হাওড়া, 26 জানুয়ারি: হাওড়ার প্রাচীনতম মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম পঞ্চাননতলা রোড সংলগ্ন বঙ্কিম পার্কের পাশে 1 নম্বর উমেশ চন্দ্র দাস লেনের ছোট্ট গলির মধ্যে এই মন্দির। 1923 সালের 28 জুন প্রতিষ্ঠিত হয় ওই মন্দির। বছর চারেক আগে উদয়নারায়ণপুরের খেমপুর গ্রামে আরও একটি সরস্বতী মন্দির (Saraswati Temple) তৈরি হওয়ার আগে পঞ্চাননতলার মন্দিরটিকেই রাজ্যের একমাত্র সরস্বতী মন্দির বলে মনে করা হত। এখানে 108টি মাটির খুড়ি বিশেষ ধরনের বড় বাতাসা এবং ফল দিয়ে শ্বেত পাথরের সরস্বতী প্রতিমাকে পুজো দেওয়াই রীতি।
যদিও আশ্চর্যের বিষয় অধিকাংশ হাওড়াবাসীও এই মন্দিরের কথা জানেন না। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় জনৈক উমেশ চন্দ্র দাস রাজস্থানের জয়পুর থেকে শ্বেত পাথরের সরস্বতী মূর্তি এনে বাড়িতে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। উমেশচন্দ্রের আদি বাড়ি ছিল উত্তর 24 পরগনার বারাসতে। বারবার বর্গী হানার আশঙ্কায় তাঁরা সেখান থেকে হুগলির বাঁশবেড়িযায় চলে আসেন। 1856 থেকে 1887 পর্যন্ত তিনি হাওড়া জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সেই সূত্রেই হাওড়ার পঞ্চাননতলা রোডের ওই বাড়িতে তাঁর বসবাস শুরু করেন। তাঁর নামানুসারে পঞ্চাননতলা রোডের বঙ্কিম পার্ক সংলগ্ন ওই সরু গলির নাম রাখা হয়েছে।
বর্তমান তাঁর বংশধর উমেশ চন্দ্র দাসের মেজো ছেলে রণেশ চন্দ্র দাস শিবপুরের এক কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। এরপর কর্মসূত্রে তিনি রাজস্থানে চলে যান। সেখান থেকেই আনা হয়েছিল মূর্তিটি। তবে মূর্তি আনলেও উমেশচন্দ্র ওই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেননি। 1913-র 16 ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর বছর দশেক পরে 1923-এর 28 জুন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। 2001-এ সেটিকে সংস্কার হয়। মন্দিরের একটি ফলক থেকে জানা যায়, 1999-এর 20 মার্চ মূর্তিটি জয়পুর থেকে আনার পরে বাড়িতেই তার পুজো শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মন্দিরটি তখন প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।
উমেশের প্রপৌত্র সত্যেন্দু শেখর দাস বলেন, "সেই সময়ে আমাদের পরিবারে শিক্ষার অনুকূল আবহাওয়া। উমেশচন্দ্রর চার ছেলে এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের অনেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। সেই সূত্রেই উমেশচন্দ্র বাড়িতে শিক্ষার আবহাওয়া বজায় রাখতে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর পুজোর কথা ভাবেন।" মূর্তিটিতে চার ফুট লম্বা শ্বেতপাথরের প্রতিমা হাঁসের উপরে দাঁড়িয়ে। বাঁ হাতে ধরা বীণা। সরস্বতী পুজোর দিন বাসন্তী রঙের শাড়িতে নতুন করে সাজানো হয় প্রতিমাটিকে। বছরভর মন্দিরে পুজো হলেও সরস্বতী পুজোর দিন থাকে বিশেষ আয়োজন। আগের দিন থেকে মন্দিরকে ফুল, মালা, আলোয় সাজানো হয়। শ'য়ে শ'য়ে মন্দিরে পুজো দিতে হাজির হন।
আরও পড়ুন: সরস্বতী পুজোর থিমে রাজ্যের 'শিক্ষা দুর্নীতি'
পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম অংশুমিতা দাস জানান, একশো বছরে পুরাতন ঐতিহ্যকেই সামনে রেখে তাঁরা চলছেন। একশো বছর ধরে যে ভাবে রঙিন কাগজ কেটে শিকল বানিয়ে সাজানো হতো আজও তাই চলে আসছে। তবে একশো বছরের জন্য ওই কাগজ দিয়েই বিশেষ কিছু সাজানোর প্রচেষ্টা তাঁরা করছেন। পুজো যেহেতু পরিবারের প্রবীণ সদস্যরাই দেখাশোনা করেন তাই তাঁরা তাঁদের সঙ্গে থেকে নিয়ম নীতি শিখছেন। প্রসাদে যে 108টি মাটির খুড়ি দেওয়া হয় এবারে সেই সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে যাতে কেউ প্রসাদ থেকে বঞ্চিত না-হন ।
রণেশ চন্দ্রর ছেলের নাতি সোমেশ জানান, পুজোর জাঁকজমক এবং আড়ম্বরে কোনও ঘাটতি রাখেন না তাঁরা। বরাবরের রীতি মেনেই পুজো হচ্ছে।
এছাড়াও মাটির খুঁড়িতেই তাঁরা প্রসাদ দেন। ফল, বিশেষ বাতাসা, মিষ্টি দেওয়া হয় পুজোর প্রসাদ রুপে। সরস্বতী দেবী নিত্যদিন পূজিতা হন এই মন্দিরে। উল্লেখ্য সাম্প্রতিক ভারতীয় সামাজিক জীবনে দেবী সরস্বতীর নিত্য আরাধনার চল সেভাবে আগে ছিল না। যদিও মধ্য হাওড়ায় এরকম একটি প্রাচীন মন্দির প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও তার তেমন প্রচার বা পরিচিতি ঘটেনি।