কলকাতা, 24 এপ্রিল : রাজ্য সরকার কোরোনা নিয়ে সঠিক তথ্য দিচ্ছে না বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে । এরপর একইদিনে দু'ধরনের তথ্য দেওয়ায় বিভ্রান্তি তৈরি হয় । যার জেরে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কোরোনা নিয়ে প্রকৃত তথ্য লোকানোর অভিযোগ আরও জোরদার হতে থাকে । কোরোনা নির্ণয়ের কিট নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক । এর মাঝেই মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল একে অপরকে চিঠি দিয়েছেন, রাজ্যে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দলের আসা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংঘাত । এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের চিকিৎসকরা বলছেন, কোরোনা রাজনীতির বিষয় নয় ।
চিকিৎসকদের একাধিক সংগঠনের তরফে জানানো হচ্ছিল, এ রাজ্যে কোরোনার প্রকৃত তথ্য জানা যাচ্ছে না । প্রকৃত তথ্য জানার জন্য অনেক বেশি সংখ্যক নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজন । প্রকৃত তথ্য জানা সম্ভব না হলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে । এর পাশাপাশি চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য যথাযথ সুরক্ষার প্রয়োজনের কথাও বলা হচ্ছিল । চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা কোরোনা আক্রান্ত হয়ে পড়লে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে । এই ধরনের বক্তব্য থেকে এখনও সরে আসেনি চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন । কোরোনা পরিস্থিতির বিষয়ে 2 এপ্রিল নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে এক্সপার্ট কমিটি প্রথমে জানিয়েছিল, রাজ্যে কোরোনা আক্রান্তের সংখ্যা 53 । সাত জনের মৃত্যু হয়েছে । ওই দিন ঘণ্টা দুই পরই নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা জানান, রাজ্যে কোরোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে । কোরোনা পজ়িটিভ থাকলেও অন্য কারণে চারজনের মৃত্যু হয়েছে । ওই দিন তখনও পর্যন্ত রাজ্যে কোরোনা আক্রান্তের সংখ্যা 34 । খোদ সরকারের তরফে একই দিনে কিছুক্ষণের ব্যবধানে দু'ধরনের তথ্য দেওয়ায় তৈরি হয় বিভ্রান্তি । অনেকে জানতে চান, কোন তথ্য সঠিক ? রাজ্যের কোরোনা পরিস্থিতি নিয়ে তৈরি হয় ধোঁয়াশা ।
তবে শুধুমাত্র একই দিনে সরকারের তরফে দুই ধরনের তথ্য নয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রক এবং স্বাস্থ্য দপ্তরের তথ্যের ভিত্তিতেও বিভ্রান্তি জারি রয়েছে । স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, এই রাজ্যে কোরোনা আক্রান্তের সংখ্যা যত বলা হচ্ছে, সেই তুলনায় অনেক কম সংখ্যক কোরোনা আক্রান্তের কথা বলা হচ্ছে স্বাস্থ্য দপ্তরের তথ্যে । এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠছে, কোন তথ্য সঠিক? এ দিকে গত কয়েকদিন রাজ্য সরকার কোরোনার যে তথ্য সংবাদমাধ্যমে পেশ করছে, তাতে গত কয়েকদিনে এ রাজ্যে আগের তুলনায় কোরোনা আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে । এই বিষয়ে মুখ্যসচিব নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে যে বক্তব্য পেশ করেছেন, তা অনুযায়ী কোরোনা নির্ণয়ে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে বলে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে ।
কোরোনায় এ রাজ্যে মৃতের সংখ্যা? এই বিষয়েও প্রশ্ন জিইয়ে রেখে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা । কোরোনায় কারও মৃত্যু হয়েছে কি না তা স্থির করতে রাজ্য সরকার তৈরি করেছে অডিট কমিটি । এই ধরনের কমিটি কেন কোনও কোরোনা আক্রান্তের মৃত্যু কারণ স্থির করে দেবে, তা নিয়ে চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন যেমন প্রশ্ন তুলছে, সম্প্রতি তেমনই প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় । আজ কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দলের তরফে যে চিঠি রাজ্যের মুখ্যসচিবকে দেওয়া হয়েছে, তাতেও অডিট কমিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে । সোশাল মিডিয়ায় এককভাবেও কোনও চিকিৎসক এই অডিট কমিটির বিষয়ে প্রশ্ন তুলে এমনও জানিয়েছেন, এই বিষয়টি চিকিৎসকদের কাছে অপমানজনক । প্রকাশ্যে না বলতে চাইলেও চিকিৎসকদের একাংশদের ধারণা, কেউ হয়তো অন্য রোগে আক্রান্ত । সেক্ষেত্রে তাঁর চিকিৎসা চলছে । ওষুধের মাধ্যমে আরও কয়েকদিন তিনি বেঁচে থাকতে পারতেন । কিন্তু, কোরোনা আক্রান্ত হয়েছেন বলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে । কোরোনায় আক্রান্ত না হলে তিনি আরও কয়েকটা দিন বেঁচে থাকতে পারতেন । তা হলে, এ ক্ষেত্রে কেন কোরোনায় মৃত্যু হয়েছে বলা যাবে না?
