কলকাতা, 10 ফেব্রুয়ারি: রাজ্যের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ লুধিয়ানা থেকে ডানকুনি পর্যন্ত তৈরি হওয়া ইস্টার্ন ফ্রেট করিডর (Freight Corridor) । রাজ্য সরকারও এই প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন চায় । কারণ, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে রাজ্যের শিল্প বাণিজ্য ক্ষেত্রের প্রভূত উন্নয়ন হবে । কিন্তু সরকারের নীতিগত অবস্থান এই প্রকল্পের রূপায়ণের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে অভিযোগ । সরকার ও রেল উভয়ের দড়ি টানাটানিতে এই প্রকল্প নিয়ে অশনি সংকেত দেখছে রাজনৈতিক মহল । আর সেই কারণেই এই প্রকল্প নিয়ে উঠছে প্রশ্ন ।
তথ্য বলছে, পাঁচ রাজ্যের মধ্যে দিয়ে আসা 1856 কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্রেট করিডরের কাজ শুরু হয়েছিল 2005 সালে । 2017 সালের মধ্যে এই ফ্রেট করিডোরের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার । এরপর পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও সেই কাজ শেষ করা যায়নি । পাঁচ রাজ্যের মধ্যে এখনও পর্যন্ত মাত্র 799 কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে । কিন্তু রেলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাকি রেলপথের একটা বড় অংশই পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে রয়েছে । আর পশ্চিমবঙ্গের এই প্রকল্পের কাজ রূপায়ণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হল জমি অধিগ্রহণ ।
রেল (Indian Railway) কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, এই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় প্রকল্পের জন্য জমি পেতে কার্যত হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের । সরকারের তরফ থেকে ফ্রেট করিডর নির্মাণের জন্য সব রকম সাহায্যের কথা বলা হলেও এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না । বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে উচ্ছেদ হতে পারে এমন অংশের পক্ষে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করছে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরাই । এই অবস্থায় এই প্রকল্প কবে বাস্তবায়িত করা যাবে, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন ।
ইতিমধ্যেই ফ্রেট করিডর তৈরির জন্য জবরদখলকারীদের হটানোর নির্দেশ দিতেই আন্দোলন শুরু হয়েছে । আসানসোলের ডিপোপাড়া, রেলপাড় অঞ্চলে একটি বাজার সরানো হবে । উচ্ছেদ করা হবে ব্যবসায়ীদের । পাশাপাশি ওই এলাকায় উচ্ছেদ করা হবে বহু বাসিন্দাকেও । রেলের তরফে পুনর্বাসনের কোনও প্রতিশ্রুতি নেই । কার্যত এই ফ্রেট করিডর স্থাপনের জন্য গৃহহীন, কর্মহীন হবেন বহু মানুষ । আর তাই প্রতিবাদে ধর্না মঞ্চ করে চলছে আন্দোলন । ইতিমধ্যেই রেল দোকান ভাঙতে এলে বুলডোজারের সামনে শুয়ে পড়েন ব্যবসায়ীরা । শতাধিক ছোটবড় দোকান রয়েছে পুরো এলাকাজুড়ে । কয়েকশো বাসিন্দা ওই এলাকায় বাস করেন ।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী মলয় ঘটক (Moloy Ghatak) । আসানসোল ডিপোপাড়া অঞ্চলে সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের ডাকা একটি সভায় গিয়ে তিনি বলেন, "রেলের ফ্রেট করিডর তৈরির জন্য কোনও ব্যবসায়ী বা বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করতে দেওয়া হবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত রেল পছন্দমতো পুনর্বাসন দেয় । উচ্ছেদ আটকাতে সমস্ত লড়াই আমরা করব । প্রয়োজনে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়েই আমি লড়াই করব । তার জন্য যদি গুলি খেতে হয় সেটাও খাব ।"
আবার মলয় ঘটকের এই বক্তব্যকে কটাক্ষ করেছেন বিজেপি (BJP) নেতা জিতেন্দ্র তেওয়ারি । তিনি বলেন, ‘‘রেল যখন ফ্রেট করিডর তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় রেল, তখন জমি অধিগ্রহণের আগে রাজ্য সরকারকে জানায় । এই জেলার জেলাশাসক থেকে শুরু করে ওই অঞ্চলের বিধায়ক এবং রাজ্যের মন্ত্রী মলয় ঘটক প্রত্যেকের বিষয়টি নিয়ে অবগত আছেন এবং তাঁরা রেলকে সম্মতি দিয়েছেন যে কোথায় জমি অধিগ্রহণ করা হবে । একদিকে রেলকে সম্মতি দেবেন আর অন্যদিকে মানুষের কাছে এসে নাটক করবেন, এটা হতে পারে না । ওই অঞ্চলের করতে যদি মানুষজনকে উচ্ছেদ করা হয়, তার জন্য দায়ী রাজ্য সরকার, বিধায়ক ও মন্ত্রী মলয় ঘটক, আসানসোলের মেয়র ।’’
তাঁর আরও দাবি, ‘‘আমি যতদিন মেয়র ছিলাম একজনকেও উচ্ছেদ করতে পারেনি রেল । আর মলয় ঘটকের যদি মনে হচ্ছে রেল এটা অন্যায় করছে, উনি তো আইনমন্ত্রী, উনি আইনগতভাবে সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছেন না কেন ? সাংসদ শত্রুঘ্ন সিনহা কয়েকদিন আগে নাটক করে গেলেন আসানসোলে । তেমনই মানুষের সঙ্গেও এঁরা নাটক করছেন ।"
এদিকে একই ছবি দুর্গাপুর থানা এলাকার ডিটিপিএস, বিজয়নগর, ওয়ারিয়া মানা রেল বস্তি, খাটাল পাড়া, দুর্গাপুর স্টেশন সংলগ্ন রেল বস্তি, বুদবুদ থানা এলাকার । বেশ কিছু জায়গায় রেল বস্তি উচ্ছেদ অভিযানে গিয়েও বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে রেল কর্তৃপক্ষকে । মাত্র কয়েকদিন আগেই বিজয়নগর রেল বস্তি উচ্ছেদ অভিযান এগিয়ে প্রবল বাধার মুখে পড়েন রেল কর্তৃপক্ষ । ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় বিজেপি বিধায়ক লক্ষ্মণ ঘোড়ুইকেও ।
বারবার এই বস্তি উচ্ছেদের জন্য দলের পক্ষ থেকে নোটিশ দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিন্তু কিছুই হয়নি । স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের মদতেই এই সমস্ত রেল বস্তির বাসিন্দারা রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন । রেললাইনের পাশে থাকায় বস্তির বাসিন্দাদের দাবি একটাই, আগে তাদেরকে পুনর্বাসন দেওয়া হোক ৷ তারপর উচ্ছেদ ।
এদিকে এই নিয়ে রেলের তরফ থেকে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, এই ফ্রেট করিডোরের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা জমি অধিগ্রহণ । এখনও পর্যন্ত 97 শতাংশ জমি পাওয়া গিয়েছে। 100 শতাংশ জমি না পাওয়া গেলে এই প্রকল্প কবে শেষ হবে, তা স্পষ্ট ভাষায় বলা যাচ্ছে না । অন্যদিকে, এই নিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘ফ্রেট করিডর বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে সব রকম সাহায্য করছে রাজ্য । কিন্তু রেলকে জমি নিলে তার পুনর্বাসন দিতে হবে ।’’
আরও পড়ুন: ফ্রেট করিডর নিয়ে ক্ষুব্ধ মমতা, চিঠি দিলেন রেলমন্ত্রীকে