কলকাতা, 4 মে: এই গল্প কোনও ফিল্মের থেকে কম নয় । একদিকে হ্যাম রেডিয়ো, অন্যদিকে রাজ্য পুলিশের সাফল্যের অনন্য গাথা । আমরা পুলিশের সামাজিক কাজকর্ম তথা ভালো কাজের কথা লিখি অনেক সময় । হ্যাম রেডিয়োর সঙ্গে মিলে কাশ্মীরে নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলা বাংলার মেয়েকে মায়ের সঙ্গে মিলিয়ে দিল তারা । আর এখানে হ্যাম রেডিয়োর কথাও না বললেই নয় । এক রকম অসম্ভবকেই সম্ভব করল তারা ।
ভূস্বর্গ কাশ্মীর ছবির মতো সুন্দর । যাঁরা একবার সেখানে গিয়েছেন, প্রকৃতির টানে তাঁরা বারবার ছুটে যেতে চান সেখানে । ঠিক তেমনই সৌন্দর্যের টানে একবার কাকার সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিল রুবিনা বানু । সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এক পরিবারের মেয়ে । বয়স তখন কত হবে ! বারো কী তেরো । কাকা শেখ আজমিলি সেখানে একটি ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ ঠিক করে সেখানে ভাইঝিকে বিয়ে দিয়ে চলে আসেন । ফিরে এসে রুবিনার মাকে বলেন, রুবিনা সেখানে ভালো আছে, ভালো থাকবে । রুবিনার মা হারানি শেখ ও তিন ভাই বারবার জিজ্ঞেস করে কাকাকে, কোথায় তাঁদের মেয়ে ? কাকা বলেন, আছে কাশ্মীরে । কাশ্মীরের কোথায় জানার চেষ্টা করলেও কিছুই বলেননি কাকা । আর এই কারণেই একটা সময়ে কাকার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হয়ে যায় তাঁদের ।
তারপরে কিছুদিনের মধ্যেই কাকা শেখ আজমিলির প্রয়াণ ঘটে । ফলে বাড়ির মেয়ের ফিরে পাওয়ার আশা এক রকম ছেড়েই দিয়েছিল তাঁর পরিবার ।এ দিকে, সুন্দরবনের মেয়ে কাশ্মীরে এখন রুবিনা বেগম, তিন সন্তানের মা । তাঁর ভালো লাগছে না ভূস্বর্গের ওই সৌন্দর্য । তাঁর মন পড়ে রয়েছে ছেলেবেলায় সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে থাকা তাঁর বাড়িঘর পরিজনদের দিকে। তাঁর চোখে বারবার ভেসে ওঠে সুন্দরবনের সেই ছোটবেলার কথা, নদীতে মাছ ধরা, গাছে চড়া, আইসক্রিম খাওয়ার কথা ।
রুবিনার দেওর পর্যটনের ব্যবসা করেন কাশ্মীরের বারামুল্লায় । সেখানে যে সব বাঙালি পর্যটক যান, অনেককেই বারংবার অনুরোধ করেছেন, সুন্দরবনের রুবিনার বাবা-মা ভাইয়ের খোঁজ পাওয়ার জন্য । যাঁরা তাঁদের আশ্বস্ত করেছিলেন, তাঁদের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ছাড়ও দিয়েছিলেন রুবিনার দেওর । এছাড়াও রুবিনার বাবা-মায়ের খোঁজ পেতে লক্ষাধিক টাকার উপরে খরচও করেন তিনি । অবশেষে জাতীয় মহিলা কমিশনের নজরে আসে বিষয়টি । তারা চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে বলে যে, রুবিনা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবেন, যদি না তাঁর মা-বাবাকে পাওয়া যায় ।
