কলকাতা, 20 জুন: পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার শক্তিবৃদ্ধির অন্যতম কাণ্ডারী বামেরা ৷ তাদের দাবি, বামেদের জন্যই গ্রামের মানুষের ভোটাধিকার প্রক্রিয়া বঙ্গে নিয়মিত ভাবে চলে আসছে সেই 1978 সাল থেকে ৷ 14 বছর পর সে বার পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন 1973 অনুযায়ী, সরাসরি নির্বাচনের মধ্যে 15টি জেলা পরিষদ, 324টি পঞ্চায়েত সমিতি ও 3,242টি গ্রাম পঞ্চায়েতের 56,000 প্রতিনিধির ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল ৷ বামফ্রন্টের প্রথম চেয়ারম্যান প্রমোদ দাশগুপ্ত সে সময় গরিবদের অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন ৷ আর সেই ভাবনাকে কাজে করে দেখিয়েছিল জ্যোতি বসুর সরকার ৷ কাট টু 2023 ৷ আবারও রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন ৷ মনোনয়ন পর্ব জমা দেওয়া শেষ ৷ এ বার ফাইনাল ম্যাচের অপেক্ষা ৷ এই অবস্থায় বামেরা ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে ?
একসময়ে লালদুর্গ হিসেবে পরিচিত অনেক জেলাতেই প্রার্থীই দিতে পারেনি বামেরা ৷ অবশ্য শাসকের বাধার মুখেও পড়তে হয়েছে বেশকিছু জায়গায় ৷ 2008-এই শেষবার পঞ্চায়েতে বড়সড় সাফল্যের মুখ দেখেছে কাস্তে হাতুড়ি তারা ৷ এরপর কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর ৷ এ বার রাজ্যে দুর্নীতি ও হিংসা নিয়ে অস্বস্তিতে থাকা তৃণমূল এবং মেরুকরণের রাজনীতি করার অভিযোগে অভিযুক্ত বিজেপিকে কি টক্কর দিতে পারবে মহম্মদ সেলিম, বিমান বসুদের দল ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে রাজ্যের বিভিন্ন অংশের ছবিটা দেখে নেওয়া প্রয়োজন ৷
দুই পরগনা, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের ছবি
সিপিআইএম বা বামেদের গড় হিসেবে পরিচিত ছিল উত্তর 24 পরগনার ব্যারাকপুর, বসিরহাট, বনগাঁ; দক্ষিণ 24 পরগনার ভাঙড়, ক্যানিং, ডায়মন্ড হারবার; নদিয়ার পলাশিপাড়া, তেহট্ট, রানাঘাট লোকসভার বিরাট একটা অংশ । উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ কংগ্রেস ঘাঁটি । তারপরও মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে বরাবরই লড়াইটা হয় বাম-কংগ্রেসে । এ বার সেখানে বাইরন বিশ্বাস জিতলেও এখন তিনি তৃণমূলে । পূর্ব বর্ধমানের একটা বড় অংশে সিপিআইএম-এর বড় ভূমিকা ছিল ।
বীরভূমে দুর্বল বামেদের সংগঠন
তবে বীরভূমের সঙ্গে পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট, কেতুগ্রামে বামেরা প্রার্থী দিতে পারেনি । আদিবাসীদের নিয়ে রামচন্দ্র ডোম বীরভূম থেকে বহুবার জিতেছেন । প্রয়াত আইনজীবী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় মনোনীত হয়েছেন । অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতারির পর সেই বীরভূম আবার বামেদের দিকে ঘুরতে শুরু করে । কিন্তু, যেভাবে সেখানে বামেদের সংগঠন ভেঙে পড়েছে, তাতে হালে পানি পেতে সমস্যা হবে । তারপরও 52টি জেলা পরিষদ আসনের জন্য তৃণমূল ও বিজেপির তরফে 59টি করে মনোনয়ন জমা পড়েছে । সিপিএম 46টি ও কংগ্রেস 16টি আসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছে । অনেক আসনেই মোট আসন সংখ্যার থেকেই বেশি মনোনয়ন জমা দিয়েছে শাসক দল ৷ এক-একটি আসনে দু-তিনজন করেও প্রার্থী দেওয়া হয়েছে ৷
আরও পড়ুন: 'হুমকি না স্বেচ্ছায়!' সালানপুরে বামেদের মনোনয়ন তোলার হিড়িক ঘিরে প্রশ্ন
উত্তরের বহু আসনে প্রার্থীই দিতে পারেনি বামেরা
উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারে বিজেপির অবস্থা ভালো । আর বামদের অবস্থা খারাপ । উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় গোলমাল হয়েছে । সেখানে আটটি গ্রাম পঞ্চায়েতের 217টি আসনের মধ্যে 214টিতে বিরোধীরা এ বার প্রার্থী দিতে পারেনি । পঞ্চায়েত সমিতির 28টি আসনে বিরোধী কোনও প্রার্থী নেই । পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর ব্লকের 51 শতাংশ আসনে কোনও বিরোধী প্রার্থী নেই এ বার । গ্রাম পঞ্চায়েতের 305টি আসনের মধ্যে 163টি আসনে শাসক দল তৃণমূল মনোনয়ন জমা দিয়েছে ।
মালদহের কালিয়াচকের তিনটি পঞ্চায়েত সমিতির আসনে বিরোধীদের প্রার্থী নেই । একই ভাবে বাঁকুড়ার পাত্রসায়র, জয়পুর ও কোতুলপুর পঞ্চায়েত সমিতির একটি আসনেও সিপিএমের প্রার্থী নেই । হুগলির জাঙ্গিপাড়া ব্লকের 10টির মধ্যে 7টি পঞ্চায়েতেও বামেরা প্রার্থী দিতে পারেনি ।
বর্ধমানে ঘর গোছানোর চেষ্টায় বামেরা
এককালে সিপিআইএমের গড় ছিল বর্ধমান । রাজ্যে ক্ষমতা বদলের পরে সিপিআইএমের দাপট কমতে শুরু করে । বিগত লোকসভা ভোটের পরে গেরুয়া শিবিরের পালে কিছুটা হাওয়া লাগে । সেইসময় সিপিআইএমের শিবিরের ভোট গেরুয়া শিবিরের দিকে গিয়েছিল, এ কথা সিপিআইএমের জেলা সম্মেলনের প্রতিবেদনেও স্বীকার করে নেওয়া হয় । তাই পঞ্চায়েত ভোটে ফের ঘর ঘোছানোর চেষ্টা করছে সিপিআইএম । তাদের দাবি, পঞ্চায়েতে মানুষ ভোট দিতে পারলে নির্বাচনের ছবিটা বদলে দেবে সিপিআইএম-ই ।
মনোনয়ন পেশে বাধার অভিযোগ সিপিআইএম-এর
মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রথম দিন থেকেই সিপিআইএমকে মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে শাসক দলের বিরুদ্ধে । দুই পক্ষের সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বর্ধমানের বড়শুল । এই ঘটনায় তিন পুলিশ কর্মী-সহ দুই পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হন । পুলিশ ওই ঘটনায় নয় জনকে গ্রেফতার করে ।
সিপিআইএমের দাবি, পঞ্চায়েত নির্বাচনে সাধারণ মানুষ তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে । তারা জানে বামই ভরসা । তাই শাসক দল ভয় পেয়েছে । সেই কারণে বামেদের মনোনয়নে বাধা দিয়েছে । বামেদের মতে, এই বাধার কারণে তারা পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির সব আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি ।
পূর্ব বর্ধমানে কার কত মনোনয়ন
পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদে আসন সংখ্যা 66টি । এর মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের 69 জন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন । বামফ্রন্টের মধ্যে সিপিআইএমের 65 জন প্রার্থী ও ফরওয়ার্ড ব্লকের 4 জন মনোনয়ন জমা দিয়েছেন । পঞ্চায়েত সমিতিতে আসন সংখ্যা 640 টি । তৃণমূল কংগ্রেসের 684 জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন । সিপিআইএমের তরফে 546 জন মনোনয়ন জমা দিয়েছেন ।
পূর্ব বর্ধমান জেলায় গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যা 215 টি । সেখানে 3807 টি আসনে ভোটগ্রহণ করা হবে । তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গ্রাম পঞ্চায়েতের জন্য মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন 4550 জন । সিপিআইএমের 3039 জন ও ফরওয়ার্ড ব্লকের তরফে 18 জন মনোনয়ন জমা দিয়েছেন ।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক সৈয়দ হোসেন বলেন, "জেলা পরিষদের সমস্ত আসনে বামেরা প্রার্থী দিয়েছেন । পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির মনোনয়ন জমা দিতে গেলে বামেদের বাধা দেওয়া হয় । তবে মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারলে পঞ্চায়েত ভোটের ছবিটা বদলে যাবে ।"
আরও পড়ুন: বাম থেকে তৃণমূলেও 'শাসন আছে শাসনেই', আবারও বিরোধী-শূন্য ভেড়ি এলাকার পঞ্চায়েত
একসময়ের লালদুর্গ জলপাইগুড়িতেও বহু আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি বামেরা
সিপিআইএম গড় বলে একসময়ে পরিচিত জলপাইগুড়ি জেলায় এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনেক আসনেই প্রার্থীই দিতে পারেনি বামেরা । একটা সময় যেখানে সিপিআইএম-এর বিরুদ্ধে এখানে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারতেন না, সেখানে এ বার প্রার্থী দেওয়াটাই চ্যালেঞ্জ ছিল সিপিআইএম-এর কাছে । রাজ্যে 2011 সালে পালাবদলের পর তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার এলেও সে বছর রাজ্যে একটিমাত্র জেলা ছিল, যেখানে সিপিআইএম জেলাপরিষদ দখল করেছিল । কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে 2016 সালে সিপিআইএমের দখলে থাকা জেলাপরিষদও ভাঙিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের দখলে করে নেয় ।
