হাওড়া, 16 অক্টোবর: বর্তমান সমাজে দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে 'দেবী দুর্গার মূর্তি তৈরিতে পতিতালয়ের মাটি আবশ্যিক'- এই ধরনের পোস্ট সোশাল মিডিয়াতে ঘোরাফেরা করছে । এমনটা বলা হয়ে থাকে যে, সমাজের চোখে তাঁরা 'পতিতা' হলেও মায়ের মূর্তি তৈরিতে তাঁদের অবদান অতি আবশ্যিক ৷ শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, দেবী দুর্গার প্রতিমা গড়তে মূল চারটি উপাদানের প্রয়োজন, সেগুলি হল গাভীর মূত্র, গোবর, ধানের শিষ ও 'পতিতা'র দরজার মাটি । তবে এ বিষয়ে কী মত শাস্ত্র বিশেষজ্ঞদের ?
পতিতালয়ের মাটির প্রয়োজনীয়তার কারণ প্রসঙ্গে আধুনিক সমাজতাত্বিকেরা বলে থাকেন, যে পুরুষ পতিতালয়ে যান, তিনি তাঁর কয়েক জন্মের পুণ্যের অর্জিত ফল রেখে আসেন পতিতালয়ে, বিনিময়ে তিনি বহন করে আনেন পাপ । সুতরাং পতিতাবৃত্তি যাঁরা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা অর্জন করেন পুরুষের অর্জিত পুণ্য । আর তাই পতিতালয় পুণ্যস্থান । এই পুণ্যস্থানের মাটি দুর্গাপুজোয় আবশ্যক ।
যদিও এই সকল বিশ্বাস ও মতবাদের পিছনের আসল সত্যিটা কী, এই দাবিগুলি কতটা সত্যি কতটা মিথ্যে, কতটা শাস্ত্রসম্মত, নাকি এর পেছনেও রয়েছে কোনও উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার, তারই কার্যকারণ ও উৎস খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে একাধিক তথ্য ও ব্যাখ্যা । যা এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত জরুরি ।
মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে, “অভিষিক্তা ভবেৎ বেশ্যা ন বেশ্যা কূলটা প্রিয়ে ।”
“পূর্ণাভিষেকো দেবেশি দশ বিদ্যাবিধোস্মৃত”
“সুবন্ধবো যে বেশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পজ্রা।।”
বৈদিক শাস্ত্রকারেরা এর অর্থ বোঝাতে গিয়ে বলছেন, যিনি দেবত্ব অর্জন করেছেন, সেই রকম অভিষিক্তাকেই বেশ্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে । অর্থাৎ পূর্ণাভিষেক মন্ত্রচৈতন্য হওয়ার ফলে যিনি দেবত্বে উন্নীত হয়েছেন, এ রকম অভিষিক্তাকে বেশ্যা বলা হয়েছে ৷ আর তাঁরা যেখানে বাস করেন সেই দ্বারের মাটিই প্রয়োজন দুর্গাপুজোয় ৷
দেবী দুর্গাকে দেবত্ব প্রদান করেছিলেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু–মহেশ্বর । বৈদিক সংস্কৃত শব্দের অর্থ না জানার ফলে বিভ্রান্তি তৈরি হয় । এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমোদিত 'সংস্কৃত টোল'-এর প্রধান অধ্যাপক রামচন্দ্র ঘোষাল স্মৃতিতীর্থ বলেন, "দেবী দুর্গার মূর্তি নির্মাণের সময় 'বেশ্যাদ্বারের মৃত্তিকা'র প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ আছে । এই মৃত্তিকা আসলে কী, মহানির্বাণ তন্ত্রে শিব-পার্বতী সংবাদে তার উল্লেখ পাওয়া যায় । এখানে যে সাধক/সাধিকা দশ মহাবিদ্যার সাধনাতে সিদ্ধিপ্রাপ্ত তিনিই অভিষিক্তা । উক্ত বেশ্যা মানে কূলটা বা গণিকা অথবা পতিতা নন । এমনকী পতিতার সঙ্গে যে ব্যক্তি সম্পর্ক স্থাপন করবেন, তিনি নরকে গমন করবেন ।"
