কলকাতা, 15 অগাস্ট : স্বাধীনতা আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছে বর্তমান ভারতের ছোট-বড় অনেক রাজ্য ও শহর ৷ সেই তালিকায় রয়েছে কলকাতাও ৷ সেরকম সময়েরই একটি চরিত্র সতীশ বসু ৷ যার নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত হয়েছিল যুবসমাজ ৷ পরাধীন ভারতে মধ্য ও উত্তর কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছিল শরীর চর্চার আখড়া ৷ গোবর গোহ আখড়া ও পঞ্চান্ন ব্যায়াম সমিতি বাঙালিকে শরীর চর্চা ও কুস্তিতে অনুশীলন দিচ্ছে সেই সময় ৷ বাবু সংস্কৃতির মায়াজাল সরিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে গলা চড়াতে শুরু করেছে বাঙালি ৷ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় কংগ্রেস ৷ বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেছে তারা ৷ এরইমধ্যে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করতেই আন্দোলনের লেলিহান শিখা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে ৷
সেই সময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দু -মুসলিম নির্বিশেষে প্রতিবাদ সংঘটিত করছে । সেই আন্দোলনে বাড়তি মাত্রা যোগ করে রবি ঠাকুরের রাখি বন্ধন কর্মসূচি । এমন এক সময়ে গোয়া বাগানোর গোবর গোহর আখড়া থেকে কুস্তি করে বাড়ি ফিরছিলেন সতীশ বসু ৷ বর্তমান উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের চার মাথার মোড়ে দেখেন এক ভারতীয়কে ইংরেজরা পেটাচ্ছেন ৷ স্বাভাবিকভাবে রক্ত গরম হয়ে ওঠে সতীশের ৷ ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ করতে উদ্যত হন তিনি ৷ কিন্তু একা প্রতিবাদ করলে হেনস্থা হতে হবে, এই আশঙ্কায় তাঁকে বাধা দেয় বন্ধুরা ৷ বিষয়টি সেদিনের মতো মেনে নেন সতীশ ৷ মনে মনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করতে যুবকদের তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি । সেই ভাবনা থেকেই 1902 সালে জন্ম অনুশীলন সমিতির ।
উত্তর কলকাতার মদন মিত্র লেনে শুরু হয় অনুশীলন সমিতির যাবতীয় কর্মকাণ্ড । মূলত লাঠি খেলা, তলোয়ার চালানো ও কুস্তির মাধ্যমে যুবকদের শারীরিক ভাবে সক্ষম করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল । যা আদতে ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা । এই কাজে হাত বাড়ান স্বামী বিবেকানন্দের সিমলার বাড়ির পড়শি ব্যারিস্টার পি মিত্র । সমাজে নিজের প্রভাব থাকায় এই ধরনে সংগঠনের প্রাথমিক ভিত তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন পি মিত্র । গ্রহণ করেছিলেন সভাপতির দায়িত্বভার । অনুশীলন সমিতির ভাবনায় রসদ পেয়ে যুক্ত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সিস্টার নিবেদিতা, অমরেন্দ্রনাথ বসু ও যতীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ।
1908 সালে ইংরেজ সরকার অনুশীলন সমিতির গোপন উদ্দেশ্যের আঁচ পেয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে । শুরু হয় ধরপাকড় । সেইসময় অনুশীলন সমিতিকে টিকিয়ে রাখতে সংগঠনকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন সমিতির বিশিষ্টরা । ফলস্বরূপ সারা রাজ্যে প্রায় 100 টি অনুশীলন সমিতি গড়ে ওঠে । দর্জিপাড়ার অনুশীলন সমিতির জন্ম তারই ফল । বাংলাদেশের ঢাকায় এই আদর্শেই গড়ে তোলা হয়েছিল যুগান্তর । এই দুই সংস্থা সিদ্ধান্ত নেয় একযোগে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেবে ৷ খবর পাওয়ায় শুরু হয় পুলিশি অত্যাচার । কিন্তু দমে থাকেনি অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর ৷ এই দুই সংগঠনের সদস্যরা পালিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নিজেদের সংগঠিত করার কাজ করতে থাকে ।
1947 সালের 15 অগাস্ট ভারত স্বাধীন হয় । তারপর অনুশীলন সমিতি কোন লক্ষ্যে এগোবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় । বিপ্লবীদের ব্যবহৃত তলোয়ার ও লাঠি কোথায় থাকবে তা নিয়ে শুরু হয় মত পার্থক্য । পরে পুলিশ সেগুলো নিয়ে যায় ৷ কিন্তু ব্যায়ামের জন্য ব্যবহৃত ডাম্বেলগুলো দিয়ে যায় ক্লাবকে । মহান বিপ্লবীদের হাতে গড়া পূণ্য ভূমি রক্ষার তাগিদে সদস্যরা সমিতিতে ব্যাডমিন্টন কোচিং ক্যাম্প তৈরির পরামর্শ দেন । উত্তর কলকাতায় ফুটবল ও ক্রিকেট প্রশিক্ষণের অনেক জায়গা আছে । কিন্তু ব্যাডমিন্টন শেখানোর ক্লাব নেই । তাই ব্যাডমিন্টন কোচিং ক্যাম্প তৈরির বিষয়ে এগিয়ে আসেন প্রাক্তন খেলোয়াড় সুব্রত ব্যানার্জি । তারপর থেকেই অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের আখড়া ব্যাডমিন্টন ক্লাবের রূপ নেয় ।
বর্তমানে অনুশীলন সমিতির অন্যতম কর্ণধার চন্দন ভট্টাচার্য বলেন, "যুব সমাজ এখন এই পূণ্যভূমি রক্ষার ব্যাপারে সেভাবে আগ্রহী নয় । তাদের এই অনাগ্রহে তৈরি হচ্ছে সমস্যা । বিশেষ করে প্রশাসনিক কর্মসূচি চালানোর ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে ৷ এই ঐতিহাসিক ক্লাব আপাতত সংসদ তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য পেলেও পরবর্তীতে এই ক্লাবের ব্যাটন ধরবে কে তা বড় প্রশ্ন ।"