কলকাতা, 20 জুন : ভোটগণনায় গরমিল রয়েছে । অভিযোগটা 2 মে থেকেই করে আসছিলেন । এবার নন্দীগ্রাম কেন্দ্রের বিধানসভা ভোটের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টে একটি ইলেকশন পিটিশন (Election Petition) দায়ের করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) । অভিযোগ, নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে তাঁকে পরিকল্পনা করে হারানো হয়েছে । গণনার একেবারে শেষ কয়েকটি দফায় কারচুপি না করা হলে তিনি বিধানসভা নির্বাচনে হারতেন না । রিটার্নিং অফিসার বেশ কিছু অনৈতিক কাজ করেছেন এবং সেই কারণেই গরমিল হয়েছে বলে অভিযোগ মমতার । নন্দীগ্রাম থেকে শুভেন্দু অধিকারীর নির্বাচন বাতিল করার অনুরোধ করেছেন ।
ইলেকশন পিটিশন কী ?
যে মুহূর্তে ভোটের ফল ঘোষণা হয়ে গেল, তখন থেকে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা শেষ । অর্থাৎ. রিটার্নিং অফিসার একবার ফাইনাল রেজ়াল্ট শিট (ফর্ম 20) তে সই করে দেওয়া পর্যন্তই কমিশনের দায়িত্ব থাকে । তারপর কোনও প্রার্থী বা কোনও ভোটার যদি ভোটপ্রক্রিয়ায় কোনও অনিয়মের অভিযোগ তোলেন, সেক্ষেত্রে কমিশনের হাত-পা বাঁধা । কিছুই করার থাকে না । এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভোটার বা সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর কাছে একমাত্র অস্ত্র হল ইলেকশন পিটিশন ।
যে বিধানসভা কেন্দ্রটি ঘিরে অভিযোগ, সেটি যে রাজ্যের অন্তর্গত, সেই রাজ্যের হাইকোর্টে ইলেকশন পিটিশন দায়ের করা যায় । ভোটের ফলঘোষণার 45 দিনের মধ্যে ইলেকশন পিটিশন দায়ের করতে হবে । নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলে, আদালতে তা গ্রহণযোগ্য হবে না ।
জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, 1951 সাল অনুযায়ী হাইকোর্টগুলিকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, এই ধরনের মামলার বিচার 6 মাসের মধ্যে শেষ করার জন্য । কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছে, এই ধরনের মামলা আরও অনেক লম্বা চলেছে । কখনও কখনও তো বছরের পর বছর কেটে গিয়েছে ।
কোন কোন ক্ষেত্রে ইলেকশন পিটিশন দায়ের করা যায় ?
জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের 100 নম্বর ধারায় উল্লেখ করা রয়েছে, কখন ইলেকশন পিটিশন দায়ের করা যাবে ।
- যদি অভিযোগ থাকে, যেদিন নির্বাচন হয়েছে, সেদিন ওই কেন্দ্রের জয়ী প্রার্থী ভোটে লড়ার যোগ্যই নন, সেক্ষেত্রে ইলেকশন পিটিশন দায়ের করা যায় ।
- যদি জয়ী প্রার্থী অথবা তাঁর পোলিং এজেন্ট কিংবা তাঁর সম্মতিক্রমে অন্য কোনও ব্যক্তি কোনওপ্রকার অনৈতিক কাজ করে থাকেন সেক্ষেত্রেও মামলা করা যায় । এক্ষেত্রে কোন কোন কাজকে অনৈতিক বলে গণ্য করা হবে, তারও একটি তালিকা জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের 123 নম্বর ধারায় উল্লেখ করা রয়েছে । ঘুষ দেওয়া, কাউকে বলপূর্বক বাধা দেওয়া, ধর্ম-জাতি-গোষ্ঠী-ভাষার ভিত্তিতে কাউকে ভোট দেওয়ার জন্য বা ভোট না দেওয়ার জন্য আবেদন করা -- এমন আরও বেশ কিছু কাজকে অনৈতিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।
- জয়ী প্রার্থীর মনোনয়ন গ্রহণের সময় যদি কোনওরকম নিয়মভঙ্গের অভিযোগ ওঠে, বা অন্য কোনও প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করার সময় যদি নিয়মভঙ্গের অভিযোগ ওঠে; তাহলেও হাইকোর্টে ইলেকশন পিটিশন দায়ের করা যায় ।
- গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও গরমিলের অভিযোগ থাকলে, অর্থাৎ, কারও ভোট যদি ভুল করে গণনা করা হয় অথবা যদি ভুল করে বাতিল করে দেওয়া হয় -- সেক্ষেত্রেও মামলা করা যায় ।
- সংবিধান বা জনপ্রতিনিধিত্ব আইন কিংবা জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের অন্তর্গত কোনও বিধি বা নির্দেশনামা অমান্য করার অভিযোগ থাকলে হাইকোর্ট যাওয়া যায় ।
আরও পড়ুন : পিছিয়ে গেল নন্দীগ্রামে ভোট পুনর্গণনা সংক্রান্ত শুনানি
অভিযোগ যদি আদালতে সত্যি প্রমাণিত হয়, তাহলে...
