কলকাতা, 26 নভেম্বর : দেশপ্রেম ৷ হ্যাঁ, সেখান থেকেই ভারতের সংবিধান রচনার সূত্রপাত । দেশে গণপরিষদ তৈরির প্রথম দাবি তোলেন এম এন রায় । যিনি ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা । সালটা ছিল 1935 । কংগ্রেসের তরফেও একই দাবি তোলা হয় । 1940 সালে ব্রিটিশ সরকার মেনে নেয় সেই দাবি । 1946 সালে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবনায় অনুষ্ঠিত হয় গণপরিষদের নির্বাচন । সেই সময় সদস্য সংখ্যা ছিল 389 জন । যার মধ্যে প্রাদেশিক প্রতিনিধি ছিল 296 জন । 93 জন ছিলেন মনোনীত সদস্য। গণপরিষদের প্রথম স্থায়ী সভাপতি হন ডঃ রাজেন্দ্র কুমার । সহ সভাপতি হন হরেন্দ্র কুমার মুখোপাধ্যায় । গণপরিষদে আরও অনেক বাঙালির মধ্যে ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় । ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে মানুষগুলির স্বাক্ষর ছিল তার মধ্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অন্যতম ।
তথ্য বলছে, খসড়া সংবিধানে জমা পড়েছিল 7365টি সংশোধনী প্রস্তাব । তার মধ্যে ক'টি শ্যামাপ্রসাদ জমা দিয়েছিলেন সে বিষয়ে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি । তবে অনেকেই দাবি করেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় খসড়া সংবিধানের উপর গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছিলেন । গণপরিষদের বৈঠকে 2473টি সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছিল । মোট 284 জন সংবিধানে স্বাক্ষর করেছিলেন । সেখানে স্বাক্ষর ছিল শ্যামাপ্রসাদেরও । পশ্চিমবঙ্গের মোট 21 জন স্বাক্ষর করেছিলেন সেই সংবিধানে ।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেন, "সংবিধানে ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । জাতীয় সংহতি রক্ষা সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । সেদিকে লক্ষ্য রেখেই নাগরিকদের নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃভাব তৈরির জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে ।" অর্থাৎ, দেশপ্রেমিকদের হাতে তৈরি সংবিধান দেশের অখণ্ডতা রক্ষার গুরু দায়িত্ব দিয়েছে জনগণকে । আর এখানেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের গুরুত্ব অপরিসীম ।
ইতিহাস বলছে, গণপরিষদে 1949 সালের 12 মে থেকে 16 অক্টোবর পর্যন্ত আলোচনার পর 370 ধারা গৃহীত হয় । ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হলে জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও তা কার্যকর হয় রাষ্ট্রপতির নির্দেশে । দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের ঠিক পরেই 1952 সালের 24 জুলাই শেখ আবদুল্লাহর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ভারত সরকারের । চুক্তিতে ভারতের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন এবং রাজ্যের মধ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন স্বীকৃত হয় । সেই প্রদেশের নিজস্ব সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া শুরু হয় । এই চুক্তি অনুযায়ী, 1954 সালে সংবিধানে 35-এ ধারা যুক্ত হয় । শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অবশ্য প্রথম থেকেই 370 ধারার বিরোধী ছিলেন । জম্মু ও কাশ্মীর সহ একাধিক বিষয়ে মতের অমিল হওয়ায় তিনি নেহরু মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন । তৈরি করেন জনসংঘ । 1952-র সাধারণ নির্বাচনে জনসংঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে । সেই নির্বাচনে জনসংঘ তিনটি আসন পেয়েছিল ।
এরপরই জম্মু কাশ্মীর প্রসঙ্গে সংসদে শ্যামাপ্রসাদের বিরোধিতার শুরু । জম্মু-কাশ্মীরে আন্দোলন শুরু করে প্রজা পরিষদ । তাকে সমর্থন জানান শ্যামাপ্রসাদ । জোর দিয়ে বলেন, কোনওরকম শর্ত ছাড়াই ভারতে সামিল করা হোক কাশ্মীরকে । তাঁর বক্তব্য ছিল, জম্মু এবং লাদাখের ভারতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একীকরণ হওয়া উচিত । এ প্রসঙ্গে প্রাক্তন সাংবাদিক তথা RSS নেতা রন্তিদেব সেনগুপ্ত বলেন, "সংবিধানের স্বাক্ষরকারী হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের কিছু দায়িত্ব থেকেই গিয়েছিল । আর সেই কারণেই দেশের মধ্যে একটি প্রদেশকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়ার বিরোধী ছিলেন তিনি । চেয়েছিলেন জম্মু এবং লাদাখের ভারতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একীকরণ । জম্মু-কাশ্মীরে যাওয়ার জন্য পারমিট প্রথারও ঘোরতর বিরোধী ছিলেন তিনি । 1953 সালের 8 মে জম্মু-কাশ্মীরের উদ্দেশে রওনা দেন শ্যামাপ্রসাদ । 11 মে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় । শ্রীনগরের জেলে মৃত্যু হয় শ্যামাপ্রসাদের ।"
শ্যামাপ্রসাদ নিয়ে গবেষণাকারীদের দাবি, ভারতীয় সংবিধানের স্বাক্ষরকারী হিসেবে সংবিধান রক্ষার জন্যই লড়াই করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ।