কলকাতা, 29 মে : দেশের গোয়েন্দাদের কাছে সে ছিল মোস্ট ওয়ান্টেড । জামাত-উল-মুজাহিদিনের ধাত্রীভূমি বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের খাতাতেও জ্বলজ্বল করছে তার নাম । বোমারু মিজান ওরফে কওসর এবং ইজ়াজ় আহমেদকে গ্রেপ্তার করার পর জামাত-উল-মুজাহিদিন ইন্ডিয়া ওরফে জামাত-উল-মুজাহিদিন হিন্দের পরিচালনায় বড় ভূমিকা নিয়েছিল আবদুল করিম ওরফে বড় করিম । তেমনই খবর পাচ্ছিলেন গোয়েন্দারা । জামাত-উল-মুজাহিদিন জঙ্গিদের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় এই মুহূর্তে তিন নম্বরে নাম ছিল বড় করিমের । আজ তাকে গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দারা মনে করছে সালাউদ্দিন সম্পর্কে বড়সড় ব্রেকথ্রু পাওয়া যাবে । কারণ জামাত-উল-মুজাহিদিন জঙ্গিদের অন্দরমহলে সালাউদ্দিনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এই করিম । শান্ত স্বভাব আর ঠান্ডা মাথার জন্যই দ্রুত জঙ্গি দলের মধ্যে তার উত্থান ।
2005 সালের 17 অগাস্ট । সিরিয়াল বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশের মাটি । যার মূল চক্রী হিসেবে উঠে আসে সালাউদ্দিন ওরফে সালোহিনের নাম । পরে বাংলাদেশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে । দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় তিনটি মামলায় তার মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ আদালত । 2014 সালের 23 ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের প্রিজ়ন ভ্যানে তাকে এবং কওসরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল অন্য জেলে । সেই প্রিজ়ন ভ্যানে পুরোপুরি সিনেমার কায়দায় ঘিরে ধরে করা হয় আক্রমণ । জঙ্গিদের গুলিতে মৃত্যু হয় এক পুলিশকর্মীর । সালাউদ্দিন, কওসর এবং রাকিবুল হাসানকে পুলিশের কবল থেকে নিয়ে পালায় জামাত জঙ্গিরা । পরে অবশ্য বাংলাদেশের মির্জাপুরে পুলিশের এনকাউন্টারে মৃত্যু হয় রাকিবুল হাসানের । কিন্তু সালাউদ্দিন এবং কওসর পালিয়ে আসে ভারতে । তারপরই পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গিবাদের ইতিহাস বইতে শুরু করে অন্য খাতে ।
মুর্শিদাবাদে জামাত যোগের কথা প্রথম সামনে আসে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর । জানা যায়, মুর্শিদাবাদ সীমান্ত দিয়েই বাংলাদেশের কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশের সদস্যরা প্রথমবার ভারতে ঢোকে । হলি আর্টিজান মামলায় বাংলাদেশে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত হাত কাটা নাসিরুল্লাহ ঢুকেছিল লালগোলা সীমান্ত দিয়ে । তারপর সীমান্ত লাগোয়া মোকিমনগরে তৈরি করে ঘাঁটি । একটু একটু করে দখল করে নেয় মোকিমনগর মাদ্রাসা । সেখান থেকেই শুরু করে মগজ ধোলাইয়ের কাজ । আবার বেলডাঙার বোরখা ঘর নামে পোশাকের দোকানের আড়ালে বোমা সরবরাহের ডেরাও তৈরি করা হয়েছিল । তার আড়ালে ছিল শাকিল গাজ়ি । সেখানে যাতায়াত ছিল হাত কাটা নাসিরুল্লাহর । খাগড়াগড়কাণ্ড নিয়ে NIA-র তদন্তে উঠে এসেছিল মুর্শিদাবাদের উমরপুরে জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশের সাইবার সেল তৈরির পরিকল্পনা করেছিল নাসিরুল্লাহ । তার জন্য অসম সরকারের তরফে ছাত্রদের দেওয়া ল্যাপটপ জোগাড় করেছিল সে । জোগাড় করেছিল বেশ কয়েকজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকেও ।