কলকাতা, 18 জুন: সাত বাঙালির প্রথমবার 'পৃথিবীর ছাদ'-এ পা দেওয়ার চেষ্টা । স্কুলপাঠ্যে ভূগোল বইয়ে পামির মালভূমিই 'পৃথিবীর ছাদ' বলে বর্ণিত । সহজ কথায়, মালভূমি কিংবা পৃথিবীর ছাদ আসলে একাধিক পর্বত শৃঙ্গের জট । যেখানে পর্বত শৃঙ্গের গড় উচ্চতা ছয় থেকে সাত হাজার মিটার । কিরঘিজস্তানের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম আধার এই পর্বত শৃঙ্গগুলি । চলতি মাসে 25 তারিখ শুরু ভারত-বাংলাদেশের এই যৌথ অভিযান । থাকছেন পশ্চিমবাংলা এবং বাংলাদেশের সাত অভিযাত্রী । তাই এই অভিযানে সেই অর্থে সীমান্তের কাঁটাতার ছিঁড়ে গিয়েছে । দুই বাংলা মিলে-মিশে অপার বাংলায় পরিণত হয়েছে ।
পামির মালভূমি, সহজভাবে ভাবলে এর বিশালত্ব ধরা পড়ে না । ট্রান্স জন আলাই রেঞ্জের সেন্ট্রাল এশিয়ার এই পর্বত শৃঙ্গগুলি কিরঘিজস্তানে অবস্থিত । এই ট্রান্স জন আলাই রেঞ্জের অনেকগুলি শৃঙ্গের মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ পিক লেনিন, যার উচ্চতা 7.138 মিটার । হাতে আর মাত্র দিন সাতেক । এ পার বাংলার পাঁচ অভিযাত্রী দেবাশিস বিশ্বাস, মলয় মুখোপাধ্যায়, সৌরভ সিঞ্চন মণ্ডল, কিরণ পাত্র, অভিজিৎ রায় এবং ওপার বাংলার ড. বাবর আলি, তনবীর আহমেদ এই অভিযানে যাচ্ছেন । পুরো অভিযাত্রী দলের নেতৃত্বে দেবাশিস বিশ্বাস ।
এভারেস্ট জয় করার পরে পামির মালভূমি অভিযান, কোন আমোঘ আকর্ষণ লুকিয়ে রয়েছে ? ধর্মতলার আয়কর ভবনের দোতলায় ইনকাম ট্যাক্সের উচ্চপদাধিকারী দেবাশিস বিশ্বাসের ঘরটি যে কোনও অভিযানের আগেই বেসরকারিভাবে অভিযাত্রী দলের মন্ত্রণালয় হয়ে ওঠে । এখানে বসেই কাজের ফাঁকে অভিযানের নীল নকশা সাজান দেবাশিস, সৌরভ সিঞ্চন, মলয়রা । ইতিমধ্যেই আসন্ন পামির মালভূমির পিক লেনিন অভিযানের সলতে পাকানোর কাজ চলছে ।
আরও পড়ুন: মাকালু থেকে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে ফিরেছেন, আবারও শৃঙ্গ জয়ের স্বপ্ন দেখছেন পিয়ালী
অভিযানের দলনেতা দেবাশিস বিশ্বাস জানাচ্ছেন, “যে কোনও অভিযানের আগেই আমরা আউট অব দ্য বক্স ভাবার চেষ্টা করি । এভাবেই 2019 সালে আমরা পামির মালভূমির চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ পিক লেনিন অভিযানের পরিকল্পনা করি । যার বাস্তবায়ন এই বছর হচ্ছে । পামির মালভূমি আমাদের কাছে বইয়ের পাতার মাধ্যমে পরিচিত । এবং সেটা যে শুধুমাত্র মালভূমি নয়, তা অনেকেই জানি না । বরং একাধিক শৃঙ্গের জট বলতে পারেন । যাদের গড় উচ্চতা সাত হাজার মিটারের বেশি । পিক লেনিন উচ্চতার বিচারে চার নম্বর ।”
একটু থেমে তিনি ফের করলেন, “একটি অভিযানে গেলে আমরা একাধিক শৃঙ্গ জয়ের লক্ষ্যে যাই । এ বারও সেই পরিকল্পনা রয়েছে । তবে অন্যান্যবারের মতো আমরা প্রায় কোনও খবর না নিয়ে কিরঘিজস্তানের মাটিতে পা রাখব । যাতে আবিষ্কার করতে করতে যাওয়া যায় । কিরঘিজস্তান দেশটির সঙ্গে আমাদের ভারতবর্ষের যোগ রয়েছে । ও দিক থেকে মোঘলরা এসেছিল । সম্রাট বাবরের জন্মভূমি । খাদ্যাভ্যাসে মিল রয়েছে । সব মিলিয়ে প্রকৃতিক সৌন্দর্য, রহস্যময়তা এবং ইতিহাসের খোঁজ - এই তিনের টানে দুই বাংলার সাত অভিযাত্রী যাচ্ছি, বলা যায় ।”