রামচন্দ্র ঘোষাল স্মৃতিতীর্থ আরও বলেন, দশ মহাবিদ্যার উপাসক যে গৃহে দশ-মহাবিদ্যার উপসনা ও নিজেরা বসবাস করে থাকেন, সেই গৃহদ্বারের মাটিকে বেশ্যাদ্বারের মৃত্তিকা বলে । বর্তমানে সে রকম দশমহাবিদ্যার উপাসক নেই বা একেবারেই দুস্প্রাপ্য । তাই শাস্ত্রবিদগণ নিজের গুরুর গৃহদ্বারের মাটি ব্যবহার করতে বলেন । অথবা কোনও সতীপীঠের মাটি ব্যবহার করতে বলেন । দশ মহাবিদ্যার নিকট ত্রিলোক বশীভূত, তাই তিনিই বেশ্যা । এই বিদ্যাতে সিদ্ধিপ্রাপ্ত সাধকের অঙ্গেই দশ মহাবিদ্যা অধিষ্ঠান করে । তাই সেই ব্যক্তির গৃহের মৃত্তিকাকেই বেশ্যাদ্বারের মৃত্তিকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান তিনি ৷
আরও পড়ুন: পুরনোকে ভুলে নতুন নয়! নাড়ির টানে সেতুবন্ধন হাতিবাগান সর্বজনীন দুর্গাপুজোর মণ্ডপে
পিতার হাত থেকে প্রতিমা তৈরি শিখেছেন হাওড়ার সাঁকরাইল ব্লকের বাসিন্দা ও মৃৎশিল্পী বিষ্ণুপদ মাইতি । তিনি এই বিষয়ে বলেন, "আমি বাবার হাত ধরেই প্ৰতিমা তৈরি করা শিখেছি । বেশ্যাদ্বারের মাটি লাগে প্ৰতিমা তৈরি করতে, এটা আমি শুনেছি । যদিও এর ব্যবহার আমার বাবাও করতো না, আমিও কখনও করিনি । আমরা বরাবরই গঙ্গার থেকে মাটি এনে প্ৰতিমা তৈরি করি । কয়েক বছর ধরে আমি 150 বছরের পুরাতন বনেদি বাড়ির প্রতিমাও তৈরি করি । যদিও ওই ধরনের কোনও মাটি আমি ব্যবহার করি না ।"
বৈদিক শাস্ত্রকারদের অভিমত, সমাজে শব্দের অপব্যাখ্যা হয়ে যাওয়ার কারণেই এই ধরনের অবস্থা তৈরি হয়েছে । শাস্ত্র, পুঁথির জ্ঞানের সঙ্গে বর্তমান সমাজের কোনও সম্পর্ক নেই । সমাজের লোকেদের এখন শাস্ত্রজ্ঞান নেই, সমর্পণ নেই, শ্রদ্ধা নেই । তাই বর্তমানে এই পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে ৷ শাস্ত্রে বলছে, পিতার মৃত্যুর পর মুখ্য অগ্নির স্থান বদলে গিয়ে মুখে-আগুন হয়ে দাঁড়িয়েছে । শাস্ত্রজ্ঞান না থাকার দরুণ সমাজের এই অবস্থা বলেও দাবি শাস্ত্রকারদের ।
একইভাবে গীতার জ্ঞানযোগ অধ্যায়-এর 40 নং শ্লোক "অজ্ঞঃ চ অশ্রদ্দধ্যানঃ চ সংশয় আত্মা বিনশ্যতি । ন অয়ম লোক অস্তি ন পরাঃ ন সুখম্ সংশয় আত্মম ।"
এই শ্লোকের ব্যাখ্যা হল, মুর্খ এবং শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি কখনও ভগবদ্ভক্তি লাভ করতে পারেন না । সন্দিগ্ধ চিত্ত ব্যক্তি ইহলোকে সুখভোগ করতে পারে না এবং পরলোকেও সুখভোগ করতে পারে না । শাস্ত্রকারদের মতে, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাতে শাস্ত্র সম্বন্ধে অনাগ্রহ ও আশ্বিন মাসে দুর্গা পুজোর প্রাক্কালে বর্তমান বাঙালি সমাজের অধিকাংশই 'শারদোৎসব'-এ মেতে উঠলেও পুজোর শিষ্টাচার কতটা রক্ষিত হচ্ছে, তাই নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে ।