কলকাতা, 23 এপ্রিল : চিকিৎসকদের পাশাপাশি একের পর এক নার্স কোরোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন । আক্রান্ত হচ্ছেন অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও । এই পরিস্থিতিতে নার্সদের সংগঠন নার্সেজ় ইউনিটির তরফে অভিযোগ করা হয়, সরকারি হাসপাতালে সরকারি প্রোটোকলই মানা হচ্ছে না । এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব না হলে বিপদ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে তারা ।
কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পাঁচজন নার্স কোরোনায় আক্রান্ত হয়েছেন । তাঁদের মধ্যে চারজন কোরোনা আক্রান্ত এক প্রসূতির সংস্পর্শে আসার ফলে আক্রান্ত হয়েছেন । সন্তান প্রসবের পর ওই মহিলার শরীরে কোরোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে । এই প্রসূতির সংস্পর্শে আসার ফলে এখনও পর্যন্ত কলকাতা মেডিকেলের সাতজন চিকিৎসক এবং চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী কোরোনা আক্রান্ত হয়েছেন । হাসপাতালে ভরতির পর পাঁচ দিনের মাথায় ওই প্রসূতির সোয়াবের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া যায় । রিপোর্টে জানা যায়, তিনি কোরোনা আক্রান্ত । কোরোনা আক্রান্ত সন্দেহ হওয়ার আগে তাঁর সংস্পর্শে আসার ফলে এত বেশি সংখ্যক চিকিৎসক-নার্স কোরোনা আক্রান্ত হয়েছেন । সূত্রে খবর, এই হাসপাতালের অন্য আরও দুই চিকিৎসক এবং এক নার্স কোরোনা আক্রান্ত হয়েছেন ।
তবে শুধু কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নয় । রাজ্যের অন্য হাসপাতালেও এমন হয়েছে ৷ প্রথমে বোঝা যায়নি । পরে সন্দেহ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট রোগীর সোয়াবের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় । ওই নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টে সংশ্লিষ্ট রোগীর কোরোনা পজ়িটিভ ধরা পড়ে । বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, সংশ্লিষ্ট রোগীর মৃত্যুর পর তাঁর নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে ৷ যে রিপোর্টে জানা গিয়েছে, ওই রোগী কোরোনা আক্রান্ত ছিলেন । যেমন, NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল । সূত্রের খবর অনুযায়ী, এই হাসপাতালের CCU-তে ডিউটি করেছেন এমন তিনজন নার্স কোরোনা আক্রান্ত হয়েছেন । এই তিনজন নার্স CCU-তে এক রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন । ওই রোগীর মৃত্যুর পর তাঁর সোয়াবের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছিল । ওই রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, তিনি কোরোনা আক্রান্ত ছিলেন ।
RG কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালেও এক রোগীর মৃত্যুর পরে জানা গিয়েছিল, ওই রোগী কোরোনা আক্রান্ত ছিলেন । ওই রোগীর সংস্পর্শে আসার জেরে সেখানকার এক নার্স এবং এক চিকিৎসক কোরোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে । হাওড়া হাসপাতালেও একই ছবি ধরা পড়েছে । এমন ঘটনা রাজ্যের অন্য হাসপাতালেও দেখা যাচ্ছে । এই ধরনের ঘটনা এড়ানোর জন্য রাজ্যের প্রতিটি হাসপাতালে অবিলম্বে যাতে রাজ্য সরকারের প্রোটোকল অনুযায়ী, ফিভার ক্লিনিকের পরিষেবা দেওয়ার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়, ইতিমধ্যেই সেই দাবি