কলকাতা, 7 মে : যে কোনও মহামারির ক্ষেত্রেই এপিডেমিক কার্ভ থাকে । প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যার বিচারে তৈরি হয় এই কার্ভ । এপিডেমিক কার্ভের প্রথম দিকে আক্রান্তের সংখ্যা খুব কম থাকে । পরে আস্তে আস্তে বাড়তে বাড়তে এক সময়ে তা সর্বাধিক হয় । একেই এপিডেমিক কার্ভের চূড়া বা শিখর বলা হয়। শিখরে পৌঁছানোর পরই ধীরে ধীরে আক্রান্তের সংখ্যা কমার প্রক্রিয়া শুরু হয় । ভারতবর্ষে কোরোনা এখনও সেই শিখরে পৌঁছায়নি । জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে শিখরে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে । অর্থাৎ, সেই সময় পর্যন্ত প্রতিদিনই বাড়তে থাকবে COVID-19-এ আক্রান্তের সংখ্যা । কোরোনা ভবিষ্যৎ নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গাণিতিক গবেষণায় উঠে এল এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য ।
COVID-19 মোকাবিলা করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে গাণিতিক গবেষণার ডাক দিয়েছিল কেন্দ্রের ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (DST) অধীনস্ত সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ বোর্ড (SERB)। সেই ডাকে সারা দিয়ে গবেষণার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ও গণিত বিভাগের অধীনে থাকা সেন্টার ফর ম্যাথেমেটিক্যাল বায়োলজি অ্যান্ড ইকোনমির কো-অর্ডিনেটর নন্দদুলাল বৈরাগী । সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেছে SERB । গত এক সপ্তাহ ধরে নন্দদুলাল বৈরাগীর নেতৃত্বে চলছে কোরোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে গাণিতিক গবেষণা । নন্দদুলাল বৈরাগী জানাচ্ছেন, দুটি গাণিতিক মডেল ব্যবহার করা হচ্ছে গবেষণার জন্য । এগুলি হল, SEIR (suspectable-expose_infected_recovered) মডেল ও Stochastic মডেল ।
কোরোনায় আক্রান্ত গোটা বিশ্ব তথা ভারত । নেই কোনও ওষুধ বা ভ্যাকসিন । তাই বিকল্প হিসেবে নন-ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্টারভেনশনের মাধ্যমে COVID-19 প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে । নন-ফার্মাসিউটিক্যাল এই ইন্টারভেনশনের মধ্যে লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বজায়, ব্যক্তিগত হাইজিন রয়েছে । লকডাউনের মাধ্যমে সংক্রমণের চেন ভাঙা, সামাজিক দূরত্বের মাধ্যমে দুটো মানুষের মধ্যে একজন আক্রান্ত হলেও যাতে অপর জন আক্রান্ত না হয় সেটা করার চেষ্টা করা হচ্ছে । 25 মার্চ থেকে দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হয় । ইতিমধ্যেই লকডাউনের 4 সপ্তাহ পার হয়ে গেছে । কিন্তু, এখনও প্রতিদিন বেড়ে চলেছে সংক্রমণের হার । নন্দদুলাল বৈরাগী জানাচ্ছেন, যে কোনও মহামারির ক্ষেত্রে এপিডেমিক কার্ভের শুরুতে সংখ্যা খুব কম থাকে । আস্তে আস্তে তা বাড়তে থাকে । যেমন, ভারতে এখন বাড়ছে । বাড়তে বাড়তে একসময় সংখ্যাটা সর্বাধিক হয় । সেই সর্বাধিকটাকে বলা হয় চূড়া বা শিখর । চূড়ায় উঠলে তবেই নামার প্রক্রিয়া শুরু হয় । যাদবপুরে গাণিতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে অফিশিয়ালি লকডাউন শুরু হওয়ার তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে তার প্রভাব দেখা গেছে । সেখানকার এপিডেমিক কার্ভ চূড়ায় পৌঁছেছে । অর্থাৎ, আক্রান্তের সংখ্যা সর্বাধিক হয়েছে এবং তারপর থেকে তা কমতে শুরু করেছে । কিন্তু, অন্যান্য দেশ এই চূড়ায় লকডাউন শুরুর তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে পৌঁছালেও, লকডাউনের চার সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরও ভারত এখনও এপিডেমিক কার্ভের চূড়ায় পৌঁছায়নি । তার জন্য এখনও অপেক্ষা করতে হবে । আর যতক্ষণ না ভারত এপিডেমিক কার্ভের চূড়ায় পৌঁছাতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কমে যাওয়ার কোনও রাস্তা নেই বলেই জানাচ্ছেন নন্দদুলালবাবু ।
তাহলে কবে এপিডেমিক কার্ভের শীর্ষে পৌঁছাবে দেশ ? নন্দদুলাল বৈরাগী বলেন, " প্রাথমিক বিশ্লেষণ ও হিসাবের পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা চূড়ায় পৌঁছাতে পারি । তবে, তা নির্ভর করবে লকডাউন, সামাজিক দূরত্বের মতো কোরোনা প্রতিরোধের নিয়মগুলো কতটা মানা হবে তার উপর ।" অন্যদিকে, প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, অন্যান্য দেশে তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে চূড়ায় পৌঁছেছে এবং তারপরে আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে । আমাদের দেশে সেটা কেন হচ্ছে না ? সেই প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে গাণিতিক গবেষণার মাধ্যমে । এ প্রসঙ্গে নন্দদুলাল বৈরাগী বলেন, " আমাদের দেশে কেন হচ্ছে না, সেটা আমরা খোঁজার চেষ্টা করছি। প্রাথমিকভাবে এর পিছনে দুটো কারণ রয়েছে বলে আমাদের মনে হয়েছে । প্রথমত, আমাদের দেশে উপসর্গহীন COVID-19 পজ়িটিভ সংখ্যা ইউরোপীয়ান দেশগুলোর থেকে বেশি আছে । অর্থাৎ, একজনের শরীরে ভাইরাস রয়েছে, কিন্তু তাঁর উপসর্গ আসেনি । এই উপসর্গহীন আক্রান্তের সংখ্যা আমাদের দেশে অনেক বেশি । এইজন্যে এটা এখন ছড়াচ্ছেও বেশি । কারণ, তাঁদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয়ান দেশগুলির থেকে ভারতের আয়তন অনেক বড় । ফলে, ওইসব দেশগুলিতে চূড়ায় পৌঁছে নামতে শুরু করলেও, আমাদের আয়তনের কারণে আমাদের সময়টা হয়তো বেশি লাগছে ।" উপসর্গহীন আক্রান্তের কারণে ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না সংক্রমণের চেন । তাহলে উপায় কী? নন্দদুলাল বৈরাগী বলেন, " উপায় হচ্ছে, ব়়্যান্ডম ব্লাড টেস্ট করতে হবে । অন্তত যে জায়গাগুলোকে রেড জো়ন বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে সেখানে ব়়্যান্ডম টেস্টিংয়ের সংখ্যা ভীষণভাবে বাড়ানো উচিত । বেশি টেস্টিংয়ের মাধ্যমেই সংক্রমণের চেন ভাঙা সম্ভব হবে ।" এখন কবে নাগাদ এপিডেমিক কার্ভের চূড়ায় দেশ পৌঁছাবে তা গাণিতিক মডেল বিশ্লেষণের মাধ্যমে বের করার চেষ্টা করছে যাদবপুর । কারণ, এই চূড়ায় পৌঁছানোর তথ্য বিশ্লেষণের পরই কোরোনা ভবিষ্যত নিয়ে বলা সম্ভব হবে । নন্দদুলাল বৈরাগী এ বিষয়ে বলেন, "এই চূড়ায় উঠতে কত সময় লাগবে সেটা আমরা গাণিতিক মডেল বিশ্লেষণ করে বের করার চেষ্টা করছি । একসময় তো চূড়াতে উঠবেই । তারপরে আক্রান্তের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে কমতে জ়িরোর কাছাকাছি আসবে । প্রশ্ন হচ্ছে, কতদিনে আমরা চূড়ায় পৌঁছাব এবং কতদিনে আমরা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসব । এই এপিডেমিকটা কতদিন চলবে । আর যখন আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় পৌঁছাব তখন পুরো আক্রান্তের সংখ্যা অর্থাৎ, কতজন COVID-19 পজ়িটিভ হয়েছেন তাঁদের সংখ্যাটা কী, যাঁরা সুস্থ হয়েছেন তাঁদের সংখ্যাটা কী, আর যাদের আমরা বাঁচাতে পারলাম না তাঁদের সংখ্যাটা কী। এগুলো আমরা গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে প্রেডিক্ট করার চেষ্টা করছি।"
এক বছর মেয়াদি এই গবেষণা এখন প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে । বর্তমানে এই মহামারির সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য গাণিতিক গবেষণার মাধ্যমে কার্ভের শিখরে পৌঁছতে কতদিন সময় লাগবে এবং আক্রান্তের সংখ্যা কত হবে তা নির্ধারণ করার কাজ চলছে । তিনি বলেন, "এখনও কতদিন সময় লাগবে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে সেই দিকে আমরা এগোতে পারিনি । যতক্ষণ না কার্ভের শিখরে পৌঁছাচ্ছে ততক্ষণ জানতে পারছি না যে এই কার্ভ কতদিনে নামবে । উঠতে যা সময় লাগে, তার থেকে নামতে আরও বেশি সময় লাগে । আমরা ইউরোপীয়ান দেশগুলোর দিকেও নজর রাখছি । ইতালির ক্ষেত্রে যা প্রিডিকশন করেছিলাম । সেটা আমরা দেখছি মিলে যাচ্ছে । সেই কারণে আমরা ভারতের জন্যও একই রকম প্রিডিকশন দিতে চাইছি । গণিতের বিচারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটা তথ্য আমরা সরকারকে দিতে চাই । এই গবেষণা এখন প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে । সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলেই আমরা সেই রিপোর্ট SERB-কে পাঠাব । ভবিষ্যতে এই ধরনের সমস্যা দেখা দিলে প্রথম থেকেই কী কী পদক্ষেপ করতে হবে তাও রিপোর্টে থাকবে ।"