কলকাতা, 18 ফেব্রুয়ারি: কেউ বি টেক পাশ, কেউ আবার বি কম। আবার কেউ ইংরেজিতে এমএ । আমাদের রাজ্যে বহু যুবকযুবতী আছেন, যাঁরা চাকরির আশায় এখনও বুক বেঁধেছে ৷ কিংবা রাজপথের ধারে বসে ন্যায় নিয়োগের জন্য আন্দোলন করছেন । কেন্দ্র বা রাজ্য বাজেটে বেকারত্ব ঘোঁচাবার প্রতিশ্রুতি মিললেও আদতে তৃণমূল স্তরে যে চিত্র তার মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক । সেই ফারাকের জলজ্যান্ত উদাহরণ সৌরভ ঠাকুর (Sourav Thakur)। বলা ভালো বি কম চাওয়ালা সৌরভ । আদর্শ বিদ্যা মন্দির থেকে পড়াশোনা ৷ এরপর শ্যামাপ্রসাদ কলেজ থেকে বি কম করেও কেন সৌরভকে খুলতে হল চায়ের দোকান ?
বি কম চাওয়ালা সৌরভ: পড়াশোনা করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে...৷ ছোটবেলায় পড়াশোনা না-করলে বাবা মা এই কথাটি বলেন । তবে সৌরভ ঠাকুরের ক্ষেত্রে কথাটা একটু বোধহয় অন্যরকম । পড়াশোনা করে যে চায়ের দোকান দেয় সে । বন্ডেল গেটের বাসিন্দার ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই হয়েছে । কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক করে আজ তিনি একটি চায়ের দোকান চালায় । নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ সৌরভ ঠাকুর । বাবা-মা অনেক কষ্ট করে তাঁকে পড়াশোনা শিখিয়েছেন । ভেবেছিলেন পড়াশোনা করে তাঁদের ছেলে ভালো চাকরি করবে।
চায়ের দোকানের কথা প্রথমে বলেননি কাউকে: বেশ কয়েকটি চাকরি পেয়েছিলেন সৌরভ । তবে যে চাকরি তিনি পেয়েছিলেন তাতে বেতন খুবই স্বল্প । সংসার চলবে না । বাবার এবং দাদাদের সাহায্য না-করলে এই মূলবৃধির জামানায় সংসার চালানো দিনে দিনে দুষ্কর হয়ে উঠছিল । তাই বেশ কিছুদিন চেষ্টা করার পর অবশেষে হাল ছেড়ে দেন তিনি ৷ নিজের উদ্যোগে কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন সৌরভ । যেমন ভাবা তেমনই কাজ। কিন্তু কী করবেন তিনি ? ভাবতে ভাবতে চায়ের দোকান দেবে বলে মনস্থির করেন সৌরভ। তবে বাড়ির লোক কী বলবে, সেই ভেবে তাঁর এই মনের কথা তিনি কাউকে বলতে পারেননি। অবশেষে দাদাকে সৌরভ তাঁর মনে কথা জানান। নিজের পুঁজি এবং দাদার অর্থ সাহায্য নিয়েই লেক মার্কেটের কাছে একটি চায়ের দোকান শুরু করেন সৌরভ।
আম লিচু-সহ আট রকমের ফ্লেভারের চা: তাঁর দোকানের নাম দিয়েছে নিজের শিক্ষার ডিগ্রি মোতাবেক, বি কম চাওয়ালা। একমাস হল সৌরভ এই চায়ের দোকান শুরু করেছেল। ইতিমধ্যেই এই চত্বরে চায়ের দোকানের নাম এবং চায়ের স্বাদের জন্য প্রতিদিনের বেশ কিছু বাধা খোদ্দেরও জুটিয়ে ফেলেছে তিনি । শুধু তাই নয়, বি-কম চাওয়ালায় কাছে পাওয়া যায় নয় নয় করে আট রকমের