এ রাজ্যে কোরোনায় আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা রাজ্য সরকারের পেশ করা তথ্যের থেকে অনেক গুণ বেশি বলে মনে করছেন সরকারি-বেসরকারি বহু চিকিৎসক । এদিকে এ রাজ্যে কতজন কোরোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, কত জন আক্রান্তের মৃত্যু হচ্ছে, এ সব বিষয়ে প্রকৃত তথ্য সরকারি তরফে চাপা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ জারি রয়েছে । অভিযোগ উঠছে, প্রকৃত তথ্য চাপা দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গোপনীয়তা আরও বাড়ানো হচ্ছে । এ রাজ্যের সরকারি চিকিৎসকদের একটি সংগঠন সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসক সজল বিশ্বাস বলেন, "এ রাজ্যে কোরোনার প্রকৃত তথ্যের বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে । প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা না হলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে ।"
21 এপ্রিল ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য শাখা সহ সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকদের সাতটি সংগঠনের তরফে যৌথভাবে রাজ্য সরকারের কাছে 11 দফা দাবি পেশ করার কথা জানানো হয়েছে । এই দাবিগুলির মধ্যে কোরোনার স্বচ্ছ পরিসংখ্যানের বিষয়টিও রয়েছে । চিকিৎসকদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের সম্পাদক চিকিৎসক কৌশিক চাকি বলেন, "কোনও ধোঁয়াশা থাকা বাঞ্ছনীয় নয় । রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্র নিজেদের মধ্যে সঠিকভাবে কো-অর্ডিনেট করুক ।" তবে, তিনি বলেন, "সংখ্যা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই । সাধারণ মানুষের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মী এবং তাঁদের পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রাণ নিয়ে আমরা চিন্তিত । সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে মারামারি করা মানে আমরা মূল সমস্যা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি । অন্য রাজ্যে তো এ রকম কিছু হচ্ছে না । কোরোনা রাজনীতির বিষয় নয় ।"
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কুণাল সরকার বলেন, "দুর্ভাগ্যবশত পরিসংখ্যান নিয়ে কিছু মতভেদ আমরা দেখতে পাচ্ছি ।" তিনি আরও বলেন, "অল্প সময়ের মধ্যে এ রকম অচেনা-অজানা এই কোরোনার বিষয়ে আমরা যতটা সঠিক এবং পাকাপোক্ত তথ্য পাব, আমাদেরই তত লাভ । হয়তো আমরা 25 জন করে সংক্রমণের হার দেখছি । একদিন যদি এই সংখ্যা বেড়ে 35 কিংবা 40 হয়, কিংবা 50 হয়, তাহলে এটা সরকারের কোনও ব্যর্থতা নয় । আমার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে, কোনও সরকার যদি আরও উদ্যোগী হয়ে আরও বেশি সংক্রমণ খুঁজে বার করতে পারে, তা হলে এটা সরকারের লাভ । কোরোনায় 12 জনের মৃত্যু হয়েছে না 22 জনের মৃত্যু হয়েছে, এটা কোনও বিতর্কের বিষয় হতে পারে না । বরং যে সরকার যত বেশি কেস খুঁজে বের করতে পারবে, আমি তো সেই সরকারকে আরও সজাগ বলে মনে করব।"