কলকাতা, 1 নভেম্বর : শত্রুর শত্রু মানে বন্ধু! কিন্তু বাইরের বন্ধুকে ডাকতে গিয়ে যদি ঘরের আসন টলে যায় ?
তৃণমূল এবং BJP-র মোকাবিলায় বিধানসভা উপ-নির্বাচনে বাম ও কংগ্রেসের বোঝাপড়ার চর্চার মাঝেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এল এই প্রশ্ন । ভাবনাটা ছিল দুই শিবিরেই । আশু বিপদ ঠেকানোর তাগিদে আদর্শগত ও রাজনৈতিক ব্যবধান আপাতত মুছে ফেলে দুই শক্তি যখন কাছাকাছি আসার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলল, কী হবে তার পরে ? কে কার জন্য কী ভাবে আসন ছাড়বে ? আরও স্পষ্ট করে বললে, খড়্গপুর, করিমপুর, কালিয়াগঞ্জের প্রার্থী দেওয়া নিয়ে অবশেষে কিছুটা সমঝোতায় এল বাম এবং কংগ্রেস । নদিয়া জেলার করিমপুর কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন মহুয়া মৈত্র । তিনি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার কারণে তাঁর ফাঁকা জায়গায় উপ-নির্বাচন হচ্ছে । একই রকমভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুর কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন দিলীপ ঘোষ । তিনিও এবারে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন । দিলীপ ঘোষের ফেলে আসা বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হচ্ছে। এছাড়াও কালিয়াগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক প্রমথনাথ রায়ের মৃত্যু হয়েছে । সেই শূন্য জায়গাতে এবারে উপ-নির্বাচন হচ্ছে ।
25 তারিখ এই তিন বিধানসভায় উপ-নির্বাচন । গেরুয়া শিবির থেকে মোটামুটিভাবে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করে ফেলা হয়েছে । বৃহস্পতিবারই তিন কেন্দ্রে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে তৃণমূল । খড়্গপুরের তৃণমূল প্রার্থী হলেন প্রদীপ সরকার । করিমপুরের প্রার্থী বিমলেন্দু সিংহরায় এবং কালিয়াগঞ্জের প্রার্থী হলেন তপনদেব সিংহ । তবে, তৃণমূল বা গেরুয়া শিবির নয়, এই উপ-নির্বাচনে সব থেকে বেশি নজর ছিল বাম-কংগ্রেসের দিকে । কারণ, বেশ কিছুদিন ধরেই দুই শিবির থেকে সমঝোতার কথা বলা হলেও নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছিল । প্রশ্ন উঠছিল শীর্ষ নেতাদের সদিচ্ছা নিয়ে । দুই দলেরই কিছু নেতা আবার সমঝোতা নিয়ে নিজেদের আপত্তির কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন প্রকাশ্যে ।
রীতিমতো অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে থাকা সোমেন মিত্র বা সূর্যকান্ত মিশ্রদের দল কী শেষ পর্যন্ত হাত ধরবে ? এই প্রশ্ন যখন তীব্র হচ্ছিল, তখনই সমঝোতার কথা জানিয়ে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করলেন বিমান বসু-সোমেন মিত্ররা । কেবলমাত্র করিমপুর বিধানসভা উপ-নির্বাচনের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে বামফ্রন্ট । আইনজীবী এবং দীর্ঘদিন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত গোলাম রাব্বিকে প্রার্থী করা হয়েছে করিমপুরে । অন্যদিকে, খড়গপুর সদর এবং কালিয়াগঞ্জে কংগ্রেস প্রার্থীকে জেতানোর আবেদন জানিয়েছেন ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু । গত দু'দিন ধরে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে বামফ্রন্ট নেতৃত্বের দফায় দফায় বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান বিমান ।
প্রত্যেকটি বিধানসভায় ভোটারদের ভোট সুনিশ্চিত করতে আবেদন জানিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র । বৃহস্পতিবার প্রদেশ নির্বাচনী কমিটির সভায় উত্তর দিনাজপুর এবং পশ্চিম মেদিনীপুর এই দুই জেলা কমিটির সুপারিশ মেনে 34 কালিয়াগঞ্জ এবং 224 খড়গপুর সদর বিধানসভা উপ-নির্বাচনের বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় । কালিয়াগঞ্জ বিধানসভায় ধীতশ্রী রায় (কালিয়াগঞ্জের প্রয়াত বিধায়ক প্রমথনাথ রায়ের মেয়ে) এবং খড়গপুর সদরে চিত্তরঞ্জন মণ্ডলের নাম প্রদেশ নির্বাচন কমিটি চূড়ান্ত করেছে । চিত্তরঞ্জনের পাশাপাশি নাম উঠে আসছে উদয় সিংয়ের । যদিও খড়গপুর সদরের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে পাল্লা ভারি চিত্তরঞ্জনের । যেহেতু কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের কো-অর্ডিনেশন কমিটি তিনটি বিধানসভাতেই গঠিত হবে, সেজন্য কালীগঞ্জের জন্য শঙ্কর মালাকার, খড়গপুরের জন্য শুভঙ্কর সরকার এবং কংগ্রেস সমর্থিত বামফ্রন্ট প্রাথী গোলাম রাব্বির জন্য নদিয়া জেলার পর্যবেক্ষক অমিতাভ চক্রবর্তীকে শীর্ষে রেখে কমিটি তৈরি করা হবে বলে কংগ্রেস সূত্রে খবর ।
পরিস্থিতি যাই হোক, আগামী 25 তারিখ চর্তুমুখী নয় ত্রিমুখী লড়াই হতে চলেছে রাজ্যে । শেষ পর্যন্ত বাম-কংগ্রেস সমঝোতা সফল হবে কি না, সেটা তো ভবিষ্যত্ বলবে । মুখে সাফল্যের কথা বললেও, বঙ্গ রাজনীতিতে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রবক্তাও আবদুল মান্নানও কাছের মানুষদের কাছে সন্দেহ প্রকাশ করে ফেলেছেন । তবে, মোটের উপর প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, জোট বা সমঝোতা এখন আর বাম এবং কংগ্রেস, কোনও শিবিরের কাছেই বেছে নেওয়া’র সুযোগ নেই । বরং, দু’পক্ষের কাছেই সমঝোতাই এখন পারস্পরিক ‘বাধ্যবাধকতা’। সোমেনবাবুরা মনে করছেন, বাংলায় গেরুয়া ঝড় উঠছে, বিষয়টা এমন নয় । ঘটনা হল, তৃণমূলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে । বাম ও কংগ্রেস দুর্বল বলেই মানুষ অন্য দিকে ঝুঁকছেন । বাম ও কংগ্রেস একজোট হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে মোদি-শাহের পালের হাওয়া আবার কেড়ে নেওয়া সম্ভব ।
যদিও মাত্র এক মাসের মধ্যেই সব স্পষ্ট হয়ে যাবে । ফল যাই হোক, ফল প্রকাশের পর তিনটি বিষয় আমজনতার কাছে সহজ হয়ে যাবে-
ক) বাম-কংগ্রেস জোট সাফল্য পেলে আগামী দিনে অনেক সমীকরণ নতুন করে ভাবতে হবে, নতুন সমীকরণ তৈরিও হবে ।
খ) জোটের সাফল্য না এলে এবং তৃণমূল এককভাবে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা ফের একবার স্পষ্ট হয়ে যাবে । 2021-এর ভোটের আগে দলকে বাড়তি অক্সিজেন দেবে ।
গ) যদি গেরুয়া ঝড়ের আভাস মেলে তাহলে আগামী বিধানসভা ভোটের আগে মমতা এবং তাঁর সৈনিকদের আশঙ্কা আরও বহুগুণ বেড়ে যাবে । বাড়তি উদ্যম পাবেন দিলীপ ঘোষ-মুকুল রায়রা । তৃণমূলের 'পতনের' চিত্রটাও হয়তো আঁকা হয়ে যাবে ।