জলপাইগুড়ি, 9 জুন : ভিক্ষে করে খান 'বঙ্গরত্ন'৷ উত্তরবঙ্গের সারিঞ্জা-বাদক শিল্পী মঙ্গলাকান্ত রায় এখন বেঁচে আছেন লোকের দয়ায় ৷ এলাকায় মঙ্গলু রায় নামে পরিচিত তিনি । বর্তমানে চরম আর্থিক অনটনে দিন কাটালেও নিজেকে 'বড়লোক' বলতেই ভালোবাসেন ৷ শিল্পীর কথায়, "আমি যখন সারিঞ্জা বাজাই তখন আমার মতো বড়লোক কেউ নেই ৷'' যদিও 'বড়লোক' শিল্পীর 'গরিবি' দিন দিন বাড়ছে ৷ কারণ, লকডাউনের বাজারে ভিক্ষেটুকুও মিলছে না ৷ এরই মধ্যে ঝড় দুর্বল করে দিয়ে গেছে বাড়িটা । লাজুক শিল্পী তক্তপোশে বসে সে সব দেখালেন বটে, কিন্তু এর বেশি কিছু বললেন না ৷ মঙ্গলু রায়ের স্ত্রী'র কথায়, "সরকারি সাহায্য পেলে ভালো হয় ৷ খুব খারাপভাবে বেঁচে আছি ৷ এভাবে কতদিন চলবে জানি না ।"
জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের প্রত্যন্ত আমগুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের ধওলাগুড়ি গ্রাম। এখানেই মঙ্গলু রায়ের টিনে ছাওয়া বাড়ি। তিনি স্ত্রী চম্পা রায়কে নিয়ে কার্যত অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন । তিন ছেলে চার মেয়ে থাকলেও স্ত্রী'কে নিয়ে আলাদা থাকেন মঙ্গলুবাবু। অভিমানী শিল্পীর কথায়, "শুধু সম্মানটুকুই মিলেছে, আর্থিক উন্নতি হয়নি।"
![sarinja artist bangaratna manglu roy](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/wb-jal-01-special-banga-ratna-7203427_09062020110448_0906f_00504_899.jpg)
2017 সালে বঙ্গরত্ন সম্মান পান সারিঞ্জা-শিল্পী মঙ্গলু রায় । মিলেছে সরকারি শিল্পীর তকমাও। সে সময় তাঁর উপর আচমকা কিছুটা আলো পড়েছিল বটে, কিন্তু ওই অবধি ৷ তারপর কেমন আছেন বঙ্গরত্ন ? খোঁজ নেয়নি কেউ । শিল্পীকে যে এখন ভিক্ষে করে খেতে হচ্ছে তা হয়তো জানেন না তাঁর গুণগ্রাহীরাও ৷ "ভিক্ষেই বা মিলছে কোথায়!" বলেন মঙ্গলু রায় ৷ অথচ মঙ্গলু রায়ের খ্য়াতি যথেষ্ট। সারিঞ্জা বাজানো শিখেছিলেন ওপার বাংলার বাউল টলমন গোঁসাইয়ের কাছ থেকে। টলমন গোঁসাইয়ের মৃত্য়ুর পর তাঁর ছেলের থেকে গুরুর সারিঞ্জা কিনে নিয়েছিলেন 5 টাকায়। আর তা বাজিয়েই যত নামডাক। মাঝে গ্রামের ঘুমা কীর্তনীয়ার কাছ থেকেও সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বঙ্গরত্ন পাওয়ার পর মাঝেমাঝে সরকারি অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেতেন । অনুষ্ঠান পিছু এক হাজার টাকা মিলত ৷ তাতে করে অভাবের সংসারে কিছুটা সুরাহা হত ৷ কিন্তু, লকডাউনের জেরে সরকারি অনুষ্ঠান বন্ধ।
মূলি বাঁশের বেড়া আর টিনের চালের বাড়িটার যেন শিল্পীর মতোই বয়স হয়েছে ৷ জানলায় কপাটের বদলে প্লাস্টিক পরদা ৷ দুর্বল কাঠের সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠার ঘরে উঠতে হয় ৷ এটাই শিল্পীর সাধনক্ষেত্র ৷ বেড়ার দেওয়ালের গায়ে পেরেকে ঝুলছে গুরুর দেওয়া সেই সারিঞ্জা ৷ শিল্পীর হাত যাতে ছড় টানলেই যেন বদলে যায় পৃথিবী ।
মঙ্গলু রায় বলেন, "সবাই বলে আমি 'বড়লোক'। গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানও বলে, তোর কীসের অভাব। তাই দুঃখ কষ্টের কথা আর কাউকে বলি না। " থেমে থেমে বলেন শিল্পী, "তবে সারিঞ্জাটা আমার সব কিছু। সারিঙ্গাটা বাজাই যখন, তখন আমার থেকে 'বড়লোক' কেউ না।"
যদিও 'বড়লোক' শিল্পীর অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে ৷ মঙ্গলু রায় বলেন, "বার্ধক্য ভাতার জন্য দরখাস্ত দিয়ে লাভ হয়নি। সরকারি লোক আমার কথা শোনেই না। সারিঞ্জা বাজিয়েই যা পাই, তাই দিয়ে চলি। কিন্তু, বয়স হয়েছে ৷ গলাও সায় দেয় না। তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর থেকে কিছু টাকা পাই । তবে, বঙ্গরত্ন নামটাই শুধু পেয়েছি। আর কিছু পাইনি । সেই সময় এক লাখ টাকা পেয়েছিলাম ৷ ছেলের বাড়ির মন্দিরের দাওয়া তুলে দিয়েছিলাম । কিছুই রাখিনি । এখন ভিক্ষা না করলে সংসার চলে না ৷ লকডাউনের জেরে ভিক্ষেও মিলছে না। কতদিন এভাবে চলবে জানি না।"
মঙ্গলু রায়ের স্ত্রী চম্পা রায় বলেন, "খুবই কষ্টে আছি। সম্প্রতি ঝড়ে সব ভেঙে গেছে। সুপারি গাছ ভেঙে পড়েছে। সুপারি বিক্রি করে কিছু রোজগার হত ৷ সেটাও শেষ। এখন সরকারি অনুষ্ঠান বন্ধ। অনুষ্ঠান করলে টাকা মেলে, তাছাড়া মেলে না। শিল্পী ভাতা এক হাজার টাকা করে পান ৷ তাই দিয়ে কোনরকমে বেঁচে আছি । আর চলতে পারছি না। সরকারি সাহায্য পেলে ভালো হত তো বটেই।"