়ে যাওয়ার অনুরোধও করেছেন মমতা । বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে জনপ্রিয় নেত্রী বলে আখ্যা দিতেও শোনা গিয়েছে প্রণবকে । নিজের আত্মজীবনীতে মমতার জনপ্রিয়তার প্রশংসা করেছেন । আবার অপমানিত হওয়ার কথাও বলেছেন । লিখেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণে ‘অপমানিত’ হয়েছেন, কিন্তু মমতা এমন মানুষ, যাঁকে ‘অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়’।

বইতে প্রণববাবু লিখেছেন, নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের এক বৈঠক ছেড়ে কী ভাবে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । কী ভাবে মমতা চক্রান্তের অভিযোগও তুলেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে । তবে সপ্রশংস কলমে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মূল্যায়ন, মমতা আজ যেখানে পৌঁছেছেন, তা সম্পূর্ণ তাঁর নিজেরই কৃতিত্ব । প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি নিজের লেখায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘জন্ম বিদ্রোহী’ আখ্যা দিয়েছেন । নিজের রাজনৈতিক জীবনকে নির্ভীক এবং লড়াকু মনোভাব নিয়ে গড়ে তুলেছেন মমতা । লিখেছেন প্রণববাবু । সেই প্রসঙ্গেই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, মমতার রাজনৈতিক সাফল্য ‘তাঁর নিজের লড়াইয়ের ফল’।

সাংগঠনিক নির্বাচন না করে সমঝোতার মাধ্যমে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি এবং অন্যান্য পদাধিকারী নির্বাচনের যে প্রস্তাব রাখা হয়েছিল দলের সর্বভারতীয় নেতৃত্বের তরফে, মমতা সেই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন বলে প্রণব মুখোপাধ্যায় লিখেছেন । তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম এবং অসম্মানিত ও অপমানিত বোধ করেছিলাম ।’’ কংগ্রেসে বার বার এই দু'জনের ভিন্ন অবস্থার ছবি ধরা পড়েছে । 1992 সালে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়-সহ শীর্ষ প্রদেশ নেতাদের সমর্থন পেলেও কেন হারতে হয়েছিল, শেষ মুহূর্তে কী কারণে সব সমীকরণ পালটে সোমেন মিত্র জয়ী হয়েছিলেন? এ প্রশ্নের সঠিক কোনও উত্তর আজও নেই ।

আসলে ভিন্ন মেরুতে থাকা দুই বঙ্গ-সন্তানের ক্যারিশমাই তাঁদের কাছে এনেছে । আবার দূরেও সরিয়েছে । কখনও তাঁরা সমঝোতার পথে গিয়েছেন । কখনও আবার ব্যক্তিগত সম্পর্ক সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে । মমতা সম্পর্কে প্রণববাবুর স্নেহসিক্ত মূল্যায়ন, মমতার আচরণের ‘‘ব্যাখ্যা করা কঠিন, কিন্তু তাঁকে অবজ্ঞা করাও কঠিন ।’’

কলকাতা, 31 অগাস্ট: আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতক আগে নীরদ সি চৌধুরি লিখেছিলেন ‘আত্মঘাতী বাঙালি’। আর আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে জ্যোতি বসুর সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল । কিন্তু দলের বাঙালি নেতারাই তখন তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন । জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি ।

অনেক উথালপাথালের পর UPA-র রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় । নাম ঘোষণার সময়ে সোনিয়া গান্ধি এবং মনমোহন সিংহের মাঝখানে দাঁড়ালেন তিনি । করুণানিধির প্রতিনিধি টি আর বালু তাঁকে পরিয়ে দিয়েছিলেন সোনালি রঙের গরদের চাদর । শরদ পাওয়ার থেকে অজিত সিং সকলে হাততালিতে মুখর । এক জন সেদিন সেখানে ছিলেন না, তিনি বঙ্গললনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । শুধু ছিলেন না বললে ভুল হবে, প্রণববাবুর রাষ্ট্রপতি হওয়ার পথে প্রধান বাধা হয়েছিলেন তিনিই ।

কেন এমন হল?

মমতা যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখনও এই দুই নেতার সম্পর্ক ছিল আপাত-মধুর । মমতা প্রায়ই 13 নম্বর তালকাটোরা রোডে প্রণববাবুর বাসভবনে যেতেন । রেল বাজেটের ব্যাপারে প্রণববাবুর পরামর্শ নিতেন । যখনই যেতেন, তখনই মমতা সঙ্গে নিয়ে যেতেন চকোলেট । ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও অম্লান বদনে মমতার দেওয়া চকোলেট খেতেন প্রণববাবু । এ নিয়ে একবার পরিচিত মহলে প্রণববাবু বলেছিলেন, “কী করা যাবে? ও যে মমতা । ও কিছু বললে না শুনে উপায় আছে?”

প্রণববাবু
13 নম্বর তালকাটোরা রোডে প্রণববাবুর বাসভবনে যেতেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

রেল মন্ত্রককে যাতে পরিষেবা কর দিতে না হয়, তার জন্য প্রণববাবু অতিরিক্ত অর্থ সাহায্য করেছিলেন বাজেটে । বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে যতই বাদানুবাদ হোক, মমতা-প্রণব সম্পর্ক ছিল বেশ অনেকটাই সাধারণ । প্রণববাবু কালীঘাটে মমতার বাড়িতেও গিয়েছেন বেশ কয়েকবার । নিজের আত্মজীবনীতে মমতার প্রশংসাও করেছেন । তাহলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় এই দুই জনের সম্পর্ক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করতে শুরু করেছিল কেন? এর কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, এই বিরোধ যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়েও বেশি ব্যক্তিত্ব এবং আবেগের সংঘাত । যার সূচনা হয় প্রণববাবুর অর্থমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই ।

পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিন বছরের মোরাটোরিয়াম চেয়েছিলেন মমতা । মমতার অভিযোগ, সেই সুযোগ না দিয়ে অর্থমন্ত্রী রাজ্যকে বঞ্চিত করেন । তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় মমতার বক্তব্য ছিল, যিনি রাজ্যকে আর্থিক সাহায্য করলেন না, তাঁকেই তৃণমূল সমর্থন করবে? তা হলে রাজ্যের মানুষের কাছে কী জবাব দেওয়া হবে? যদিও প্রণববাবু বহু বার অমিত মিত্রকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, প্রকল্প-ভিত্তিক আর্থিক সাহায্য দেওয়া সম্ভব হতে পারে । কিন্তু কোনও একটি রাজ্যকে পৃথক ভাবে মোরাটোরিয়াম দেওয়া সম্ভব নয় । কেন নয়, তাও বুঝিয়েছিলেন তিনি ।

প্রণববাবু
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন এই দুই নেতার সম্পর্ক ছিল আপাত-মধুর

তবে শুধুই কি আর্থিক প্রস্তাবগুচ্ছ আর মোরাটোরিয়াম নিয়ে বিরোধ? অনেকের যুক্তি যদি সেটাই কারণ হত, তা হলে তো মমতার খুশি মনে প্রণববাবুকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বলে মেনে নেওয়ার কথা ছিল । কারণ, সে ক্ষেত্রে অন্য কেউ অর্থমন্ত্রী হতেন । এবং তাঁকে সামনে রেখে মমতা দাবি আদায়ের সুযোগ পেতেন ।

তাঁদের যুক্তি, আসল কারণ লুকিয়ে ছিল চা-আমন্ত্রণের মধ্যে । 34 বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রণববাবুকে মহাকরণ চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মমতা । চিদম্বরমের মতো নেতারা গেলেও প্রণববাবু যাননি । আর এতেই ক্ষুব্ধ হন মমতা । আসলে, এ জাতীয় বিষয় কোনও দিনই পছন্দ করতেন না প্রণব মুখোপাধ্যায় । আর এটাও ঠিক, রাজনৈতিক মতাদর্শ-ভাবনা চিন্তা-রাজনীতি করার ধরনের দিক থেকে মমতা-প্রণব সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর ।

ছোটোখাটো চেহারার প্রণব মুখোপাধ্যায় সব সময়ই রাশভারী প্রকৃতির । প্রয়োজনের থেকে বেশি কথা বলা কখনই পছন্দ করতেন না । ধুরন্ধর কূটনীতিক থেকে দেশের অন্যতম সফল মন্ত্রী-সংসদের নাম প্রণব মুখোপাধ্যায় । জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কোনও দিনই নজর কাড়তে পারেননি । 1980 তে ইন্দিরা জমানায় যখন অতি সাধারণ কংগ্রেস প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন, সে সময়ও বোলপুর থেকে লড়াই করে হারতে হয়েছিল তাঁকে । রাজনৈতিক মস্তিষ্ক-কূটনৈতিক চিন্তাভাবনায় তিনি ছিলেন অনন্য । কিন্তু, 'জনগণের নেতা' এটা কোনও দিনই হতে পারেননি প্রণব মুখোপাধ্যায় ।

