ঝাড়গ্রাম, 25 জানুয়ারি: কোলে নেওয়ার পর থেকে শুরু হয়েছিল চিল চিৎকার ৷ নাচ-গান শুরু হতে তা আরও বেড়ে যায় মাস দেড়েকের শিশুটার ৷ কিন্তু, খানিক পর সব কিছু থেমে যাওয়ায় সন্দেহ হয় পরিবারের ৷ আর বৃহন্নলাদের কাছ থেকে দুই সন্তানকে কোলে নেওয়ার পরই কেমন যেন ছ্যাঁক করে উঠেছিল মায়ের বুকটা ৷ এক মুহূর্ত নষ্ট না করে এক শিশুকে নিয়ে হাসপাতালের পথে ছুটেছিলেন বাবা-মা ৷ কিন্তু, ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে ৷ চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, বেশ কিছুক্ষণ আগেই মৃত্যু হয়েছে শিশুটির৷ ঝাড়গ্রামের শিলদা গ্রামের এই ঘটনায় তিন বৃহন্নলাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ৷ শিশুটির পরিবারের দাবি, বৃহন্নলাদের 'অত্যাচারেই' মৃত্যু হয়েছে শিশুটির ৷ আজ এই ঘটনায় ঝাড়গ্রাম আদালতের বিচারক 14 দিনের জেল হেপাজতের নির্দেশ দিয়েছেন বৃৃহন্নলাদের ৷
গত বছর ডিসেম্বরে দুই যমজ সন্তানের জন্ম দেন চন্দন খিলারের স্ত্রী ৷ দুই যমজ সন্তানের জন্মের খবর পাওয়ার পর থেকেই খিলারের বাড়িতে শুরু হয়েছিল বৃহন্নলাদের আনাগোনা ৷ কিন্তু ঘাড় শক্ত হয়নি, মায়ের কোল ছাড়া আরও তেমন ভাবে কিছুই পরিচিত নয়, তার উপর জন্ডিস ধরা পড়ায় বৃহন্নলাদের হাতে ছেলেদের তুলে দিতে চায়নি পরিবার ৷ এর আগেও অসুস্থতার অজুহাতে বৃহন্নলাদের ফেরত পাঠিয়েছিল তারা ৷
আজ ফের একবার খিলারের বাড়িতে আসেন এই তিন বৃহন্নলা ৷ শিশুটির পরিবারের অভিযোগ, আগে এক বার ফিরে গেলেও আজ কোনও কিছুই মানতে চায়নি তারা ৷ দুই শিশুকে কোলে তুলে নিতে চায় তারা ৷ চন্দনবাবু বৃহন্নলাদের জানান, এক শিশু খুবই দুর্বল৷ কিছুদিন আগে তার জন্ডিস ধরা পড়ে ৷ হাসপাতালে ভরতিও করা হয়েছিল ৷ শিশুটির হার্টের কিছু সমস্যা রয়েছে বলেও বৃহন্নলাদের জানানো হয়৷ পরিবারের অভিযোগ, বার বার নিষেধ করলেও কিছু মানতে চায়নি তারা ৷ উলটে অপমান করতে শুরু করে তারা ৷ বেশ কিছু কু-কথাও বলে চন্দন ও তাঁর স্ত্রীকে ৷
ক্রমাগত শিশু দুটিকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে তারা ৷ হাজারো বোঝানোর পরও কোনও কাজ হয়নি ৷ অনেকটাই বাধ্য হয়েই এক মাস কুড়ি দিনের দুই শিশুকে বৃহন্নলাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ৷ শিশু দুটিকে আশীর্বাদ-ভালোবাসার নামে কোলে তুলে নাচগান শুরু করে তারা ৷ শুরু করে ঘুরতে ৷ পরিবারের অভিযোগ, ভয় পেয়ে এক সময় মাস দেড়েকের শিশু দুটো কেঁদে উঠলেও ছাড়তে চায়নি তারা ৷ এর পর হঠাৎই কান্না বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সন্দেহ হয় পরিবারের ৷ এরপরই শিশু দুটিকে ফিরিয়ে দেয় বৃহন্নলারা ৷
কোলে নিয়েই কেমন যেন সন্দেহ হয় বাবা-মায়ের ৷ নিস্তেজ হয়ে পড়া শিশুটিকে কাঁদানোর চেষ্টা করা হয় ৷ অনেক চেষ্টা করেও কোনও সাড়াশব্দ না মেলায় সন্দেহ হয় ৷ দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ সেখানেই চিকিৎসকরা শিশুটিকে মৃত বলে ঘোষণা করে ৷ শিশুটিকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনই পাড়ার লোকজন ওই তিন বৃহন্নলাকে আটকে রেখেছিলেন ৷ শিশুটির মৃত্যুর খবর মিলতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন সবাই ৷ খবর দেওয়া হয় পুলিশে ৷ ঝাড়গ্রাম থানার পুলিশ ওই তিন বৃহন্নলাকে গ্রেপ্তার করে ৷ অভিযুক্তদের নাম রেহেনা, সুহানা, রুমা মণ্ডল ৷ আগামীকাল তাদের ঝাড়গ্রাম আদালতে তোলা হবে ৷
শিশুটির বাবা চন্দন খিলারের দাবি, বার বার নিষেধ করা সত্ত্বেও মানতে চায়নি বৃহন্নলারা ৷ নাচগান নয়, কেবল আশীর্বাদ করে চলে যাবে বলেই জানিয়েছিল তারা ৷ চন্দন আরও বলেন, "আমি ওদের টাকা নিয়ে চলে যেতে বলেছিলাম ৷ ওরা 12 হাজার টাকা দাবি করেছিল ৷ কিন্তু, ছেলে দুটোকে কোল নিয়ে ঘুরতে শুরু করে ৷ তার পরই সব শেষ ৷" শিশু দুটি যে অসুস্থ, তাদের চিকিৎসা চলছে, সে সংক্রান্ত প্রেসকিপসন দেখানোর পরও বৃহন্নলারা কিছু মানতে চায়নি বলেও অভিযোগ করেছেন চন্দন ৷
বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে চায়নি ঝাড়গ্রাম থানার পুলিশ ৷ শিশুটির দেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে ৷ ঝাড়গ্রামের SP অমিতকুমার রাঠোরের কথায়, "বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক ৷ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৷ ময়নাতদন্তের পরই মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে৷" কারও দোষ প্রমাণিত হলে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন রাঠোর ৷
ঝাড়গ্রামের ওই ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন রূপান্তরকামী সংগঠন ৷ রূপান্তরকামীদের নিয়ে কাজ করা এক বেসরকারি সংগঠনের সভাপতি তিস্তা দাসের কথায়, "এটা খুবই নিন্দনীয় ঘটনা ৷ তদন্ত হওয়া দরকার ৷" পাশাপাশি, বৃহন্নলাদের জন্য সরকারের ভূমিকা আরও সদর্থক হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি ৷ সংগঠনের অপর এক নেত্রী দেবাঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট দাবি, দোষ প্রমাণিত হলে উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত ৷