হাওড়া, 7 ডিসেম্বর: বিপন্ন পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত জাতীয় উদ্যান বোটানিক্যাল গার্ডেন ৷ গঙ্গা-তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ভাঙনের আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন পরিবেশবিদরা ৷ সম্প্রতি হওড়ায় বোটানিক্যাল গার্ডেনের গঙ্গা-পাড়ে বহু গাছ উপড়ে পড়েছে ৷ এই ঘটনা ভূমিক্ষয়ের ইঙ্গিতবাহক এবং বিপজ্জনকও বটে (Ganges soil erosion affects existence of Botanical Garden and Howrah existence) ৷
মঙ্গলবার দুপুরে গঙ্গার তীরে বি-গার্ডেনের পাড় থেকে পরিদর্শন করেন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত (Subhas Datta, environmental activist) ৷ তিনি বি-গার্ডেন ও তৎসংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকায় নদী ভাঙনের আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, "এটা জাতীয় বিষয়" ৷ কেন্দ্র অথবা রাজ্য কাউকে দোষারোপ করে কাজ হবে না । এর জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও পরিকাঠামো প্রয়োজন বলে জানান প্রবীণ পরিবেশবিদ ।
হাওড়ায় গঙ্গার পাড়ে ভাঙন (Ganges Soil Erosion to affect Howrah)
এদিন তিনি বলেন, "গঙ্গার ভাঙনে এই উদ্যান (বোটানিক্যাল গার্ডেন) বিপন্নতার মুখে ৷ পরিস্থিতিটা সরেজমিনে দেখতে এসেছি ৷ এ নিয়ে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষদের কাছে যাব ৷ পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিচারভাগীয় কর্তৃপক্ষদের কাছেও যাব ৷" তাঁর অভিযোগ, রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনও নজর দেননি ৷ আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, "এই ভাবে যদি 20-25 বছর চলে, তাহলে হাওড়া শহরের অর্ধেকটা গঙ্গাবক্ষে চলে যেতে পারে ৷ তাই এটা ভীষণ ভীষণ ভীষণ জরুরি একটা বিষয় ৷"
গঙ্গাবক্ষে সাংবাদিকদের সুভাষ দত্ত বলেন, "যে ঘাটটা থেকে লঞ্চে উঠলাম, সেই জায়গাটা 20 বছর আগে দেখেছি ৷ সে সময় এখানে ঘাট ছিল না ৷ ঘাট করার জন্য নদীর পাড় কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো হয়েছে ৷ এখানে 20-25 ফুটের ষাঁড়াষাঁড়ি বান এলে তার ঢেউয়ে আরও বেশি ভূমিক্ষয় হচ্ছে বোটানিক্যাল গার্ডেনের ধারে নদীর অংশে ৷"
আরও পড়ুন: ম্যানগ্রোভ রক্ষায় অঙ্গীকার, পড়ুয়াদের নিয়ে সুন্দরবনে গাছফোঁটা দিলেন শিক্ষিকারা
ম্যানগ্রোভ অরণ্যের প্রয়োজনীয়তা (RiverBank Mangrove forest)
গঙ্গার পাড়ে ভূমিক্ষয়ের ফলে গাছ ভেঙে পড়া নিয়ে চিন্তিত পরিবেশকর্মী ৷ তিনি বলেন, "এই বিপন্নতা আজ বৃক্ষের উপর, আগামী দিনে আমাদের উপর আসবে ৷ এরপর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিপন্ন হবে ৷" এই ক্ষয় রোধে তিনি ম্যানগ্রোভ অরণ্যের উপকারিতার কথা উল্লেখ করেন ৷ সুভাষ দত্ত বলেন, "সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ অরণ্য ৷ সেখানে সব খরস্রোতা নদী বয়ে চলেছে ৷ এখানেও নদীর পাড় রক্ষা করতে একাধিক পদক্ষেপ করা যায় ৷ কংক্রিট, সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো যায় ৷ কিন্তু এখানে এত বড় বান আসে, তাই শুধুমাত্র সিমেন্ট দিয়ে কংক্রিটাইজ করলে হবে না ৷" আগে এই অঞ্চলে নদীর জল এত নোনা ছিল না ৷ ব্রিটিশরা শ্রীরামপুরে ওয়াটার ওয়ার্কসের ইনটেক পয়েন্ট তৈরি করেছিল ৷ তাতে নোনা জল যেত না ৷ এখন সেই জল ব্যান্ডেল পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে ৷ তাই নোনা জল বৃদ্ধিতে নদীর পাড়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্য রোপণ করা দরকার ৷ তিনি বলেন, "বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটি বাফার জোন তৈরি করতে হবে ৷"
পলি জমা (Sediment of Mud)