জানিয়েছে নার্সেজ় ইউনিটি । অথচ, এরপরও একের পর এক নার্স কোরোনা আক্রান্ত হয়ে চলেছেন বলে জানা যাচ্ছে । এই ঘটনার জেরে বিভিন্ন হাসপাতালের বহু নার্স আতঙ্কে রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে । নার্সদের এই আতঙ্কের কারণ হিসাবে জানা গিয়েছে, N95 মাস্ক এবং পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (PPE) ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে তাঁদের ডিউটি করতে হচ্ছে । এই বিষয়ে উদ্বিগ্ন নার্সদের এই সংগঠন ।
এই বিষয়ে নার্সেজ় ইউনিটির সেক্রেটারি ভাস্বতী মুখোপাধ্যায় বলেন, "ফিভার ক্লিনিকে স্ক্রিনিং যাতে যথাযথভাবে হয়, তার জন্য সরকারি হাসপাতালে সরকারি প্রোটোকলই মানা হচ্ছে না । প্রোটোকল না মানার কারণে চিকিৎসক, নার্স সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন । তাঁদেরকে কোয়ারান্টাইনে পাঠানো হচ্ছে । এর ফলে যেমন কমিউনিটিতে ইনফেকশন বাড়ছে, তেমনই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার জায়গায় চলে যাচ্ছে ।" তিনি আরও বলেন, "স্ক্রিনিং যেহেতু যথাযথভাবে হচ্ছে না এবং এখন যেভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে হাসপাতালের সব ধরনের ওয়ার্ডই সন্দেহের । যথাযথ পরিমাণে PPE এখনও পর্যন্ত ওয়ার্ডে নেই । কিছু PPE দেওয়া হয়েছিল । এখন যা পরিস্থিতি তাতে এই PPE-র মাধ্যমে সামাল দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই ।"
ভাস্বতী মুখোপাধ্যায় বলেন, "যেখানে কোনও রোগীর ক্ষেত্রে কোরোনা পজ়িটিভ ধরা পড়ছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট নার্স, চিকিৎসক এবং অন্য কর্মীর টেস্ট করানো দরকার । অথচ, এই টেস্ট করানোর জন্য সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি হচ্ছে । এক্ষেত্রেও তো প্রোটোকল রয়েছে । কোনওটাই সেভাবে হচ্ছে না । এভাবে চলতে থাকলে লকডাউন চলছে আর আমরা রোগীদের পরিষেবা দিচ্ছি, কিন্তু শেষ রক্ষা কতদিন করতে পারব সেই বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না । এই পরিস্থিতি আমরা চাইছি না । আমরা চাইছি, স্ক্রিনিং । এটার জন্য ফিভার ক্লিনিক খুবই জরুরি ।"
কলকাতার হাসপাতালগুলির ইমারজেন্সিতে যদিও বা কিছু PPE রয়েছে, কিন্তু কলকাতা থেকে একটু দূরের হাসপাতালে সেটুকুও পৌঁছাচ্ছে না । অথবা, পৌঁছাচ্ছে কিন্তু ওয়ার্ডে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে না । কোথাও কোথাও গাড়ি ভাড়ার জন্য অনেক বেশি টাকা খরচ করে কোনও নার্সকে ডিউটিতে যেতে হচ্ছে । এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব না হলে সবদিকেই মুশকিল । এই কথা জানিয়ে তিনি বলেন, "যে পরিমাণে PPE সরবরাহ করা হচ্ছে, তাতে কিছু হবে না । নন AC সেট আপে এই PPE পরে এক ঘণ্টার বেশি সময় থাকা যায় না । এটা যদি কষ্ট করে দুই ঘণ্টা করা হয়, তা হলে ছয় ঘণ্টার একটি শিফটে তিন বার PPE বদল করতে হবে । একটি ওয়ার্ডে দুই জন নার্স ডিউটি করলে, একটি শিফটে ছয়টি PPE-র প্রয়োজন । AC সেট আপে এই ধরনের PPE পরে তিন ঘণ্টার মতো থাকা যেতে পারে । এই পরিস্থিতি আটকে দেওয়া যেতে পারে একমাত্র যদি ফিভার ক্লিনিকে স্ক্রিনিং কঠোরভাবে হয় । ফিভার ক্লিনিকে যদি যথাযথ PPE সরবরাহ থাকে, তাহলে হাসপাতালের অন্য ওয়ার্ডে রাখতে হবে না । সরকারি প্রোটোকলেই রয়েছে, এটা সব ধরনের হাসপাতালে হওয়ার কথা ।"