কলকাতা, 14 এপ্রিল : পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাওয়া তো দূরের কথা দিন দিন যেন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে ৷ বর্তমান পরিস্থিতির চিত্র আরও পরিষ্কার করে আমাদের সামনে তুলে ধরছে প্রতিদিনের আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ৷ যার লেখচিত্র বা গ্রাফ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী ৷ মার্চের গোড়ার দিকে 24 ঘণ্টায় নতুন করে কোরোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সারা দেশে 100-150 জন ৷ যা এক সপ্তাহের মধ্যে বেড়ে দাঁড়ায় 300-350 ৷ তবে বর্তমানে সেই আক্রান্তের সংখ্যা 24 ঘণ্টায় নতুন করে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় 1000-এর কাছাকাছি ৷ অর্থাৎ প্রতি 24 ঘণ্টায় দেশে নতুন করে প্রায় 1000 জন আক্রান্ত হচ্ছেন ৷
একই ভাবে রাজ্যেও বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা ৷ আক্রান্তের সংখ্যা রাজ্যে আরও বাড়বে বলে আগাম স্বতর্ক করেছেন রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায় ৷ পরিস্থিতি মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্য ইতিমধ্যে লকডাউনের সময়সীমা বাড়িয়েছে 15 দিন ৷ গতকাল নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে এই কথা জানান তিনি ৷ সেই সঙ্গে রাজ্যের মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেন৷
রাজ্যের উত্তরবঙ্গেও ইতিমধ্যে দুইজন কোরোনা আক্রান্তের খবর পাওয়া গিয়েছে ৷ যাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন মহিলা ৷ তাঁর মৃত্যু হয়েছে৷ এই পরিস্থিতিতে উত্তরবঙ্গের প্রতিটি জেলার হাসপাতালগুলিতে বাড়তি ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷ তৈরি করা হয়েছে কোয়ারান্টাইন সেন্টার ৷ তৈরি করা হয়েছে আইসোলেশন ওয়ার্ডও ৷ কিন্তু সংক্রমণ রুখতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য মাথাপিছু 10 লাখ টাকা বিমার ঘোষণা করেছেন ৷ কিন্তু তা দিয়ে সংক্রমণ রোখা যাবে না ৷ সংক্রমণ রুখতে প্রয়োজন উপযুক্ত সরঞ্জাম ৷ যেমন মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার ৷ প্রয়োজন পার্সোনাল প্রোটেক্টটিভ ইকুইপমেন্ট(PPE) ৷ আর সেই PPE যথাযথভাবে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ তুলেছেন অ্যাম্বুলেন্স চালক থেকে হেল্পার এবং চিকিৎসকরাও ৷
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার জরুরিকালীন অবস্থাতে যারা রোগীদের পরিষেবা দিচ্ছেন তাঁদের একাধিকের অভিযোগ, সরকারের তরফে এখন পর্যন্ত কোনও সাহায্য পাননি তাঁরা ৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছেন একাধিক অ্যাম্বুলেন্স চালক ও হেল্পার ৷ জলপাইগুড়ির বাসিন্দা পেশায় অ্যাম্বুলেন্স চালক নিয়াজুর রহমন জানান, ''তিনি মূলত মা-ও তাঁর বাচ্চাদের পরিষেবা দেন ৷ কিন্তু দেশের এই পরিস্থিতিতে আমাদের Covid-19-এর ডিউটিও করতে হচ্ছে ৷ আমি মনে করি দেশের এই খারাপ দিনে আমরাদের মতো যাঁরা স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত, পুলিশ প্রত্যেকের একসঙ্গে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা উচিত ৷ '' সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য রাজ্যের তরফে চালু করা বিমার প্রশংসাও করেন তিনি ৷
জলপাইগুড়ি জেলায় মোট অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে 218টি । তার মধ্যে রয়েছে 28টি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স । যার মধ্যে 8টি অ্যাম্বুলেন্স কোরোনা রোগী বহন করার জন্য বন্দোবস্ত কেরেছে জেলা প্রশাসন । যার মধ্যে জেলা সদরে পরিষেবার জন্য 102 -এর দুটি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে । সেই সঙ্গে প্রতিটি ব্লকে আর্থাৎ জেলার ছয়টি ব্লকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য একটি করে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন । ওই রকম এক অ্যাম্বুলেন্সের চালক গুলজ়র রহমন বলেন, ''এই ডিউটিটা ভয়ের ৷ কিন্তু আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে ৷ আজ যদি আমার বাড়ির লোক অসুস্থ হয়, আর যদি কেউ কাজ না করে তাহলে আমার কাছের লোকটার কী হবে ৷ সেই জন্যই আমরা উদ্যোগ নিয়েছি একত্রিত হয়ে সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার ৷''