গঙ্গায় পলি জমা কি ভূমিক্ষয়ের জন্য দায়ী ? এর উত্তরে সুভাষ দত্ত বলেন, "এই বিপর্যয় অনেকগুলি কারণের মিশ্রণে হচ্ছে ৷ শুধুমাত্র পলি জমার জন্য নয়, এটা প্রাকৃতিক নিয়ম ৷ নদী সমুদ্রমুখী ৷" এই এলাকা থেকে সমুদ্র আনুমানিক 100 কিলোমিটারের দূরে অবস্থিত ৷ তাই গঙ্গাতে পলি জমবেই ৷ এমনকী পলি পরিষ্কারের উপায় কোনও কাজে আসবে না ৷ একে 'ভুল' তথ্য বলে উল্লেখ করেন পরিবেশবিদ ৷ তবে এক্ষেত্রে পোর্ট ট্রাস্টের ড্রেজিং প্রসঙ্গ টেনে সুভাষ দত্ত বলেন, "পোর্ট ট্রাস্ট ড্রেজিং করে জাহাজ চলাচলের জন্য ৷ নদী রক্ষার জন্য নয় ৷ এই ড্রেজিং করাটা বাড়াতে হবে ৷ হাওড়ার দিকে এই ড্রেজিং বাড়লে, নদীতে জলের গভীরতা বাড়বে ৷ এতে নদীর দুই কিনারে জলের ধাক্কা কম হবে ৷"
গঙ্গার ইলিশ (Ganges Hilsa Missing)
হাওড়ার পাশ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গায় ইলিশ মেলে না ৷ এ নিয়ে নেতাদের ইলিশ হাতে আনন্দ প্রকাশের কথা তুলে ধরেন সুভাষ দত্ত ৷ তিনি বলেন, "মিষ্টি জল এখানে আসছে না, পদ্মায় চলে যাচ্ছে ৷ আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা দু'হাতে দুটো ইলিশ তুলে ইলিশ উৎসব করেন ৷ কিন্তু গঙ্গায় ইলিশ আসছে না ৷" লন্ডনে টেমস নদীতে তিনি গিয়ে দেখেছেন, কীভাবে তারা স্যালমন মাছ রক্ষা করে ৷ পরিবেশবিদ বলেন, "আমরা সেটা (ইলিশ রক্ষা) জানি না ৷ এখানে একদিকে মিষ্টি জলের প্রভাব কমে নোনা জলের প্রভাব বেড়েছে ৷ তার ফলে যে অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছে, তাতে গঙ্গা থেকে ইলিশ মাছ হারিয়ে গিয়েছে ৷" ইলিশের পাশাপাশি গঙ্গায় নেই শুশুক মাছ, জানান সুভাষ দত্ত ৷ তিনি শৈশবের কথা মনে করেন, "ছোটবেলায় শুশুক মাছ দেখতে পেলে, মনে হত আজ একটা শুভ দিন ৷ বিগত 20 বছরে আমি গঙ্গায় শুশুক মাছ দেখতে পাইনি ৷"
গঙ্গায় জলজ প্রাণীরা হারিয়ে যাচ্ছে ৷ এটাও এক ধরনের নদীদূষণ এবং সর্বনাশের কারণ, উদ্বিগ্ন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত ৷ তিনি বলেন, "আজ জলজ প্রাণীরা হারাচ্ছে ৷ আগামী দিনে আমরা হারিয়ে যাব ৷"
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে মাছের ভেড়ি তৈরির অভিযোগ
দায়ী কে, কেন্দ্র নাকি রাজ্য (Centre or State Responsible for Ganges Soil Erosion) ?
গঙ্গার পাড় ভাঙন রোধে একটা পরিকল্পনা, প্রচেষ্টা দরকার ছিল ৷ কিন্তু তা হয়নি, হতাশা পরিবেশবিদের গলায় ৷ তবে এর জন্য তিনি কেন্দ্র বা রাজ্য- নির্দিষ্ট কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান না তিনি ৷ সুভাষ দত্ত বলেন, "আমি এভাবে কাউকে দায়ী করতে চাই না ৷ বিষয়টা সেভাবে তাদের নজরে আসেনি বলে আমি এবার তাদের নজর এদিকে ঘোরাতে চাইছি ৷"
তাহলে উপায় ? এ নিয়ে শীঘ্রই আদালতের দ্বারস্থ হবেন তাঁরা, জানালেন পরিবেশবিদ । রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি ক্ষোভে তিনি বলেন, "আমি জানি, আমরা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে কোনও প্রতিনিধি বা চিঠি পাঠালে, সেটা আবর্জনা ফেলার বাক্সে চলে যাবে ৷ আমরা আদালতে যাব ৷" তাঁর আশা, আগে আদালতের হস্তক্ষেপে অনেক বিষয়ে সমাধান হয়েছে ৷ তিনি বলেন, "আদালত আগেও আমাদের বহু ব্যাপারে স্বস্তি দিয়েছে ৷ এ সমস্যাতেও আদালত আমাদের যথাযথ স্বস্তি দেবে ৷"
প্রসঙ্গত বোটানিকাল গার্ডেনের তীরের মাটিতে সুন্দরী, গড়ান প্রভৃতি লবণাক্ত জলের গাছ গজানোয় চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল পরিবেশবিদদের কপালে । এরপর থেকেই গঙ্গা তীরবর্তী হাওড়া শহরের প্রায় 14 কিলোমিটার পাড় ভাঙনের আশঙ্কা প্রকাশ করতে থাকেন তাঁরা ৷ স্বভাবত তাঁদের আশঙ্কা সত্যি হলে হাওড়ার সঙ্গে কলকাতাতেও এর বড় প্রভাব পড়তে চলেছে, মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল ৷
আরও পড়ুন: মাঝ গঙ্গায় রমরমিয়ে চলেছে অবৈধ বালির কারবার, ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস প্রশাসনের