অন্য দিকে, রাস্তায় নেমে রাজনীতিই হল মমতার পরিচয় । বার বারই নিজেকে 'তোমাদের লোক' হিসেবে তুলে ধরতে পছন্দ করেন তিনি । মমতার রাজনীতি করার ধরন সম্পূর্ণ প্রণবের বিপরীত । আবার মমতা যে উগ্রতায় বামেদের বিরোধিতা করে এসেছেন, তাও অনেক সময় পছন্দ ছিল না প্রণববাবুর । মানসিকতার মিল তেমন ভাবে না থাকলেও তাঁরা নিজেদের মধ্যে অনেকটা সমঝোতা করেই চলতেন ।

সন্দেহ নেই, মমতার থেকে অনেক বেশি দিন ধরে রাজনীতির ইনিংস খেলেছেন প্রণববাবু । একই রাজ্যের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত রাজনীতিতে কোনও নতুন ঘটনাও নয় । প্রণববাবুর সঙ্গে অশোক সেনের এক সময় মতপার্থক্য হয়েছিল । ইন্দিরা-জমানায় প্রণববাবুর সঙ্গে বরকত গনি খান চৌধুরির প্রবল সংঘাতের কাহিনিও সুবিদিত । প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে প্রণববাবুর সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর । এখনও সেই সংঘাতের ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে । তবে যাই হোক, প্রণববাবু শেষ দিন পর্যন্ত বলে গিয়েছেন, ‘‘মমতা আমার বোনের মতো”৷ আর রাষ্ট্রপতি নন, প্রণব মুখোপাধ্যায় হলেন মমতার প্রণবদা ।

যদিও, প্রথম দিন থেকে মমতাকে চিনতেন না প্রণব । এই পরিচয়-সূত্রের কাজটা অনেকটা করেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায় । আর অবশ্যই এতে ভূমিকা ছিল প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির ।

গল্পটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক ।

সে দিন রাতে ফোনটা আসতে কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন সুব্রত । ইচ্ছে না থাকলেও, ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা ধরেছিলেন । ঘড়ির কাঁটা তখন রাত একটার কাছাকাছি ।

ফোনের ও-প্রান্তে প্রণব মুখোপাধ্যায় । AICC-র অন্যতম শীর্ষ নেতা । রাজীব গান্ধির নির্দেশেই সে-দিন ফোনটা করা । আসলে, বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলার জন্য মহিলা মুখ খুঁজছিলেন ইন্দিরা-পুত্র । সামনেই লোকসভা নির্বাচন । বাংলায় মাটিতে কিছু একটা ভালো করতে চান । ঘুমের চোখেই সে দিন প্রণবের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন সুব্রত । দু-এক মিনিট না ভেবেই মমতার নাম প্রস্তাব করেছিলেন । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন চুটিয়ে কংগ্রেস করছেন । তাঁর বাম বিরোধিতাও চরমে । তবে, সুব্রত চিনলেও মমতার সঙ্গে তেমন পরিচিতি ছিল না প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির ।

পরের ধাপই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যাদবপুরে প্রার্থী খোঁজাকে কেন্দ্র করে । এই কেন্দ্রের প্রার্থী CPI(M)-র দোর্দণ্ডপ্রতাপ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় । রাজীবের বদ্ধমূল ধারণা ছিল সোমনাথের মতো নেতাকে বেগ দিতে এক জন মহিলা প্রার্থী দরকার । কিন্তু কাকে? তেমন ভাবে কোনও নামই মনে করতে পারছিলেন না রাজীব-প্রণবরা । প্রাথমিক ভাবে পদ্মা খাস্তগিরের নাম নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও তাঁর উপর তেমন ভরসা ছিল না দিল্লির নেতাদের । আসলে, পেশায় আইনজীবী খাস্তগির আর এক আইনজীবীকে বেগ দিতে পারেন বলে দিল্লির নেতাদের বিশ্বাস ছিল না । ঠিক তখনই সুব্রতর মমতা-প্রস্তাব যেন কিছুটা ভরসা দিল । আসলে তরুণ মমতার তীব্র বাম বিরোধিতা ইতিমধ্যেই নজর কাড়তে শুরু করেছিল ।