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরই ফের সামনে আসে সালাউদ্দিন এবং কওসরের নাম । জানা যায়, ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে ঢুকে মাত্র আট মাসের মধ্যে মুর্শিদাবাদ, মালদা, বীরভূম, নদিয়া, বর্ধমানে জঙ্গিদের জাল বিস্তার করে ফেলেছে সালাউদ্দিন । তখনও পর্যন্ত সে জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশের আমের (শীর্ষ নেতা) । খাগড়াগড় বিস্ফোরণে প্রচুর ধরপাকড় হলেও সালাউদ্দিন, বোমারু মিজানদের টিকিটিও ছুঁতে পারেননি গোয়েন্দারা । এর মাঝে ওই জঙ্গি সংগঠনের হয়ে যায় আড়াআড়ি বিভাজন । রাগচটা স্বভাবের কওসর এবং হাতকাটা নাসিরুল্লাহর অন্তর্দ্বন্দ্ব এক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছিল । পরে মতাদর্শের পার্থক্য দেখা যায় । হাতকাটা নাসিরুল্লাহ বিশ্বাস করত ধীরে-সুস্থে নয়, জেহাদ করতে হবে দুরন্ত গতিতে । সালাউদ্দিনের বিশ্বাস আবার ছিল অন্য । নাসিরুল্লাহর সঙ্গে বাংলাদেশের আরও কিছু জঙ্গি নেতারা মিলে যায় । সে দেশে তৈরি হয়ে যায় নব্য জামাত বা নিও JMB। তারা ISIS-এর মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে ।
শোনা যায় আল-কায়দার হয়ে আফগান যুদ্ধ লড়ে আসা সালাউদ্দিন আঁকড়ে ধরেছিল লাদেনের পথ । খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ধরপাকড় কিছুটা শান্ত হতে ফের স্বমহিমায় ফিরতে শুরু করে জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ । এই সময়েই সালাউদ্দিনের সঙ্গে আলাপ হয় আবদুল করিমের । সালাউদ্দিনের দাওয়াতেই সে নাম লেখায় জঙ্গি খাতায় । এই সময় থেকেই মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হতে শুরু করে একের পর এক মডিউল । পায়ের তলার মাটি শক্ত করার পরই সালাউদ্দিন জানিয়ে দেয় আর শুধুমাত্র JMB নয় । এবার সমগ্র উপমহাদেশে সরানো হবে সংগঠন । সেই সূত্রে খোলা হয় জামাত-উল-মুজাহিদিনের ভারত চ্যাপ্টার । নাম দেওয়া হয় জামাত-উল-মুজাহিদিন ইন্ডিয়া বা জামাত-উল-মুজাহিদিন হিন্দ । যার অন্যতম ঘাঁটি হয়ে ওঠে মুর্শিদাবাদ । পরে বুদ্ধগয়া বিস্ফোরণে একের পর এক জঙ্গিকে মুর্শিদাবাদ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় । প্রথমে পয়গম্বর শেখ এবং জমিরুল ইসলামকে ফাঁসিদেওয়া থেকে গ্রেপ্তার করে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স । তাদের কাছ থেকেই জানা যায়, জামাত-উল-মুজাহিদিন নয়, তাদের ভারতীয় শাখা তৈরি হয়েছে । জামাত-উল-মুজাহিদিন ইন্ডিয়া । তার আমের (শীর্ষ নেতা) নির্বাচিত হয়েছে বোমারু মিজান ওরফে কওসর ।
পয়গম্বরদের কাছে 50 কেজি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মতো বিস্ফোরক পাওয়া যায় । পরে উদ্ধার হয় প্রচুর IED, জিলেটিন স্টিক । তারপর শুরু হয় একের পর এক ধরপাকড় । জানা যায়, রাজ্যের বেশ কয়েকটি জায়গায় মডিউল তৈরি করে ফেলেছে জামাত-উল-মুজাহিদিন ইন্ডিয়া । সবথেকে বেশি মডিউল আছে মুর্শিদাবাদে । সেখানে যুবকদের দাওয়াত দেওয়ার মাধ্যমে চলছে মগজ ধোলাই । ভারত-বিরোধী চক্রান্তের বড়সড় কৌশল নেওয়া হচ্ছে মুর্শিদাবাদের মাটিতে বসেই । এর মাঝে জামাত-উল-মুজাহিদিন ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা আমের কওসর এবং তার পরের আমের ইজ়াজ়কে গ্রেপ্তার করা হয় । তখন রকেটের গতিতে উত্থান হচ্ছে করিমের । সে হয়ে ওঠে ধুলিয়ান মডিউলের মাথা । ধৃত করিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইতিমধ্যেই গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে মুর্শিদাবাদে এলে সালাউদ্দিন তার সামসেরগঞ্জের বাড়িতেই আশ্রয় নিত । অন্যান্য বেশ কিছু শীর্ষ জঙ্গি নেতার গোপন ডেরার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল এই করিম । গোয়েন্দারা নিশ্চিত সালাউদ্দিনের সঙ্গে এখনও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে করিমের । সেই সূত্র ধরেই জামাত-উল-মুজাহিদিনের উপমহাদেশের শীর্ষনেতার নাগাল পেতে চাইছে গোয়েন্দারা ।