কলকাতা, 6 মে : সঠিক ওষুধ পাওয়া যায়নি। যথাযথ চিকিৎসাও হয়নি। যার জেরে ৫ বছর থমকে ছিল মিক্সড সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত রাহুল মুখোপাধ্যায়ের জীবন। অবশেষে SSKM এর চিকিৎসকদের অক্লান্ত চেষ্টায় ২১ বছরের রাহুল জীবনের ছন্দে ফিরছে । পা দিয়ে আবার তিনি লিখতে পারছেন, মোবাইল ফোন অপারেট করতে পারছেন, অন্য বিভিন্ন কাজও করতে পারছেন। এখন ভিক্টোরিয়া দেখতে যেতে চাইছেন তিনি। এর জন্য চিকিৎসকদের কাছে আবদারও করছেন । রাহুলের ছন্দে ফেরা বিরল বলে জানিয়েছেন SSKM-র চিকিৎসকরা।
পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের বাসিন্দা রাহুল। জন্মগতভাবে তিনি মিক্সড সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত। বিরল এই রোগে আক্রান্ত রাাহুলকে ছোটোবেলায় লেখাপড়া শিখিয়েছেন তাঁর মা রিনা মুখোপাধ্যায়। শৈশব থেকেই হাতে নয়, পা দিয়ে লিখতে শিখেছেন রাহুল। লেখা ছাড়াও পা দিয়ে তিনি আরও বিভিন্ন কাজ করতে পারেন। যেমন ক্যারাম, লুডো থেকে শুরু করে মোবাইল গেম সবই পা দিয়ে অবলীলায় খেলেন তিনি।
২০১৪ থেকে সমস্যা শুরু হয়। পা দিয়ে কিছু করতে পারছিলেন না তিনি। চিকিৎসার জন্য রাহুলকে নিয়ে ভেলোর, নিমহ্যানসেও নিয়ে যান তাঁর মা-বাবা। ছেলে যাতে আবার আগের জীবনে ফিরতে পারে, যতটা সম্ভব ততটা নিজের কাজ করে নিতে পারে, সেই কারণেই রাহুলকে রাজ্যের বাইরে চিকিৎসার জন্য তাঁরা নিয়ে গেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই আগের মতো অবস্থায় আর ফেরানো যাচ্ছিল না রাহুলকে। শেষ পর্যন্ত মাস দেড়েক আগে রাহুলকে নিয়ে আসা হয় SSKM হাসপাতালে।
SSKM এর ফিজিকাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের অধ্যাপক রাজেশ প্রামাণিক বলেন, "মিক্সড সেরিব্রাল পালসিতে ভুগছে রাহুল। প্রধানত, ডিস্টনিয়া ওর বড় একটি সমস্যা।" এই রোগে স্বাভাবিক অঙ্গ সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ কখনও কখনও অসম্ভব হয়ে যায়। জন্ম থেকেই এই সমস্যা রয়েছে রাহুলের। তিনি আরও বলেন, "জন্মগত ভাবে ডিস্টনিক বা মিক্সড সেরিব্রাল পালসি বিরল নয়। কিন্তু ও যে এই সমস্যা নিয়ে যেভাবে চলছে। বসে বা শুয়ে থাকলে ওর মাথাটা সব সময় পিছনের দিকে ঝুঁকে থাকছে, হাত দুটো অস্বাবাভিক অবস্থায় থাকছে, এই অবস্থায় 21 বছর ওর মা-বাবার যত্নে যেভাবে চলছে, এটা খুবই বিরল। এরকম রোগী আমরা খুব একটা পাই না। এই ধরনের বিষয়ে চিকিৎসাও খুব চ্যালেঞ্জিং।"
অধ্যাপক রাজেশ প্রামাণিক আরও বলেছেন, "রাহুল যখন আমাদের কাছে প্রথমে এসেছিল তখন খুব খারাপ অবস্থায় ছিল। বিস্ময়করভাবে রাহুল পা দিয়ে লিখতে পারে। পা দিয়ে মোবাইল ফোন অপারেট করে। TV-তে ক্রিকেটের কমেন্ট্রি শুনে রাহুল ইংরেজি লিখতে পারে। পা দিয়ে ক্যারাম খেলে। অন্য কাজও করে। এভাবেই ও আনন্দে দিন কাটাত। কিন্তু এটাও বন্ধ হয়ে গেছিল। পা দিয়ে কোনও কাজই সে করতে পারছিল না। ওর মা সব সময় ওকে ধরে রাখতেন বলে রাহুল বসে থাকতে পারত বা শুয়ে থাকতে পারত।" এই সময় রাহুলের বিভিন্ন ধরনের থেরাপি শুরু হয়। নতুন একটি ওষুধ দেওয়া হয় তাতে পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হয়। এর পরে রাহুল আবার পায়ের কাজ করতে শুরু করেছে বলে জানান তিনি।
চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক বলেন, "রাহুলের ঘাড়, হাত সব সময় বেঁকে রয়েছে। এই সমস্যায় কী করা যায় এটা নিয়ে আমরা বেশ চিন্তিত ছিলাম। এর পরে আমরা একটি বিশেষ ইনজেকশনের কথা ভাবি, ইনজেকশনটি বেশ দামি। আমরা দেখে নিই কাজ হবে কি না।" দামি এই ইঞ্জেকশন রাহুলকে বিনামূল্যে গত বৃহস্পতিবার দেওয়া হয়েছে। এ কথা জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, "ইনজেকশন দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর থেকে ঘাড় ধরে রাখতে পারছে রাহুল। এই প্রথম দেখছি ও হাসছে। রাহুল বলছে ভিক্টোরিয়া ঘুরতে যাব। ওর শারীরীক অবস্থা আগের থেকে ভালো হয়েছে। এই উন্নতি চলতে থাকবে।"
কিছু দিন পরে এই বিশেষ ইনজেকশনের আসল ফলাফলটা পাওয়া যাবে। তখন ওকে আবার প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হবে, যাতে হাতের অ্যাক্টিভিটি কিছু করতে পারে। এই চিকিৎসক বলেছেন, "ওকে যতটা ভালো জীবনের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়, তার চেষ্টা চলছে। আমাদের দেখতে হবে ওর মধ্যে আরও কত ভালো গুণ লুকিয়ে রয়েছে, আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে সেগুলিও করতে পারে।" গত বৃহস্পতিবার যে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে, ছয় মাস পরে তা আবার দিতে হবে। বিভিন্ন ধরনের থেরাপি চলবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
মাঝে কেন রাহুলের এই জীবন থমকে গিয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, পা দিয়ে বিভিন্ন কাজ করে যেভাবে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতেন রাহুল, তা কেন আর পারতেন না তিনি? চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক বলেছেন, "বয়স যত বাড়তে থাকে ডিস্টনিয়া তত বাড়তে থাকে। এর জন্য চিকিৎসা রয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সেই সব চিকিৎসার মধ্যে রাহুল ছিল না। প্রয়োজনীয় ওষুধও পায়নি সে। থেরাপিও যথাযথভাবে হয়নি। এই সব কারণে রাহুল ওই সব কাজ আর করতে পারছিলেন না।"
রাহুলের বাবা স্বপন মুখোপাধ্যায় বলেছেন, "ভেলোর, নিমহ্যানসেও রাহুলের চিকিৎসা হয়েছে। দেড় মাস আগে SSKM এ যখন নিয়ে এসেছিলাম, তার থেকে এখন অনেক বেশি ভালো আছে রাহুল। ওর স্মৃতিশক্তি খুবই ভালো। ক্রিকেট খেলা দেখতে রাহুল খুব ভালোবাসে। প্রতিটি ক্রিকেট প্লেয়ারের নাম মনে রয়েছে ওর। ওর মায়ের চেষ্টায় ছোটবেলায় পা দিয়ে স্লেটে লিখত রাহুল। পায়ের মাধ্যমে পেন দিয়ে কাগজে লেখা শিখেছে। পা দিয়ে ক্যারাম খেলে, লুডো খেলে, টিভির রিমোট অপারেট করে, মোবাইলে গেম খেলে। ওর ভাই পড়াশোনা করে, তার থেকে শুনে শুনে রাহুল অনেক কিছু শিখেছে।"
তবে এই খুশির মধ্যেও চিন্তায় রয়েছেন তিনি। কারণ, রাহুলের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। প্রতি মাসে চিকিৎসার জন্য খরচ হয় ৮-১০ হাজার টাকা। একটি ওষুধের দোকানের কর্মী স্বপন মুখোপাধ্যায়। আগামী দিনে কী ভাবে ছেলের চিকিৎসার জন্য খরচ জোগাড় করবেন, তা ভেবে উঠতে পারছেন না তিনি।