দলনেতা দেবাশিস বিশ্বাসের কথার সুর টেনে নিলেন সৌরভ সিঞ্চন মণ্ডল । প্রথমে দ্বিধা থাকলেও পরে চোখের সামনে অভিযানের সলতে পাকানোর কাজ হচ্ছে দেখতে পেয়ে আর নিজেকে আটকাতে পারেননি । তাঁর কথায়, “ভীষণ উত্তেজিত আমি । প্রস্তুতি হচ্ছে দেখে শেষ পর্যন্ত নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি । তড়িঘড়ি ছুটির দরখাস্ত করে রওনা হচ্ছি । দেবাশিস যা বলছিল তা একদম ঠিক । পামির মালভূমি আমাদের কাছে একটা নস্টালজিয়া । ভূগোল বইয়ে পড়েছিলাম । এভারেস্ট পর্বত জয়ের পরে কেন এই অভিযান এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে পারি, অধরা স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে পাড়ি দিচ্ছি । কিরঘিজস্তান দেশটিকে দেখার ইচ্ছেও রয়েছে । পরিকল্পনা রয়েছে শুধু পিক লেনিন নয়, যতগুলো পারব পর্বত শৃঙ্গ জয় করার চেষ্টা করব ।”
অভিযান মানেই শারীরিক সক্ষমতার তুঙ্গে থাকার চ্যালেঞ্জ । তাই সকলেই জিম ট্রেনিং, দীর্ঘ পথ দৌড়, সাইক্লিং করে নিজেকে ফিট করার চেষ্টা করছেন । এই দলের বয়স্ক সদস্য কিরণ পাত্র । 64 বছর বয়সেও তিনি পর্বারোহণে শারীরিকভাবে ফিট । সকলেই বলছেন, পামির মালভূমি অভিযানে ভারতীয় দলের সাফল্যের কথা এখনও অবধি শোনা যায়নি ।
আরও পড়ুন: এবারও বাতিল উত্তর মেরু অভিযান, বিশ্বরেকর্ড হল না সত্যরূপের
দেবাশিস দাস জানালেন, "কোনও ভারতীয় অভিযাত্রী দল এই অভিযানে সফল হয়েছে তা জানা নেই । বাঙালি অভিযাত্রী হিসেবে আমরাই প্রথম যাচ্ছি । এ বার প্রথমবার ভারত-বাংলাদেশ যৌথ অভিযান হচ্ছে । আমাদের পরে হয়তো অনেকেই এরপর পামিরের পথে যাবে । সেদিক থেকে একটা অভিযাত্রী হিসেবে আবিস্কারের মন নিয়ে যাচ্ছি আমরা । কোনও খোঁজ খবরও নিচ্ছি না ৷"
অভিযাত্রী দলে মলয় মুখোপাধ্যায় নামটি থাকবেই । বছরভর নতুন কিছু দেখার নেশায় মলয় যেন ব্যাগপত্তর বেঁধেই রাখেন । এ বার তাই ব্যতিক্রম হয়নি । 25 জুন সাত সদস্যের দলে তিনিও রয়েছেন । মলয় বলেন, "নতুনের খোঁজে সবসময় আমি । ঘুরে বেড়ানোতেই সেরা শিক্ষা অর্জন হয় । পৃথিবীতে যা কিছু আছে, যত কিছু আছে, তা যতটা সম্ভব দেখে নেওয়াই লক্ষ্য । পাহাড়কে ভালোবাসি । তাই পৃথিবীর যেখানে পাহাড় রয়েছে, তা দেখার চেষ্টা করব । সেই চেষ্টার নামান্তর এই পিক লেনিন অভিযান । দেখো, পামির মালভূমির গড় উচ্চতা 23 হাজার ফিট । তাকে পর্বতের চেয়ে কম বলা যাবে না । কিরঘিজস্তান দেশটা সুন্দর । এই পর্বতারোহণের চ্যালেঞ্জটা ঠান্ডা এবং হাওয়ার গতিবেগে লুকিয়ে । আমি বলব না এটা সহজ অভিযান । আবার কঠিন অভিযান না বললেও ভুল হবে ৷"
নন্দা ঘুন্টি অভিযান দিয়ে পর্বোতারোহণে বাংলা পথ দেখিয়েছিল । এরপর এভারেস্ট অভিযান হয়েছে । 2010 সালে বাঙালির এভারেস্ট জয় তেমনই এক দিগনির্দেশ অভিযান । 2023 সালে দুই বাংলার সাত বাঙালির পামির মালভূমি অভিযান তেমনই এক মাইলস্টোন হতে চলেছে ।