জলপাইগুড়ি, 5 জুন: রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা...একে-অপরের মনের মানুষই ছিল রূপ আর সাগর ৷ বন্ধুত্বও ছিল কাঁচা সোনার মতোই নিখাদ ৷ একটু বেশি রোজগারের আশায় দুই বন্ধু মিলে গিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতে ৷ দুজনে মিলে একসঙ্গে বাড়িতে ফিরবেন বলে এক মাসের ছুটি নিয়েছিলেন নাগরাকাটা চা বাগানের বাসিন্দা এই দুই পরিযায়ী শ্রমিক ৷ তাঁরা রওনা দেন যশবন্তপুর এক্সপ্রেসে ৷ রূপ কোনওক্রমে বাড়ি ফিরলেও সাগরের আর ফেরা হয়নি ৷ করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ধাক্কায় উলটে যায় তাঁদের কামরা ৷ তার পরের সময়টা অন্ধকারে ঘেরা ৷ সাক্ষাৎ মৃত্যুকে খুব সামনে থেকে চাক্ষুস করার পর বাড়ি ফিরে সেই অভিশপ্ত রাতের কাহিনি শোনালেন রূপ ৷ চোখের জলে জানালেন, "আমার সামনেই প্রাণটা চলে গেল সাগরের ।"
"এখানে কাজের টাকা কম, তাই আমরা বাইরে কাজে গিয়েছিলাম । আর কোনওদিন বাইরে কাজে যাব না ৷" কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন নাগরাকাটা ফুটবল লাইনের বাসিন্দা রূপ বরাইক । ওড়িশার বালাসোরের ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে পড়েন নাগরাকাটা চা বাগানের এই পরিযায়ী শ্রমিক ৷ ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে ফিরেছেন ৷ ফিরেছেন ওই বাগানেরই বাসিন্দা তাঁর আরও 9 জন সঙ্গী ৷ আর একজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় বালাসোরের হাসপাতালে ভর্তি ৷ তবে ঘরে ফেরা হয়নি রূপের সবসময়ের সঙ্গী সাগরের ৷
সেই রাতের স্মৃতি এখনও তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ৷ এখনও বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে তাঁর বন্ধু আর নেই ৷ কান্না ভেজা গলায় রূপ জানালেন, "আমি 20 টাকা দিয়ে মুড়ি কিনে খাচ্ছিলাম । হঠাৎ দেখি আমাদের কামড়া উলটে গেল । তারপরই দেখতে পেলাম, আমার সামনে সাগরের ক্ষতবিক্ষত দেহ । কী হল বুঝতেই পারলাম না ।"
এই ঘটনায় তাঁর মনে বাসা বেঁধেছে প্রবল আতঙ্ক ৷ বন্ধুকে হারিয়ে আর নিজে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে রূপ ঠিক করেছেন, আর কোনও দিন বাইরে কাজে যাবেন না ৷ তিনি বলেন, "আমরা কাজের জন্য বেঙ্গালুরুতে গিয়েছিলাম । এই রাজ্যে কাজ থাকলেও বেতন খুব কম । তাই বেশি বেতনের জন্যই আমরা বেঙ্গালুরুতে গিয়েছিলাম...৷" কথাগুলো বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পরেন রূপ । বলতে থাকেন, "আমি আর কোনওদিন বাইরে কাজে যাব না ।"
আরও পড়ুন: উচ্চমাধ্যমিকে বসা হল না, ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু মালদার ইউনুসের
আতঙ্কের ট্রেন যাত্রার সাক্ষী হয়ে বাড়ি ফিরেছেন জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা চা বাগানের 10 জন যুবক । একসঙ্গেই কাজে গেলেও ফিরতে পারেননি সাগর খেড়িয়া । সাগর নেই, এটা রূপ কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না ৷ তাঁরা বেঙ্গালুরুর হোটেলে একসঙ্গে কাজ করতেন । ছুটিতে বাড়ি ফিরে আসছিলেন । প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিলেন ৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই হাওড়া স্টেশনে নামার কথা ছিল । স্বপ্ন ছিল, বাড়ি ফিরে ঘরের মানুষগুলোকে বহুদিন পর কাছে পাওয়ার ৷ কিন্তু ট্রেন বালাসোর পৌঁছতেই আচমকা দুমড়ে মুচড়ে গেল স্বপ্নগুলো । বেলাইন হওয়া ট্রেনের কামরাগুলির মতোই ৷
নাগরাকাটার 13 জন পরিযায়ী শ্রমিকের দলের মধ্যে সাগর খেড়িয়ার মৃত্যু হয়েছে । মারাত্মক ভাবে জখম হন ধরমবীর সিং । তিনি বালাসোরের হাসপাতালেই ভর্তি আছেন ৷ তাঁকে দেখাশোনার জন্য সেখানে থেকে গিয়েছেন দুর্গা বরাইক নামে এক শ্রমিক ৷ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাকি আহতদের গাড়িতে করে মালবাজার সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে আসার পর, তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা করানো হয় । মাল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয় রূপ বরাইককে । বাকি 9 জনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয় ।
জানা গিয়েছে, ডুয়ার্সের নাগরাকাটা চা বাগানের 13 জন ও বীরপাড়া চা বাগানের একজন যুবক বেঙ্গালুরুর একটি হোটেলের কাজ করতেন । ভয়াবহ দুর্ঘটনার বলি সাগর খেড়িয়ার (30) দেহ আজই নাগরাকাটায় চলে আসবে । অল্প চোট আঘাত নিয়ে ফিরে আসেন রোহিত গোস্বামী (28), আমন ওঁরাও (24), বিজিন্দর ওঁরাও (28), মুখেশ নাইক (19), প্রীতম লোহার (18), নিশান ওঁরাও (17), সাগর ওঁরাও (28), রাজ ভোক্তা (19), দয়াশঙ্কর ওঁরাও (19) ও রূপ বরাইক (23)।