মমতাকে যাদবপুর থেকেই প্রার্থী করল কংগ্রেস । শুরুতেই চমক । প্রভাবশালী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে লোকসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ।

1984 । সেই প্রথম প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কিছুটা কাছে আসার সুযোগ । যদিও প্রণব তখন রাজ্যসভার সদস্য । মমতা লোকসভার । দিল্লিতে থাকার সুবাদে দু'জনের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে উঠতে শুরু করে । যত সময় এগিয়েছে একাধিক বিষয়ে মমতা-প্রণব সম্পর্ক (আপাত দৃষ্টিতে) মজবুত হয়েছে । একাধিক বিষয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে । রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও রাজ্যের একাধিক বিষয় নিয়ে প্রণব-মমতার মধ্যে বারবার কথা হয়েছে ।

রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও এই দু'জনের সম্পর্কটা ছিল দাদা-বোনের মতোই । বারবার প্রোটোকল ভেঙে নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া রেখেছেন তাঁরা । তাই তো, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও মমতাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, "প্রণবদা কেমন আছো?" ৷ দাদা প্রণবও মমতার শরীরের হাল দেখে উষ্মা প্রকাশ করে তাঁকে রাষ্ট্রপতি ভবনে কয়েক দিন বিশ্রাম নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন । আবার প্রণবকে দার্জিলিঙে দিন কয়েক কাটিয়ে যাওয়ার অনুরোধও করেছেন মমতা । বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে জনপ্রিয় নেত্রী বলে আখ্যা দিতেও শোনা গিয়েছে প্রণবকে । নিজের আত্মজীবনীতে মমতার জনপ্রিয়তার প্রশংসা করেছেন । আবার অপমানিত হওয়ার কথাও বলেছেন । লিখেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণে ‘অপমানিত’ হয়েছেন, কিন্তু মমতা এমন মানুষ, যাঁকে ‘অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়’।

বইতে প্রণববাবু লিখেছেন, নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের এক বৈঠক ছেড়ে কী ভাবে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । কী ভাবে মমতা চক্রান্তের অভিযোগও তুলেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে । তবে সপ্রশংস কলমে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মূল্যায়ন, মমতা আজ যেখানে পৌঁছেছেন, তা সম্পূর্ণ তাঁর নিজেরই কৃতিত্ব । প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি নিজের লেখায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘জন্ম বিদ্রোহী’ আখ্যা দিয়েছেন । নিজের রাজনৈতিক জীবনকে নির্ভীক এবং লড়াকু মনোভাব নিয়ে গড়ে তুলেছেন মমতা । লিখেছেন প্রণববাবু । সেই প্রসঙ্গেই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, মমতার রাজনৈতিক সাফল্য ‘তাঁর নিজের লড়াইয়ের ফল’।

সাংগঠনিক নির্বাচন না করে সমঝোতার মাধ্যমে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি এবং অন্যান্য পদাধিকারী নির্বাচনের যে প্রস্তাব রাখা হয়েছিল দলের সর্বভারতীয় নেতৃত্বের তরফে, মমতা সেই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন বলে প্রণব মুখোপাধ্যায় লিখেছেন । তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম এবং অসম্মানিত ও অপমানিত বোধ করেছিলাম ।’’ কংগ্রেসে বার বার এই দু'জনের ভিন্ন অবস্থার ছবি ধরা পড়েছে । 1992 সালে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়-সহ শীর্ষ প্রদেশ নেতাদের সমর্থন পেলেও কেন হারতে হয়েছিল, শেষ মুহূর্তে কী কারণে সব সমীকরণ পালটে সোমেন মিত্র জয়ী হয়েছিলেন? এ প্রশ্নের সঠিক কোনও উত্তর আজও নেই ।

আসলে ভিন্ন মেরুতে থাকা দুই বঙ্গ-সন্তানের ক্যারিশমাই তাঁদের কাছে এনেছে । আবার দূরেও সরিয়েছে । কখনও তাঁরা সমঝোতার পথে গিয়েছেন । কখনও আবার ব্যক্তিগত সম্পর্ক সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে । মমতা সম্পর্কে প্রণববাবুর স্নেহসিক্ত মূল্যায়ন, মমতার আচরণের ‘‘ব্যাখ্যা করা কঠিন, কিন্তু তাঁকে অবজ্ঞা করাও কঠিন ।’’

Last Updated : Sep 1, 2020, 9:48 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.