বাম দুর্গ হিসেবে পরিচিত জলপাইগুড়ি জেলা 2016 সাল পর্যন্ত বামেদের দখলে থাকা রাজ্যের একমাত্র জেলাপরিষদ ছিল । 2013 সালে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদ বামেদের দখলে গেলেও 2016 সালে দলবদলের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদ দখল করে তৃণমূল । সিপিআইএম থেকে ধীরে ধীরে বিজেপিতে কর্মীরা চলে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন বিজেপির জেলা সভাপতি বাপী গোস্বামী ।
2018 সালে একক ভাবে জিতে জেলাপরিষদ দখল করল তৃণমূল । জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের 19টি আসনের মধ্যে 19টি আসনেই তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হলেও বামফ্রন্টের গড় জলপাইগুড়ি জেলায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বিজেপি । তৃণমূল কংগ্রেস যা ভোট পেয়েছে তাতে গেরুয়া শিবির যে ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলেছে তা বলাই যায় । পঞ্চায়েতের পরেই 2019 সালে লোকসভা নির্বাচনে 1 লক্ষ 84 হাজার ভোটে জয়ী হন বিজেপি প্রার্থী ডা. জয়ন্তকুমার রায় ৷
তৃণমূল কংগ্রেস জলপাইগুড়ি জেলায় জেলা পরিষদ এলাকায় ভোট পেয়েছিল 5 লক্ষ 98 হাজার 488টি ৷ পাশাপাশি ওই এলাকায় বিজেপি ভোট পেয়েছিল 3 লক্ষ 48 হাজার 92টি ভোট । চা বাগান অধ্যুষিত বামের ঘাঁটিতে বিজেপি ভোট বেশি পেয়েছিল । বামফ্রন্টের গড় হিসেবে পরিচিত জলপাইগুড়িতে তৃণমূল ভালো ফল করলেও বিজেপির উত্থান ভালো ভাবে হয় 2018 সাল থেকে । কারণ 2013 সালে বিজেপির আসন ছিল 32টি ৷ 2018 সালে বিজেপি 5টি গ্রামপঞ্চায়েত দখল করার পাশাপাশি 41টি পঞ্চায়েত সমিতির আসন পায় । এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামেদের থেকে বেশি মনোনয়ন জমা করেছে বিজেপি । ফলে বলাই যায়, সেখানে ধীরে ধীরে শক্তি হারাচ্ছে সিপিআইএম ৷
আরও পড়ুন: মনোনয়নের শেষ দিনেও ঝরল রক্ত, চোপড়ায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত বাম ও কংগ্রেস কর্মী
জলপাইগুড়িতে মনোনয়নের ছবি
এ বার সিপিআইএম মনোনয়ন জমা করেছে জলপাইগুড়ির গ্রাম পঞ্চায়েতের 1057টি আসনে, পঞ্চায়েত সমিতির 184টি আসনে ও জেলা পরিষদের 22টি আসনে । জেলার 80টি গ্রাম পঞ্চায়েতের 1701টি আসনের মধ্যে সিপিআইএম 1057 জন প্রার্থীর মনোনয়ন জমা করলেও 644টি আসনে মনোনয়ন জমা করতে পারেনি । অন্যদিকে, পঞ্চায়েত সমিতির 238টি আসনের মধ্যে 184 আসনে মনোনয়ন জমা করলেও 54টি পঞ্চায়েত সমিতির আসনে মনোনয়ন জমা করতে পারেনি সিপিআইএম ।
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেস এই জেলার গ্রাম পঞ্চায়েতের 1701টি আসনের মধ্যে 1829টি মনোনয়ন জমা করেছে । একই আসনে একই দলের অনেক জন প্রার্থী মনোনয়ম জমা করেছেন । পঞ্চায়েত সমিতির 238টি আসনের মধ্যে 298টি মনোনয়ন জমা করেছে শাসক দল । জেলা পরিষদের 24টি আসনের মধ্যে 28টি মনোনয়ন জমা করেছে তৃণমূল কংগ্রেস । সিপিআইএম-এর জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য বলেন, "কত বেশি আসনে প্রার্থী দেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই চালিয়ে গিয়েছি ।"
এ দিকে, বিজেপির জেলা সভাপতি বাপী গোস্বামী বলেন, "আমরা আমাদের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছি । আমরা ভেবেছিলাম তার থেকেও বেশি আসনে আমরা প্রার্থী দিতে পেরেছি । বাম ছেড়ে বিজেপিতে আসছে লোকজন । তারা বুঝতে পেরেছে যে সিপিআইএম-এর কোনও নীতি আদর্শ বলে কিছুই নেই । যখন যাকে পায় তার হাত ধরে । ধীরে ধীরে সিপিআইএম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ।"