যাঁরা ইতিমধ্যেই পরিষেবা দেবে না বলে জানিয়েছেন তাঁদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সবার মনোভাব এক না ৷ যাঁরা কোরোনা ভাইরাসকে ভয় পেয়েছেন, তাঁরা চলে গিয়েছেন ৷ আমি তাঁদের নিয়ে কিছু বলব না ৷ এটা তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয় ৷ গুলজ়ারের মতই আরেক অ্যাম্বুলেন্স চালক মহম্মদ রাসেল বলেন, ''আমরা 102 -এর অ্যাম্বুলেন্স চালাই ৷ আমরা পালা করে ডিউটি করছি ৷ একেকজন ছয় দিন, সাত দিন করে ডিউটি করছি ৷ আমাদের দুটো অ্যাম্বুলেন্স চলছে ৷ আমরা সবাই পালা করে ডিউটি করছি, যাতে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায় ৷ অন্তত চেষ্টা করছি ৷ ডিউটি করতে ভয় লাগছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমরা এখন জরুরি পরিষেবা প্রদানের কাজ করছি ৷ দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যেতে পারি না ৷''
যদিও একাংশ অ্যাম্বুলেন্স চালক এই পরিস্থিতিতে রোগীদের পরিষেবা দিতে নারাজ ৷ তাঁদের দাবি হাসপাতালের তরফে তাঁদের কোনও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়নি ৷ (PPE) পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্টও তাঁদের দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই ৷ তেমনি একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক শুভেন্দু গুপ্ত জানান, আমার জনগণের সেবা করছি ৷ কিন্তু আমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য সরকারের তরফে কোনও সহযোগিতা করা হয়নি ৷ কোন কোন রোগীদের পরিষেবা দিচ্ছেন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন , ''আমরা জেনে নিচ্ছি রোগীর কী সমস্যা আছে ৷ তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি ৷''
রাজ্য সরকারের তরফে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ঘোষণা করা বিমার কোনও নথি তাঁরা এখন পাননি বলেও অভিযোগ করেন তিনি ৷ শুভেন্দুবাবুর মতোই পেশায় সববাহী গাড়ির চালক রাজু বাহাদুর সিং । তিনি বলেন, ''আমাদের নিজেরাই সুরক্ষিত না ৷ আর আমরা নিজেরাই যদি সুরক্ষিত না হয় তাহলে কী করে ওই রোগীদের পরিষেবা দেব ৷ আমাদের এই কাজ করার জন্য মাস্ক দরকার, PPE দরকার ৷ কিন্তু আমরা কিছুই পাচ্ছি না ৷ ডাক্তাররাই পাচ্ছেন না তাহলে আমরা কী করে পাব ৷''
যদিও সরকারের তরফে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য জীবনবিমার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান, মালদার ইংরেজ বাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান নীহাররঞ্জন ঘোষ ৷ তিনি বলেন, আমাদের তরফে মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস, স্যানিটাইজ়ার দেওয়া হয়েছে ৷ কিন্তু কেন তাঁরা পাননি আমাদের জানা নেই ৷ জেলার অ্যাম্বুলেন্স চালক থেকে শববাহী গাড়ির চালকরা যে PPE পাচ্ছেন না তার কারণ হিসেবে তিনি বলেন উৎপাদন না হওয়ায় এই সমস্যা দেখা দিয়েছে ৷
সব মিলিয়ে উত্তরবঙ্গের কিছু জায়গাকে বাদ দিলে অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা স্বাভাবিক রয়েছে ৷ কিন্তু বেশিরভাগ জেলা থেকেই একটা অভিযোগ উঠে এসেছে যে অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের উপযুক্ত নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়নি প্রশাসনের তরফে ৷ একাধিক চালকরা পাননি মাস্ক, PPE, স্যানিটাইজ়ার ৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিষেবা চালিয়ে যাবেন বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ৷ কিন্তু চালকদের একাংশ তাঁদের দায়িত্ব থেকে সরে এসেছেন ৷ যার জেরে কিছুটা হলেও সমস্যার সম্মুখীন হলেও হতে পারেন সাধারণ মানুষ ৷
একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য ৷ তিনি বলেন, "কুসংস্কারের মধ্যে বহু মানুষ আবদ্ধ হয়ে পড়ছেন ৷ অনেকে গো-মূত্র পান করছেন ৷ কিছু মানুষ মনে করছেন অ্যাম্বুলেন্সে কোনও রোগীকে নিলে কোরোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পরবে ৷ আমার মনে হয় আমিও যদি অসুস্থ হই, তাহলে আমাকেও নিয়েও যেতেও কোনও অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাবে না৷"
তিনি আরও বলেন, " পরিস্থিতি যাই হোক না কেন মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে ৷ মানুষকে সচেতন করতে হবে ৷" সেই সঙ্গে অশোকবাবু মনে করেন কলকাতার মতোই জেলা ভিত্তিক টাস্ক ফোর্স গঠন করা উচিত ৷
তাঁর কথায়, ''এই লড়াই শুধু মাত্র কোরোনার বিরুদ্ধে না ৷ লড়াইটা কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও ৷ এই পিছিয়ে পড়া চিন্তার বিরুদ্ধে লড়াই ৷ এই লড়াইয়ে জনগণকে যোগ দিতে উৎসাহিত করতে হবে ৷ গণ উদ্যোগ ছাড়া এই মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়না কখনও ৷ গণ উদ্যোগ তৈরির পিছনে সরকারের দায়িত্ব আছে ৷ আর আমার মনে হয় সরকার সেই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছে না ৷"