ফ্লেভারের চা। সৌরভের ফ্লেভার চাও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে । তিনি বলেন, "আমি গর্ব করে বলি আমি বি কম পাশ চাওয়ালা । আমি কোন চুরি বা দুর্নীতি না-করে সৎ পথে উপার্জন করছি । এই জন্য আমি গর্বিত । অনেক চাকরির চেষ্টা করেও যখন মনমত কোনও চাকরি মিলল না, তখন আমি ভাগ্য এবং নিজের পুঁজির জোরেই এই ব্যবসা শুরু করলাম ।
সৌরভের রয়েছে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন: সৌরভ জানান, প্রথমে তিনি বাড়িতে এ বিষয়ে কিছু জানাননি । তবে ব্যবসা শুরু করার পর বাড়িতে জানান তিনি । প্রথমটায় তাঁর বাবার কিছুটা খারাপ লাগতো । তবে পরে সৌরভকে খুশি দেখে তাঁর বাড়ির লোকও মেনে নিয়েছে সবটা । তিনি আরও জানান, তাঁর অনেক বন্ধু আছে যাঁরা পড়াশোনা শিখে আজও চাকরি না-পেয়ে হতাশায় ভুগছেন ৷ তাঁরাও এখন সৌরভের ব্যবসার মত কিছু একটা করার কথা ভাবছেন । বয়স মাত্র 23 হলেও ছোট এই চায়ের স্টলকে ঘিরে সৌরভের রয়েছে স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া । শুরুটা চা দিয়ে করলেও ধীরে ধীরে দোকানকে আরও বাড়াতে চায় তিনি । বিভিন্ন রকমের খাবার রাখাও পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর । শুধু এখানেই শেষ নয়, বি কম চাওয়ালা নামে বিভিন্ন জায়গায় দোকান খুলে একটি ফুড চেনও শুরু করতে চান সৌরভ ।
সরকারের ব্যর্থতাকেই দুষছেন এলাকার মানুষজন: বি কম চাওয়ালার দোকানের নিয়মিত খদ্দের নীলাদ্রি ভট্টাচার্য বলেন, "যেদিন থেকে সৌরভ এখানে চায়ের দোকান দিয়েছে সেই দিন থেকে আমি এখানে চা খাচ্ছি । আমাদের রাজ্যে চাকরি-বাকরির যা বাজার, সেখানে একটা শিক্ষিত ছেলে নিজের পুঁজির উপর ভর করে ব্যবসা শুরু করেছে সেটাই তো অনেক বড় কথা । আজ থেকে 10 বছর আগের মানুষ কখনও চিন্তাই করতে পারতো না যে একটা বি কম পাশ ছেলে চায়ের দোকান চালাচ্ছে । মুখ্যমন্ত্রী প্রথম থেকেই নিয়োগের কথা বলে আসছেন । এখন আদালতের রায়েতে সেই নিয়োগের অবস্থা দেখতে পাচ্ছি ।"
চাকরির হাল বেহাল: আর এক খদ্দের গৌতম দাস জানান, একটা শিক্ষিত ছেলেকে আজকে চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে চায়ের দোকান চালাতে হচ্ছে ৷ এর থেকে আর লজ্জার কথা তাঁদের কাছে কী হতে পারে ৷ স্বাভাবিকভাবেই এদের আর কিছু করার নেই ৷ চাকরি নেই, কলকারখানা নেই, তাই তারা কোথায় গিয়ে চাকরি করবেন । গৌতম আরও জানান, তাঁরও ছেলে রয়েছে, তিনিও স্নাতক পাশ করেছেন ৷ যেহেতু গৌতমের একটা ছোট ব্যবসা রয়েছে, তাই তিনি ছেলেকে সেখানে কাজে নিয়ে নিয়েছেন।
আরও পড়ুন: চাকরি নেই ! পেট চালাতে দুই ইঞ্জিনিয়ারের চায়ের দোকান, বি'টেক চা-ওয়ালা