এই অবস্থায় কাশ্মীরে থাকা রুবিনা তাঁর বাবা-মাকে খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে যায় । মহিলা কমিশনের সাহায্য নিয়েই চিঠি এসে পৌঁছয় সুন্দরবন পুলিশের কাছে l এরপর সেই চিঠি সুন্দরবন পুলিশের থেকে যায় দক্ষিণ 24 পরগনার বিভিন্ন থানায় । বারুইপুর উত্তর থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক কাকলি ঘোষ রায়, চিঠিটি নিয়ে আসেন হ্যাম রেডিয়োর কাছে । এ ক্ষেত্রে পুলিশের তরফ থেকে অনুরোধ করা হয়, যাতে মেয়েটির পরিবারকে খুঁজে দিতে সাহায্য করে হ্যাম রেডিয়ো । এরপর লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন হ্যাম রেডিয়োর সদস্যরা ।
কিন্তু সমস্যা হল দীর্ঘদিন মেয়েটি কাশ্মীরে থাকায় তিনি বাংলা ভুলেই গিয়েছিলেন ৷ একমাত্র উর্দু ভাষায় কথা বলতে পারেন তিনি । মেয়েটির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে বোঝার চেষ্টা হয় মেয়েটির বর্তমানের পরিস্থিতির বিষয়টি । মেয়েটির বয়স এখন প্রায় 27 বছর । রক্ষণশীল মুসলিম পরিবার । তাঁরা বাংলা হিন্দি কিছুই বোঝেন না । কেবলই উর্দু বলছেন । উর্দু ভাষার তর্জমার জন্য আলি ভাই নামে কাশ্মীরের এক ব্যক্তির সাহায্য নেওয়া হয় ৷ তাঁর মধ্যস্থতায় চলে বাক্যালাপ ।
রুবিনার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমাদের পরিচয় জানতে চেয়ে ও প্রান্ত থেকে ফোনে বলে দেন, অচেনা-অজানা ফোন নম্বরে বারামুল্লাহ সেক্টরে মহিলাদের কথা বলা নিষেধ । তারপর তাঁর বাড়িতে হাজির করানো হয় একজন স্বেচ্ছাসেবককে । রুবিনাকেও তাঁদের বাড়ির লোকেদের দেখানো হয় ৷ তখন তাঁর দেওর এগিয়ে এসে বলেন, "আমিই কথা বলব হ্যাম রেডিয়োর লোকেদের সঙ্গে । অনেক কিছু জিজ্ঞাসা ছিল আমাদের ।"
জিজ্ঞাসার ভিত্তিতে সচরাচর হ্যাম রেডিয়োর সদস্যরা বের করে আনেন হারিয়ে যাওয়া মানুষের ঠিকানা । একসময় রুবিনার দেওর বলে উঠলেন, "স্যার ছোড় দিজিয়ে । হাম পরেশান হো জা রাহাহে ।" না, এ ক্ষেত্রে থেমে যায়নি হ্যাম রেডিয়ো । কথা বলতে বলতে একটা স্কুলের নাম বের হয় রুবিনার মুখ দিয়ে । আইসক্রিম খেত সে একটি কাকুর কাছে । পাশেই একটি স্কুল । সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ । ফটো পাঠানো হল রুবিনার । রুবিনার মাসিও নাকি একই স্কুলে পড়েছে । আর সেখান থেকেই শুরু হয় রুবিনার পরিবারের খোঁজ । অবশেষে খোঁজও মেলে সেই সূত্র ধরেই ।
এতদিন বাদে হারানো মেয়েকে ফিরে পেয়ে ভিডিয়ো কলে কান্নায় ভেঙে পড়েন রুবিনার মা । আর রুবিনারও কাশ্মীরে একই অবস্থা । রুবিনা মায়ের কাছে বলেন, "মা আমার তিনটে ছোট বাচ্চা, তুমি চলে আসো কাশ্মীরে ।" রুবিনার মা অভাব ভুলে বলেই দিলেন, "হ্যাঁ কালই যাচ্ছি তোর বাড়ি ।" টিকিট কাটার টাকা নেই তো হাতে । রুবিনার ভাইরা এগিয়ে আসে । এক ভাইয়ের সঙ্গে আজ রুবিনার মা রওনা দিচ্ছেন কাশ্মীরে, 15 বছর পর তাঁর মেয়েকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরতে, আদর করতে l
অবশেষে দীর্ঘদিন পরস্পরকে না দেখতে পাওয়া মা মেয়েকে মেলাতে পেরে খুশি হ্যাম রেডিয়ো তথা কলকাতা রেডিয়ো ক্লাবের সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস । তিনি বলছেন, "এ যেন সিনেমার চিত্রনাট্য । শেষ পর্যন্ত মা-মেয়েকে মিলিয়ে দিতে পেরে কিছুটা স্বস্তি বোধ করছি ।"
আরও পড়ুন: গঙ্গাসাগর মেলায় হারিয়ে যাওয়া পুণ্যার্থীদের বাড়ি ফেরাচ্ছে হ্যাম রেডিয়ো