হাওড়া, 6 সেপ্টেম্বর : দশমীতে পান্তা ভাত খেয়ে বাপের বাড়ি ছাড়েন উমা । সঙ্গে দেওয়া হয় ল্যাটা মাছ পোড়া । হ্যাঁ, আর পাঁচটা বনেদি বাড়ির মতোই বেশ কিছু ব্যতিক্রমী নিয়ম মেনেই দুর্গাপুজো হয় উত্তর হাওড়ার 'সালিখা হাউজ়'-এর বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে ।
'সালিখা হাউজ়'-এর বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো । 'আমায় একটু জায়গা দাও, মায়ের মন্দিরে বসি' থেকে 'ও কেন এত সুন্দরী হল' - এরকমই একাধিক কালজয়ী বাংলা গানের স্রষ্টা প্রয়াত সংগীতশিল্পী পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজো । তাঁর লেখা এবং সুর করা গান যেমন বাংলার সংগীত জগতের জৌলুস বাড়িয়েছে তেমনই তাঁর বাড়ির দুর্গাপুজোও কালক্রমে অভিজাত বাড়ির পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে ।
বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের রাধামোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে প্রায় 286 বছর আগে উত্তর হাওড়ার 'সালিখা হাউস'-এ শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজো । অন্যত্র সেই পুজোর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে । একে একে সেই পুজোর টানে 'সালিখা হাউস' ঘুরে গিয়েছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের নানান বিশিষ্টরা । সংগীত জগতের মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আরতী মুখোপাধ্যায়, বাপ্পি লাহিড়ী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক স্তরের সিদ্ধার্থশংকর রায়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মতো ব্যক্তিত্বের আগমন হয়েছে এই বাড়ির ঠাকুর দালানে ।
জন্মাষ্টমীতে প্রথম মাটি আনা দিয়ে শুরু । তারপর গড়া হয় প্রতিমা । পুজোর সাতদিন আগে বাড়ির বিশেষ দালানে বোধন হয় মায়ের । ষষ্ঠীর সকালে বেলবরণ হয়ে ষষ্ঠীপুজো হয় । অষ্টমীতে হয় সধবা পুজো । এমনই নানা ব্যতিক্রমী রীতি মেনে হয় 'সালিখা হাউজ়'-এর দুর্গাপুজো । আর ভোগের বৈচিত্র তো আছেই । তবে, সবচেয়ে আকর্ষণীয় দশমীর ভোগ । দশমীতে বাসি ভোগ খেয়েই বাপের বাড়ি ছাড়েন উমা । রীতি এটাই ।
মহানায়ক উত্তমকুমারের স্মৃতিও জড়িয়ে রয়েছে এই বাড়ির পুজোর সঙ্গে । কারণ, এই বাড়ি যে মহানায়কের দূর সম্পর্কের মামার বাড়ি ! প্রতি বছর পুজোয় নিয়ম করে এই বাড়িতে আসতেন উত্তমকুমার । শুধুমাত্র পুজোয় বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে ঢুঁ মারা নয়, ঠাকুর দালানের সামনের উঠোনে কোমর বেঁধে নাচ, গলা ছেড়ে গানও গাইতেন উত্তমকুমার ।
তবে, শুধুই নামিদামি ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি একমাত্র আকর্ষণ নয় এই পুজোর । এই পুজোয় বংশানুক্রমে চলে আসছে কিছু ব্যতিক্রমী নিয়ম । যার অন্যতম বিশেষত্ব এ-বাড়ির পুজোর ভোগে । পুজোর বাকি দিনগুলিতে মায়ের ভোগে থাকে খিচুড়ি, ফ্রায়েড রাইস । আর নবমীতে রান্না করে রেখে দশমীতে দেওয়া হয় পান্তা ভাত । সেটাই হয় ওই দিনের ভোগ । এছাড়াও দশমীতে ঠাকুরের ভোগে পোড়া ল্যাটা মাছ দেওয়ার রীতি বরাবরের । বাসি ভোগে পান্তার সঙ্গে থাকে চালতা দিয়ে মুসুর ডাল, ছাঁচি কুমড়ো, চচ্চড়ি, কচুর শাক । সঙ্গে দেওয়া হয় ল্যাটা মাছ পোড়া ।
এবার 287 বছরে পদার্পণ করবে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির দুর্গাপুজো । কিন্তু একে একে এই পুজোর থেকে সরে গিয়েছেন সমস্ত শরিক । বর্তমানে পুজো পরিচালনার সমস্ত দায়িত্বই সামলান পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো সুস্মিত বন্দ্যোপাধ্যায় । একার দায়িত্ব পুজো করতে গিয়ে খানিক কমেছে জৌলুস । সেই সঙ্গে এ-বছরের কোরোনা আবহে ছেদ টানতে পারে জন সমাগমেও । কিন্তু মায়ের আরাধনায় খামতি থাকবে না বলে দাবি সুস্মিতবাবুর । তবে উপচে পড়া ভিড় না হলেও সালিখা হাউজ়ের আনাচে-কানাচে অন্যান্যবারের মতো এ-বছরও হয়তো প্রতিধ্বনিত হবে, "আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি ।"