অভিযোগ আদালতে সত্যি প্রমাণিত হলে, তারপর কী করা হবে তা নির্ভর করে অভিযোগকারী তাঁর দায়ের করা ইলেকশন পিটিশনে কীসের উল্লেখ করেছেন । জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের 84 নম্বর ধারায় অভিযোগকারী জয়ী প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়া বাতিল করার আবেদন করতে পারেন । পাশাপাশি, যদি প্রার্থী নিজেই আবেদন করেন, তাহলে নিজেকে অথবা সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী কোনও প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করার অনুরোধ করতে পারেন পিটিশনে । অর্থাৎ, গোটা বিষয়টাই নির্ভর করছে আবেদনকারী তাঁর পিটিশনে কী বলছেন তার উপর । এক্ষেত্রে অভিযোগ যদি আদালতে সত্যি প্রমাণিত হয় তাহলে, পিটিশনে কী উল্লেখ রয়েছে তার ভিত্তিতে নতুন করে নির্বাচনও হতে পারে বা হাইকোর্ট নতুন কোনও জয়ী প্রার্থীর ঘোষণা করতে পারে ।
ইতিহাস কী বলছে ?
ইলেকশন পিটিশন এর আগে বিভিন্ন সময়ে দায়ের করা হয়েছে । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে 1975 সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় । চার বছর লেগে গিয়েছিল হাইকোর্টের রায় দিতে । 1971 সালের ভোটে রায়বেরেলি থেকে ইন্দিরা গান্ধির জয়ী হলেও এলাহাবাদ হাইকোর্ট তা বাতিল করে দেয় । অনৈতিক কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ নারায়ণ । এক লাখেরও বেশি ভোটে হেরে গিয়েছিলেন রাজ নারায়ণ ।
পরে বিচার চলাকালীন দেখা গিয়েছিল, ইন্দিরা গান্দির সেই বছরের ভোটের আগে 1 ফেব্রুয়ারি ও 25 ফেব্রুয়ারির নির্বাচনী প্রচারের ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করেছিলেন নির্বাচনী এজেন্ট যশপাল কাপুর, রায়বেরেলির জেলাশাসক, পুলিশ সুপার এবং উত্তরপ্রদেশের স্বরাষ্ট্রসচিব । এটি জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের 123 (7) ধারা অনুযায়ী নীতিবিরুদ্ধ ।
আরও একটি ঘটনা রয়েছে । 2008 সালের রাজস্থান বিধানসভা নির্বাচন । মাত্র একটি ভোটের জন্য হেরে গিয়েছিলেন সি পি জোশি । তাঁর প্রতিপক্ষ বিজেপি প্রার্থী কল্যাণ সিং চৌহান পেয়েছিলেন 62 হাজার 216 টি ভোট । আর সি পি জোশি পেয়েছিলেন 62 হাজার 215 টি ভোট । অভিযোগ ছিল, ভোট গণনা ঠিকভাবে হয়নি । পরে রাজস্থান হাইকোর্টে ইলেকশন পিটিশন দায়ের হলে দেখা যায় কল্যাণ সিং চৌহানের স্ত্রী দু'বার ভোট দিয়েছিলেন । আরও বেশ কয়েকটি ভোট ভুল করে গণনা করা হয়েছিল । কল্যাণ সিং চৌহানের নির্বাচন বাতিল করে দিয়েছিল রাজস্থান হাইকোর্ট । তবে সি পি জোশিকে জয়ী ঘোষণা করা হয়নি । কারণ ইলেকশন পিটিশনে সেই উল্লেখ ছিল না ।