কলকাতা, 15 অগাস্ট : তৎকালীন ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে ৷ গ্রেপ্তারের আগেই আত্মঘাতী হয়েছিলেন এই ঘটনায় ক্ষুদিরামের সহযোগী প্রফুল্ল চাকি ৷ গ্রেপ্তার হন ক্ষুদিরাম ৷ মুজাফ্ফরপুর আদালত তাঁর ফাঁসির নির্দেশ দেয় ৷ নিম্ন আদালতের এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন ক্ষুদিরামের আইনজীবীরা ৷ কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি ৷ হাইকোর্টের বিচারপতি ক্ষুদিরামের ফাঁসির নির্দেশ বহাল রাখেন ৷
সালটা ছিল 1908 ৷ ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি তৎকালীন ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে মারতে গিয়ে একই রকম ঘোড়ায় টানা অন্য একটি গাড়িতে বোমা ছোড়েন । ফলস্বরূপ দু'জন ব্রিটিশ মহিলা প্রাণ হারান । শোনা যায়, প্রফুল্ল চাকিকে গ্রেপ্তার করার আগেই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন । কিন্তু ক্ষুদিরাম বসু ধরা পড়েন । ক্ষুদিরামের বয়স তখন মাত্র 18 বছর 7 মাস 11 দিন । বিচারে মুজাফ্ফরপুর আদালত তাঁর ফাঁসির নির্দেশ দেয় ।
21 মে 1908 সালে বিচারপতি কর্ন ডফ, নাথুনি প্রসাদ ও জনক প্রসাদের এজলাসে ক্ষুদিরাম বসুর বিচার শুরু হয় । সেই মামলায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের হয়ে ময়দানে নেমেছিলেন মান্নুম ও বিনোদবিহারী মজুমদার নামে দুই আইনজীবী । অন্যদিকে আইনজীবী কালীদাস বসু ,উপেন্দ্রনাথ সেন এবং কেশরীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লড়েছিলেন ক্ষুদিরাম বসুর হয়ে । পরে তাঁদের সঙ্গ দেন কুলোকমল সেন, নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী এবং সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী নামে তিন আইনজীবী । ক্ষুদিরামের জবানবন্দী নেওয়া হয় । 13 জুন ছিল রায়দানের দিন । সেই দিন বিচারপতি ও ব্রিটিশ সরকারের হয়ে সওয়ালকারি আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি আসে । চিঠিতে বলা হয়, ওই ইংরেজ সাহেবকে হত্যা করার জন্য আরও একটি বোমা পাঠানো হচ্ছিল ৷ তবে বাঙালি নয় কাজটি করবেন একজন বিহারী । এই চিঠি ক্ষুদিরাম বসুর তরফের আইনজীবীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল । তাঁদের বক্তব্য ছিল, এই চিঠির মাধ্যমেই বোঝা যায় গাড়িতে বোমা মারার ঘটনায় অন্য কোনও বড় মাথা জড়িত ৷ তারা কিশোর ক্ষুদিরামকে কাজে লাগিয়েছিল । সুতরাং তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না । কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি আইনজীবীদের এই বক্তব্য । বিচারপতি ক্ষুদিরামকে মৃত্যুদণ্ড দেন ৷ এরপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি সাত দিনের মধ্যেই মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ।
1908 সালের 8 জুলাই হাইকোর্টের বিচারপতি বেল ও রাভেজের ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলার শুনানি শুরু হয় । হাইকোর্টে ক্ষুদিরাম বসুর হয়ে সওয়াল করেছিলেন আইনজীবী নরেন্দ্রকুমার বসু । ক্ষুদিরামের জন্য তিনি আপ্রাণ লড়াই চালিয়েছিলেন । হাইকোর্টে তিনি বলেন, নিম্ন আদালতের নির্দেশ আইন সংগত নয় ৷ ক্ষুদিরামকে দোষী সাব্যস্ত করার আগে বিচারপতি ভালো করে সাক্ষ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখেননি । আইন অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অভিযুক্তের জবানবন্দী গ্রহণ করার কথা । কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষুদিরামকে তাঁর পরিচয় জানাননি । যে সমস্ত প্রশ্ন ক্ষুদিরামকে করা হয়েছিল তার উত্তর আলাদা আলাদা করে নথিভুক্ত করা হয়নি কেন? সম্পূর্ণ জবানবন্দী নেওয়া হয়েছিল বাংলায়, কিন্তু তা লেখা হয়েছিল ইংরাজিতে ৷ ক্ষুদিরাম বসুর বক্তব্য একটি কাগজে নথিভুক্ত করা হয়েছিল ৷ তবে বয়ান নেওয়ার পরের দিন সেই কাগজে তাঁকে দিয়ে স্বাক্ষর করানো হয় ৷ এই বিষয়ও প্রশ্ন করেন ক্ষুদিরামের আইনজীবী ৷ এই সমস্ত কারণে নিম্ন আদালতের রায় খারিজ করা উচিত ৷ রায়ের পুনর্বিবেচনারও দাবি জানানো হয় ৷ তবে হাইকোর্টের বিচারপতি বলেন, নিম্ন আদালত সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখেই এই রায় দিয়েছে ৷ ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষুদিরামকে নিজের পরিচয় জানাতে ভুলে গেছিলেন ৷ ম্যাজিস্ট্রেট প্রশ্ন করার পর ক্ষুদিরাম বসু যে উত্তর দিয়েছিলেন তা আলাদা আলাদা করে না লিখে একেবারে ইংরেজিতে লিখেছিলেন । তারপর তিনি তা বাংলা করে ক্ষুদিরামকে শুনিয়েছিলেন ৷ পরে সেই কাগজটি ক্ষুদিরামকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয় ।
আদালতে নরেন্দ্রকুমার বলেন , প্রফুল্ল চাকি অনেক বেশি শক্তিশালী এবং বোমা বাঁধার ব্যাপারে পাকা ছিলেন । তাই বলা যেতে পারে বোমা ছুড়েছিলেন প্রফুল্ল ওরফে দীনেশ । এই ঘটনার পরই আত্মঘাতী হন তিনি । অনুমান করা যায় দীনেশই বোমা ছুড়েছিলেন । নরেন্দ্রবাবু বলেন, ক্ষুদিরামকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল । কারণ সাক্ষ্য গ্রহণের সময় পুলিশ সেখানে উপস্থিত ছিল । কিন্তু বিচারপতির বক্তব্য ছিল, ক্ষুদিরাম নিজে তা কখনও বলেননি । গ্রেপ্তারের সময় ক্ষুদিরামের কাছ থেকে দুটি পিস্তল ,কার্তুজ এবং দুটো কোট পাওয়া গেছিল । পিস্তল দুটির মধ্যে একটি ছিল লোডিং, অন্যটি ফাঁকা । কার্তুজ খুব জোরালো ছিল না । এই আগ্নেয়াস্ত্রগুলি দীনেশ ব্যবহার করেছিলেন কি না তার কোনও প্রমাণ নেই । ক্ষুদিরাম যে সিল্কের কোট পড়েছিলেন সেটি দীনেশের ছিল । কিন্তু বিচারপতি বলেন, যদি ধরে নেওয়া হয় যে ক্ষুদিরাম বোমা ছোড়েননি, ব্যবহারের পর আগ্নেয়াস্ত্রগুলি তাঁর কাছে দেওয়া হয়েছিল তাহলেও তিনি সমান দোষী বলে বিবেচিত হবেন । এরপর নরেন্দ্র বলেন, ক্ষুদিরামের বয়স এখনও 19 হয়নি । ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তাঁর জবানবন্দী থেকে অনুমান করা যায় যে তাঁর বিবেচনাবোধ একেবারেই অপরিপক্ক । বলা যায় তিনি অন্যের হাতের পুতুল হয়েছেন । কিন্তু বিচারপতি বলেন, ক্ষুদিরাম একেবারেই কাঁচা ছেলে ছিলেন না । একটা সুযোগের অপেক্ষায় তিনি ও তাঁর সহযোগী ঘটনার 20 দিন আগে থেকে মুজাফফরপুরে ছিলেন ৷ তাই তাঁকে বাচ্চা ছেলে বলা যায় না ৷
এবার নরেন্দ্রবাবু বলেন, ক্ষুদিরামের জবানবন্দী থেকে বোঝা যায় তিনি এই অপরাধ করে বোকামি করেছেন । অন্যের কথা শুনে তিনি অত্যন্ত সাহসী হয়ে পড়েছিলেন । অন্যের চালাকি ধরতে পারেননি । তিনি শুধুমাত্র সহযোগী ছিলেন । কিন্তু বিচারপতি বলেন, এটা বিবেচ্য নয় । এর জন্য তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া যায় না । তিনি নিজে স্বীকার করেছেন তিনি ও প্রফুল্ল চাকি দু'জন মিলে ওই কাণ্ড ঘটিয়েছেন । সম্পূর্ণ ঘটনাটাই অত্যন্ত পরিকল্পনা করে করা হয়েছে । কীভাবে নিজেদের গা বাঁচিয়ে পালানো যায় তার সুষ্ঠু পরিকল্পনাও করেছিলেন তাঁরা । সেই কারণে আমরা এই আবেদন খারিজ করছি ।
মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখার বিচারপতিরা জিজ্ঞাসা করেন, ক্ষুদিরাম তুমি কিছু বলতে চাও ? ক্ষুদিরাম বলেছিলেন, আমাকে যদি সুযোগ দেওয়া হত, তাহলে আপনাকে বোমা বাঁধা শিখিয়ে দিতাম ।